
২০ মে শিলচরে শোকমিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ফাইল ছবি
আজ থেকে ৬০ বছর আগের কথা। ১৯৬১ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা। সেই দিনটিও ছিল ১৯ মে। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে এই দিনে শহীদ হয়েছিলেন ১১ জন ভাষাবিপ্লবী।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেই শুধু বাঙালিরা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে রক্ত ঝরায়নি। এরপরেও রক্তের বিনিময়েই বাংলাকে তার অধিকার আদায় করতে হয়েছে। ঢাকার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সালাম-বরকতদের আত্মত্যাগের ঠিক ছয় বছর পর ফের মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয় ১১ জন বাঙালিকে। রাষ্ট্রশক্তির গুলিতে শিলচর রেলস্টেশনে লুটিয়ে পড়েন তারা। রক্তের বিনিময়ে বরাক উপত্যকায় স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা।
তবে আসামে ১৯৬১ সালের ওই ভাষা আন্দোলন ও শহীদের ইতিহাস অনেকটাই যেন চাপা পড়ে আছে। অথচ ওই আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কোনো অংশেই কম নয়। তা নিশ্চিতভাবেই বাঙালি জাতির, বাংলাভাষীদের নিজস্ব সত্তা টিকিয়ে রাখার অন্যতম পথ-নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।

আসামের বরাক নদের অববাহিকা অঞ্চল সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে অনেকটাই আলাদা চরিত্রের। ভৌগোলিক অবস্থানও সেই বৈপরীত্যই আরো বেশি করে জিইয়ে রেখেছে। দেশভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালি (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়; কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালি থেকে যায় আসামে। বরাক উপত্যকার একদিকে আসামের পার্বত্য জেলা, বাকি সীমান্ত ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর ও মেঘালয় আর বাংলাদেশের সিলেটের সঙ্গে। রাজ্যে রয়েছে ভাষাগত বৈচিত্র্য। আসাম রাজ্যর প্রধান ভাষা অসমিয়া হলেও, বরাক উপত্যকার প্রায় সব মানুষেরই মাতৃভাষা বাংলা। করিমগঞ্জ, কাছাড় ও শিলচর কার্যত বাঙালিদের ঘাঁটি।
আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের শুরু ১৯৬০ সালের এপ্রিলে। তখন প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমিয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমিয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালিদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা বাড়লে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন। আরও ৯০ হাজার বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যে আশ্রয় নেন।
ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন দেখা যায়, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের চার হাজার ১৯টি কুঁড়েঘর ও ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়। এই জেলায় ৯ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং আহত হন শতাধিক।
১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমিয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন; কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
বরাক উপত্যকার বাঙালিদের উপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আসাম সরকারের এই জাতিগত আগ্রাসী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির জনগণ ‘সংকল্প দিবস’ পালন করেন। বরাকের জনগণকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করে। ২ মে শেষ হওয়া ওই পদযাত্রায় অংশ নেয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন।
পদযাত্রা শেষে পরিষদের প্রধান রথীন্দ্রনাথ সেন জানান, যদি ১৩ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, তাহলে ১৯ মে তারা সর্বাত্মক হরতাল করবেন। ১২ মে আসাম রাইফেলস, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করে। ১৮ মে আসাম পুলিশ আন্দোলনের তিন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরীকে (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) গ্রেফতার করে।
১৯৬১ সালের ১৯ মে। শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে ভোর থেকেই হরতাল ও পিকেটিং শুরু হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারি কার্যালয়, রেল স্টেশন, আদালতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেল স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার ট্রেনের সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। সকাল থেকে হরতাল শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল; কিন্তু দুপুরে স্টেশনে আসাম রাইফেলস এসে উপস্থিত হয়।

বেলা আড়াইটার দিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আন্দোলনকারীদের বন্দুক ও লাঠি দিয়ে দমন করার চেষ্টা করে। তবুও দমে যাননি ভাষাবিপ্লবীরা। আসাম রাইফেলস ১৭ রাউন্ড গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে। এতে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে ৯ জন সেদিনই শহীদ হন; দুইজন পরে মারা যান। সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন ভাষাবিপ্লবী শহীদ হন, তাদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য। তখন তার বয়স মাত্র ১৭। যে বয়সে খেলাধুলা করে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে আন্দোলনে সামিল হওয়ার পেছনে ছিল তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা। নিজের স্বকীয়তা, নিজের ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত হওয়া ও আত্মত্যাগের মাহাত্ম্যই কমলাসহ ভাষাবিপ্লবীদের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েও নিঃশঙ্ক চিত্তে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

পরদিন ২০ মে শিলচরের জনগণ শহীদদের মরদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ জানান। এ ঘটনার প্রভাব ছিল দীর্ঘমেয়াদী। পরবর্তী সময়ে আসামে বাংলাকে দ্বিতীয় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার সেখানে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য এখনো কংগ্রেসকে জবাবদিহি করতে হয়। এবারের আসাম বিধানসভা নির্বাচনেও এটি ছিল বিজেপির অন্যতম প্রধান ইস্যু। আসামের জনগণ এতো শিগগিরই তা ভুলে যাচ্ছে না। ভোটেও এর সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা গেছে।
প্রতি বছর বরাক উপত্যকাসহ বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালিরা ১৯ মে ‘বাংলা ভাষা শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে। তবে এই প্রচার খুবই কম। যে কারণে একটি সংগ্রামী, গৌরবের ইতিহাস কার্যত আড়ালেই পড়ে রয়েছে। সেই সংগ্রামী, বীর শহীদদের প্রতি রইলো শত-কোটি সালাম ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
২০১১ সালে, এই বাংলা ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে গোপা দত্ত আইচ ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে শহীদ কমলা ভট্টাচার্যের একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়।
সেই ১১ জন ভাষা শহীদের তালিকা-
১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য
২. শহীদ শচীন্দ্র পাল
৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর
৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী
৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর
৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব
৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস
৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস
৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ
১০. শহীদ সুনীল সরকার
১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ