
আমীন আল রশীদ
প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলাম শর্ত সাপেক্ষে জামিন পেয়েছেন। অন্যতম শর্ত পাসপোর্ট জমা দিতে হবে। সরকারি অফিস থেকে তথ্য চুরির অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিবের করা অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন।
তবে এই আইনি প্রক্রিয়ার বাইরেও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন ভিডিও ও স্ট্যাটাসে রোজিনাকে চোর সাব্যস্ত করার প্রবণতা শুরু হয়- যাতে অংশ নেন ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতাও। প্রশ্ন হলো, রোজিনা কি আসলেই চোর? তিনি কী চুরি করেছেন?
বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তিনি যে নথিগুলো চুরি করতে চেয়েছিলেন, সেগুলো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ গোপন নথি। যে কারণে তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়। দেশের ইতিহাসে এই মামলায় প্রথম কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা এবং কারাগারে প্রেরণের ঘটনা এটিই।
ফেসবুকে কোনো কোনো সাংবাদিকও লিখেছেন যে, চোর বা চুরি ধরা সাংবাদিকের কাজ নয়। বরং এটা আইন-শৃঙ্খলা বা গোয়েন্দা বাহিনীর কাজ।
বস্তুত পৃথিবীর অনেক বড় বড় অপরাধের খবর সাংবাদিকরাই বের করেছেন। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেনি। বরং সাংবাদিকের রিপোর্টের ওপর ভর করে পুলিশ তদন্ত করেছে। বাংলাদেশেও এরকম উদাহরণ আছে। রোজিনা ইসলামও এ যাবত অনেক বড় বড় দুর্নীতি ও অপরাধের খবর বের করেছেন, যা পুলিশ বের করতে পারেনি বা করেনি; কিন্তু এবার তিনি কেন এই সমস্যায় পড়লেন, সেটি ভাবনার বিষয়। এক্ষেত্রে তার কৌশল হয়তো ভুল ছিল অথবা তিনি ট্র্যাপে পড়েছেন। আসলেই কী ঘটেছিল তা জানা সম্ভব নয়।
তিনি যদি সত্যিই জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ধরা পড়ে থাকেন, তাহলেও তাকে চোর বলার সুযোগ নেই। কারণ অনুসন্ধানী সংবাদের মূল শক্তিই হলো এসব গুরুত্বপূর্ণ নথি। কোন সাংবাদিক কী কৌশলে বা কীভাবে সেই তথ্য বের করে আনবেন, সেটি তার ক্যারিশমার ওপরে নির্ভর করে। তার মতো একজন সাংবাদিক এই দফায় কেন ব্যর্থ হলেন, সেটিই বরং বিস্ময়ের। যদি ওই তথ্যগুলো সত্যিই জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে সেই তথ্য গোপন করাই অপরাধ- যদি না সেখানে রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি বা গোপনীয়তার প্রসঙ্গ থাকে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রথম আলো একটি পেশাদার সংবাদপত্র। সুতরাং রোজিনা ইসলাম যদি এমন কোনো তথ্য বের করে নিয়েও যেতেন, যা প্রকাশিত হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বা রাষ্ট্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শঙ্কা রয়েছে, তাহলে প্রথম আলো ওই তথ্য প্রকাশই করতো না।
তাছাড়া সাংবাদিকের তথ্য সংগ্রহ আর একজন পেশাদার চোরের কাজ এক নয়। বড় কোনো দুর্নীতি বা অপরাধের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক যদি কোনো নথি কৌশলে বের করে আনেন, তারপরও সেটিকে ফৌজদারি অপরাধের কাতারে ফেলার সুযোগ নেই।
এই মামলার এজাহারে ‘প্রকাশ করা যাবে না’ এমন রাষ্ট্রীয় চুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশের জব্দ তালিকায় জেনেভায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দুই পৃষ্ঠার একটি চাহিদাপত্র, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারের পরিচালকের পাঠানো ৫৬ পৃষ্ঠার চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের একটি প্রস্তাবনা, মন্ত্রিসভার জন্য তৈরি করা দুই পৃষ্ঠার একটি ক্রয়সংক্রান্ত প্রস্তাবনা, করোনা টিকা বিষয়ে পরামর্শক কমিটির পরামর্শের দুই পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ ছাড়াও রয়েছে দুটি মোবাইল ফোন ও আইডি কার্ড।
কিন্তু সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে, রোজিনা যে তথ্য চুরি করতে চেয়েছিলেন, সেখানে দুটি দেশ থেকে করোনা টিকা ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তির নথি ছিল, যা প্রকাশিত হলে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি এমন কি দ্বিপক্ষীয় টিকা ক্রয় প্রক্রিয়াও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। যার ফলে দেশবাসী টিকা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারত এবং করোনা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কাজও বিঘ্নিত হতো; কিন্তু এজাহারে বা জব্দ তালিকায় তার উল্লেখ নেই।
সুতরাং জব্দ তালিকার কোনোটিই ‘রাষ্ট্রীয় অপ্রকাশযোগ্য’ চুক্তি নয়। তাছাড়া পুলিশ ওইসব কাগজপত্র জব্দ করেছে অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসার কাছ থেকে। সাংবাদিক রোজিনার থেকে নয়। সুতরাং রোজিনা যে নথিগুলো চুরি করেছিলেন বা করতে চেয়েছিলেন, সেটি এখনো প্রমাণিত নয়। বরং নথিগুলো যদি অতিরিক্ত সচিবের কাছ থেকে পুলিশ জব্দ করে এবং যদি এটি প্রমাণিত হয় যে, নথিগুলো সাংবাদিক রোজিনার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি, তাহলে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী ওই অতিরিক্ত সচিবের বিরুদ্ধেই মামলা হবে। যদিও এটির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ঘটনাটি ঘটেছে বিকেল ৩টার দিকে। জব্দ তালিকা হওয়ার কথা তখনই; কিন্তু জব্দ তালিকা হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। আইন অনুযায়ী যার কোনো সুযোগ নেই। পুলিশ কাগজপত্র জব্দ করেছে অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসার কাছ থেকে, সাংবাদিক রোজিনার থেকে নয়। ফলে জব্দ তালিকা রোজিনার বিরুদ্ধে মামলায় ব্যবহারের সুযোগ নেই।’
মামলার এজাহার ও রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, ‘নথিপত্র রাষ্ট্রীয় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় দলিল।’ প্রশ্ন হলো, তথ্য যদি এতই গোপন হয়, তাহলে সেটি কী করে স্বাস্থ্য সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে এমনভাবে থাকল, যে একজন সাংবাদিক ভেতরে ঢুকেই সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে পারলেন বা সেই কাগজ নিজের ব্যাগে ভরে ফেললেন? বরং যদি ওই নথি বা ডকুমেন্ট এতটাই গোপনীয় হয়ে থাকে যে, এই তথ্য প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বা কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হবে, তাহলে সেই তথ্য বা নথির সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতার দায়ে তো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হওয়া উচিত। কারণ তারা অফিসের সিক্রেসি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
শুধু তাই নয়, রোজিনা ইসলামকে ‘তথ্য চোর’ আখ্যা দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ তারাই আবার অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেছাকে নিয়ে যাতে সংবাদ প্রকাশ করা না হয়, সেই অনুরোধ করেছে। কারণ এতে নাকি তার সম্মানহানি হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, জেবুন্নেছাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে যদি তার সম্মানহানি হয়, তাহলে একজন সাংবাদিককে চোর সাব্যস্ত করার যে রাষ্ট্রীয় আয়োজন, তাতে তার এবং পুরো সাংবাদিক সমাজের সম্মানহানি হয় না?
মনে রাখতে হবে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামই মন্ত্রণালয়ের শত শত কোটি টাকা দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেছেন। নিয়োগে এক কোটি টাকা ঘুষ প্রস্তাবের সংবাদ প্রকাশ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চাকরি করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির সংবাদও রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধান। এইসব খবর পেতে তাকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহ করতে হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এইসব তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই রোজিনা ইসলামকে সরবরাহ করেছেন। তাহলে কি তার ওই তথ্য সংগ্রহকে চুরি বলা হবে? সেক্ষেত্রে যারা রোজিনাকে তথ্য দিয়েছেন, তারাও চোরের সহযোগী। এবারও রোজিনার বিরুদ্ধে যেসব তথ্য চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই তথ্যও নিশ্চয়ই মন্ত্রণালয়ের কেউ না কেউ তাকে দিয়েছিলেন। সুতরাং মামলা যদি হতেই হয়, তাহলে তো মন্ত্রণালয়ের লোকজনের বিরুদ্ধেও মামলা করা উচিত।
মোদ্দা কথা, একজন সাংবাদিকের তথ্য সংগ্রহ আর অন্য পেশার একজন মানুষের তথ্য বা নথি সংগ্রহের প্রক্রিয়া যেমন এক নয়, তেমনি তাদের উদ্দেশ্যও এক নয়। সুতরাং এই তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে ‘তথ্য চুরি’ বলার সুযোগ নেই। বরং মন্ত্রণালয়ের চুরি ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশে যারা রোজিনার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন, তারাই এটিকে চুরি বলার চেষ্টা করছেন। এ কারণেই বোধ হয় বলা হয়, চোরের মায়ের বড় গলা।
জনগণের করের পয়সায় রাষ্ট্র কীভাবে চলছে; তাদের পয়সা কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে; গণকর্মচারীরা কী করছেন- তা জানা প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার। আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় বড় কোনো অন্যায়ের খবর জনগণকে জানানো গণমাধ্যমকর্মীরা। সংবিধান ও আইনও সাংবাদিককে সেই অধিকার দিয়েছে।
২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনে পরিষ্কার বলা আছে যে, ‘কোনো তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায়, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করিতে পারিবেন। আইনে এও বলা আছে যে, তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস করিবার যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকিলেও তিনি যদি এরূপ বিশ্বাস করেন যে, তথ্যটি সত্য হইতে পারে এবং তথ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া উহার সত্যতা যাচাই করা সমীচীন, তারপরও তিনি এই তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন।’
তার মানে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে সাংবাদিকের কোনও আইনি বাধা নেই। যদি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে বড় বড় দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হবে না। মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ক্রেস্টে ভেজাল সোনা, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে বছরের পর বছর চাকরি করা, মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়ার মতো খবরগুলো আড়ালেই থেকে যেতো।
সুতরাং দেশ ও মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব তথ্যই একজন সাংবাদিক যেভাবেই হোক, যে কোনো কৌশলেই হোক সংগ্রহ করার অধিকার রাখেন। তার এই কৌশলকে অপরাধ বা চুরি বলে বিবেচনা করে মামলা দেওয়ার এখতিয়ার কোনো সরকারি কর্মকর্তার নেই।