
গাজী তানজিয়া
২৯ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। উনিশ শতকে ইংরেজ শাসকের দুঃশাসন ও জমিদার শ্রেণি আর মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক-সংগ্রাম পুরো জাতির সামনে এক নতুন সংগ্রামী ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল, যাকে ভারতের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিভূমি বলা চলে। ব্রিটিশ শাসনকালে যে সমস্ত কৃষক বিদ্রোহী হয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ বা খেরওয়ারি হুল বিদ্রোহ।
১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ ও ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ- এই উভয় সংগ্রামই শুরু হয়েছিল ইংরেজ শাসনের কবল থেকে, ইংরেজ শাসকের দেশীয় তাঁবেদার জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ধ্বনি নিয়ে।
সাঁওতালদের পূর্বকথা : ভারতের আদিবাসী জনজাতিগুলোর মধ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী হলো অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী। ডালটন সাহেবের মতে, সাঁওতালরা বীরভূম অঞ্চলে আসে পূর্ব এবং পশ্চিম দিক থেকে। তারা এসেছিল মূলত চাষবাস ও শিকারের উদ্দেশ্যে। হিন্দু অগ্রগতির চাপে তাদের সমতলভূমি ছেড়ে পার্বত্য অঞ্চলে সরে আসতে হয়। সাঁওতালরা মূলত বৃহৎ দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর একটি উপজাতি এবং ভাষাগত দিক থেকে ‘কোলারিয়ান’ শ্রেণির।
দামিন-ই-কোহর ইতিবৃত্ত : দামিন-ই-কোহ একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ হলো পর্বতের পাদদেশ। এই অঞ্চল বর্তমানে সাঁওতাল পরগণা নামে পরিচিত। বুকানন হ্যামিল্টনের অপ্রকাশিত দলিল থেকে জানা যায় যে, বীরভূম রাজাদের অত্যাচারের ফলে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সাঁওতালরা বীরভূম ত্যাগ করেন এবং গোদ্দা মহকুমা অঞ্চলের বনাঞ্চল পরিষ্কার করে বসবাস আরম্ভ করেন। ১৮৩৬ সালের মধ্যে এইস্থানে প্রায় ৪২৭টি সাঁওতালি গ্রাম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক-ই (১৮২৮-১৮৩৫) সরকারিভাবে রাজমহলের পশ্চিমদিকের জঙ্গল সাফ করে বসবাসের জন্য সাঁওতালদের আহ্বান জানায়। ১৮৫১ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের তাদের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজারে। এ জন্য অবশ্য ইংরেজ সরকারকে রীতিমতো রাজস্ব দিতে হতো তাদের। ১৬/১৭ বছরের মধ্যে ভয়ংকর হারে এই খাজনার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল।
কোম্পানির অত্যাচার, জোরজুলুমের সহযোগী ছিল জমিদার এবং মহাজনরা। সমসাময়িক এক ইংরেজ লেখকের বর্ণনা থেকে জানা যায় মহাজনদের সুদের হার ছিল ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে শস্য, গবাদি পশু, এমনকি নিজে কিংবা নিজের পরিবারের সদস্যকে আজীবন বিকিয়ে দিতে হয়েছে।
কঠোর পরিশ্রম করেও হাতে কোনো অর্থ থাকত না সাঁওতালদের। চাষের সময় বীজ কিনতে উচ্চ সুদে ধার করা ছাড়া উপায় থাকত না এদের। কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই মহাজন, জমিদার আর পাওনাদারেরা হানা দিত। উৎসব-আনন্দে কিংবা আগামী বছর আবারও মাঠে ফসল ফলিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ধার-দেনা করতে হয় তাদের। এমনই দুষ্টচক্রে পড়ে কখনো ঘরবাড়ি, কখনো নিজের গবাদিপশু, কখনো নিজেকেই বিকিয়ে দিতে হয় পাওনাদারের কাছে।
১৮৪৮ সালের দিকে মহাজনদের জ্বালায় দামিন-ই-কোহ এলাকার তিনটি গ্রামের সাঁওতাল পরিবার দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাদের এ অবস্থা দেখে ভগনাডির নারায়ণ মুরমুর দুই ছেলে সিধু ও কানু বসে থাকতে পারলেন না। অত্যাচারের এই অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন দুই ভাই।
সশস্ত্র বিদ্রোহ : সিধু ও কানু জানতেন সাঁওতাল রাজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তাদের অবস্থার মুক্তি হবে না। আর এই মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রয়োজন। তারা সরাসরি বিদ্রোহের ডাক না দিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিলেন। তারা এলাকার লোকজনদের জমায়েত করে ঘোষণা করলেন তাদের চার ভাইকে ঠাকুর জিউই স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে নির্দেশ দিয়েছেন অন্যায়-অত্যাচারী জোতদার, মহাজন, জমিদারদের উৎখাত করে সাঁওতাল রাজ্য কায়েমের জন্য। সাঁওতাল আদিবাসীসহ মুক্তিকামী জনতার মধ্যে এই ঘোষণা সঞ্চালিত হলো। তারা মানসিকভাবে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।
আলোচনার জন্য ভগনাডিহ গ্রামে সাঁওতালরা সমবেত হলে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন একসঙ্গে সবাই শিকারে বেরুবে। পরের দিন সিধু, কানুর নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন সাঁওতাল যুবক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শিকারে যাওয়ার পথে দারোগা মহেশ দত্ত, দুই জন সিপাই ও কয়েকজন মহাজনের সামনে পড়ে। দারোগার সঙ্গে দুইটি দড়ি বোঝাই গাড়িও ছিল। এক পর্যায়ে বিদ্রোহী সিধু, কানুর সশস্ত্র দল ঘটনাস্থলে দারোগা মহেশ এবং কানু মানিক রায় নামের মহাজনকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর ভোগলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি লোকজনসহ অত্যাচারী জমিদার মহাজন অনেকে সাঁওতালদের হাতে নিহত হতে থাকে। ১৮৫৫ সালে ১৭ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানানো হয়। বিদ্রোহীরা সরকারের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। সরকার সেনাবাহিনী মাঠে নামায় এবং তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে শত শত বিদ্রোহীকে হত্যা শুরু করে। একদিকে কামান-বন্দুক, অপর দিকে তীর-ধনুকের লড়াই। কয়েক দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী ভগনাডিহ গ্রাম ধ্বংস করে দেয়।
সিধু, কানুর বাড়িসহ গ্রামের সকল বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কানু সঙ্গীদের নিয়ে হাজারীবাগ অভিমুখে পালাবার সময় জারয়ার সিং নামক ব্যক্তির তৎপরতায় ১৮৫৫ সালের ৩০ নভেম্বরে ধরা পড়ে। শেষে কানুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, লুণ্ঠন, অত্যাচার ও হত্যার অভিযোগে ১৮৫৬ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি স্পেশাল কমিশনার এলিয়টের এজলাসে বিচার হয়। বিচারে কানুকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই বিদ্রোহে ৩০ হাজার আদিবাসী প্রাণ হারান।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসের এক অগ্নিঝরা অধ্যায়। যে ধরনের শাসন, শোষণ এবং উৎপীড়ন থেকে পরাধীন জাতির চেতনায় স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে ১৮৫৫ সালে সংঘটিত এই বিদ্রোহ সেই অত্যাচারের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘটিত প্রতিবাদ। বিদ্রোহের এই আগুন সে সময় বিহার, উড়িষ্যা এবং বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
সাঁওতালদের পরাজয় হলেও, বৈদেশিক শাসন এবং দেশিও সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষণের মূলোৎপাটন করার লক্ষ্যে পরিচালিত এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষের মানুষের মনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারের চেতনা জাগ্রত করেছিল।