স্মরণ
ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান : বহুদর্শী ইসলামিক ইতিহাসবেত্তা

মেহেদী হাসান
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২১, ০৯:০৩

প্রফেসর ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান।
প্রফেসর ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান মৃত্যুবরণ করেছেন গত ২৮ মার্চ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইসলামিক বিদ্যায়তন ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এক মহীরুহ।
তিনি (১৯২৬-২০২১) উচ্চতর পেশাগত জীবনে প্রধানত একজন ইতিহাসবেত্তা ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ কালপর্বের বিশেষভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের ব্রিটিশ অধ্যায়ের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল গবেষক। ধ্রুপদী আরবি ও ফার্সি ভাষার দক্ষতা, আর্কাইভাল ডকুমেন্টস, নথি-পত্র ইত্যাদি থেকে পাঠোদ্ধারের অনন্যতা এবং আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের মাঠ গবেষণার প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে তিনি ব্রিটিশ বাংলার মুসলিম প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো অধ্যয়ন ও গবেষণায় মৌলিক অবদান রেখে গেছেন।
চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপজেলার চুনতীর বিখ্যাত ডেপুটি বাড়িতে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। চুনতীর ডেপুটি বাড়ি ঐতিহ্যগতভাবে মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে পড়াশোনা ও পাণ্ডিত্য ইত্যাদির ধারক-বাহক হিসেবে এ অঞ্চলে খ্যাত।
১৯৪৫ সালে তিনি মাদ্রাসা ও ১৯৪৭ সালে ইন্টার আর্টস পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫০ ও ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে উক্ত বিভাগ থেকে যথাক্রমে বি.এ (সম্মান) ও এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হন এবং ফাইনাল পরীক্ষার আগে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপসহ এম.এ প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হওয়ায় পরীক্ষা না দিয়ে সেখানে পাড়ি জমান। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেন।
পাকিস্তান সরকার ড. খানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের গভীর যোগাযোগ বিষয়ে অবগত হয় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি বহু কষ্টে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি এড়িয়ে ভারত হয়ে স্থলপথে বাংলাদেশে চলে আসতে সক্ষম হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগটি প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৭-১৯৭৮ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
ড. খান তার ইতিহাসবিদ পরিচয় ছাড়িয়ে জ্ঞানচর্চার আরও বিবিধ ক্ষেত্রে তার মনোযোগ সম্প্রসারিত করেছিলেন। বিশেষ করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, মুসলিম রাজনীতি দর্শন, এক্সপেরিমেন্টাল বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিবর্তন, হাদিসশাস্ত্র ও কোরআনের তাফসির ইত্যাদি বিষয়গুলোতে গুণগতভাবে তার সমকক্ষীয় অবদান রেখেছেন এরকম প-িত বর্তমান বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক পরিসরে খুবই কম পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে, তার রাষ্ট্র দর্শন শাস্ত্রে মুসলিম অবদান : মুকদ্দমা-উপক্রমণিকা (প্রথম খণ্ড) (১৯৭৭), ইসলামে দর্শন চিন্তার পটভূমি (১৯৮০), The Political Crisis of the Present Age: Capitalism, Communism and What Next? (১৯৯০), যুক্তি তত্ত্বের স্বরূপ সন্ধানে : প্রাচ্য বনাম প্রতিচ্য (২০১৩) এবংOrigin and Development of Experimental Science: Encounter with the Modern West (২০২০) প্রতোকটিই নিজ নিজ পরিসরে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ।
ফারাবী-খালদুনের অভিজ্ঞতাবাদী রাজনীতি দর্শনের স্বরূপ চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি তাদের সামগ্রিক দর্শনকে কতগুলো সূত্রে সূত্রবদ্ধ করেন; এগুলোর মধ্যে আল-ফারাবীর পাঁচটি সূত্র সামষ্টিক বিশ্লেষণের রূপ পরিগ্রহ করে অ্যারিস্টটলের পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার ধারণামূলক যুক্তির সঙ্গে অভিজ্ঞতাভিত্তিক কর্মময় যুক্তির সংযোগের মাধ্যমে মানব জীবনের অনুভূতি-চিন্তা-কর্মের তিন স্তরকে বেস্টন করে যুক্তিবিদ্যায় একটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করে এবং ইবনে খালদুনের পাঁচটি সূত্র দ্বারা মানুষের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অণুবিশ্লেষণ মূলে অনুভূতি-চিন্তা-কর্মের সার্বিকতা প্রদান ও চিন্তা-কর্ম চক্রের পৌনঃপুনিক প্রক্রিয়ার সূত্র উদ্ঘাটনের মাধ্যমে যুক্তিবিদ্যায় আরও একটি অধ্যায় সংযোজিত হয়। এর সঙ্গে কালামশাস্ত্রে কারণতত্ত্বের পর্যালোচনাকে আধুনিক ব্যবহারিক বিজ্ঞানের বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কারণতত্ত্বের পর্যালোচনা ও আত্মীকরণকে সংযোগ করে তিনি এ বিষয়ক আলোচনায় নতুন একটি মাত্রা যোগ করেন। তার যুক্তিতত্ত্বের স্বরূপ সন্ধান বইয়ে এসব বিষয়-আশয়ের চমৎকার আলোচনা বিদ্যমান। বাংলা ভাষায় এটিই এখন। পর্যন্ত এ বিষয়ে লিখিত ও প্রকাশিত প্রথম ও সর্বশেষ বই।
এরপর আসা যাক ড. খানের Origin and Development of Experimental Science- এ। বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক পরিসরে বিজ্ঞানের ইতিহাস ও বিজ্ঞান দর্শন চর্চা নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সদ্য ইন্তেকাল করা প্রফেসর ড. গালিব আহসান খান আধুনিক অ্যাংলো-আমেরিকান দুনিয়ার বিজ্ঞান দর্শনের ডমিন্যান্ট ধারাগুলোর প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গবেষণার কথাই উল্লেখ করা যায়; কিন্তু ড. খানের উপরোক্ত বইটি একটি ভিন্ন আঙ্গিকের কাজ। এটিকে পশ্চিমা দুনিয়ার প্রচলিত একাডেমিক অর্থে শুধুই বিজ্ঞান দর্শনের বই বলা যায় না, আবার বিজ্ঞানের ইতিহাসের বই হিসেবে এককভাবে চিহ্নিত করা যায় না; এতে উভয় শাস্ত্রীয় শৃঙ্খলাই সমন্বিত।
এছাড়া হাদীস শাস্ত্র ও এর পদ্ধতিতত্ত্ব, ধ্রুপদী গ্রিক ও চৈনিক দর্শনে তার পর্যালোচনা, ভারতীয় মহাযান বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও বেদের অদ্বৈতবাদী ঐতিহ্য থেকে ইসলামী জ্ঞান প্রকরণের সমতুল চার-প্রস্থীয় জ্ঞান প্রকরণ চিহ্নিতকরণ বিষয়ক আলোচনা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিবিধ শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা দর্শন ইত্যাদি নিয়ে তার প্রবন্ধগুলো ভিত্তিমূলক অনেক আইডিয়া ধারণ করে, যেগুলো আরও ডিটেইলস এক্সপ্লোরেশনের জন্য অপেক্ষমান। একজন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত হিসেবে ভাষা সম্পর্কীয় তার দৃষ্টিভঙ্গিটিও আরও বিস্তৃত গবেষণা প্রকল্পের বিষয় হতে পারে।