Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

রাজনীতিক-আমলা নায়ক-ভিলেন প্রসঙ্গ

Icon

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২১, ১৪:২৭

রাজনীতিক-আমলা নায়ক-ভিলেন প্রসঙ্গ

শেখর দত্ত, কলাম লেখক ও রাজনীতিক। ফাইল ছবি

‘সরকারি কর্মচারীরা যদি জনস্বার্থের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারেন, তাহলে প্রয়োজনবোধে খোলনলচে সবই বদল করতে হবে।’ এমনটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ‘তাদের আপনি কী দিয়েছেন, কতটুকু দিয়েছেন, কী ফেরত দিচ্ছেন, কতটুকু দিচ্ছেন’ প্রশ্ন তুলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমলাদের উদ্দেশ্যে এমনটাও বলেছিলেন, ‘আপনার মাইনা দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত দিয়ে কথা বলেন।.. সমাজে যেন ঘুণে ধরে গেছে।’ এই কথা বলে তিনি রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে ‘এক হাতে তালি বাজে না’ মন্তব্য করে দলীয় কর্মীদের ‘অফিসারদের কাছে ঘুরাঘুরি না করা’র আহ্বান জানিয়েছিলেন।

এরপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলী দিয়ে বছরের পর বছর অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। প্রশাসনকে পাকিস্তানীকরণ-সামরিকীকরণ করা, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ও ‘রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য ডিফিকাল্ট’ করার সর্বাত্মক কর্মকাণ্ড দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। যে দেশের জন্মলগ্নের অঙ্গীকার ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা তার ক্রমাবনতি প্রত্যক্ষ করেছে সবাই। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক কর্মসূচিও পরিবর্তিত হয়েছে। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু প্রণীত জাতীয় চারনীতি ও আওয়ামী লীগের ঘোষণা ও কর্মসূচি মতো দেশের সংবিধান নেই।

এতসব পরিবর্তন সত্ত্বেও যা এখনও সত্য হয়ে আছে, তা হলো আমলা ও রাজনীতিকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত কথাগুলো। এ জন্যই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসনের ‘দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সর্বপ্রকার হয়রানির’ অবসান ঘটিয়ে ‘ নিয়মানুবর্তী এবং জনগণের সেবক’ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ অগ্রসর করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের পর আড়াই বছরেরও বেশি সময়ে এ ব্যাপারে কতটুকু কী হয়েছে? দেশের শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে জনগণ, যাদের সরকারি অফিসে যেতে হয়, তারাই জানেন, অঙ্গীকার অনুযায়ী কতটুকু কার্য সম্পাদন হয়েছে। 

আর রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আমলাদের কাছে ঘুরঘুর তার যে বাড়বাড়ন্ত, এটা নিতান্ত অন্ধ কিংবা ‘পাগল ও শিশু’ ছাড়া সবারই স্বীকার করতে হবে। ২৩ জুন ২০২১ বিবিসির এক প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেত্রী জিনাত সোহানা চৌধুরীসহ নাম উল্লেখ না করে বিভিন্ন জেলার নেতাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘কিছু পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত রয়েছে দলের একটি অংশ। অনেক এলাকায় মন্ত্রী ও এমপিকে ঘিরে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তারা এলাকার উন্নয়নসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। ব্যক্তিস্বার্থ বা সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রশাসন যখন সামনে আসছে, তখন মাঠের নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।’ 

গ্রাম-গঞ্জে যাদের যোগাযোগ রয়েছে, তারাই বলবেন কোথাও কোথাও ব্যতিক্রম হলেও এই রিপোর্টের সত্যতা রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি এলাকায় এলাকায় দলের উল্লিখিত গোষ্ঠীর সঙ্গে আমলাদের অশুভ-অনৈতিক সখ্যর সম্পর্ক গড়ে না উঠতো, তবে উন্নয়নসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ উঠতো না। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, একদিকে দেশের ইতিহাসে প্রথম ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন চলছে আর অন্যদিকে আমলা-রাজনীতিক অশুভ-অনৈতিক সখ্যর ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা মাসতুতো ভাইরা গলায় গলায় এক হয়ে ভালোই কামিয়ে নিচ্ছেন। তবে সখ্য-গলাগলি যেখানে রয়েছে, সেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্বে টানাপড়েন ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকাটা অনিবার্য। ধারণা করা যায়, সব টানাপড়েন মিলিয়ে বর্তমান পর্যায়ে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়ে আছে এলাকায় এলাকায়, তারই প্রতিফলন ঘটেছে সম্প্রতি আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশের ভেতর দিয়ে।

বিগত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনায় বর্ষিয়ান ও অভিজ্ঞ জননেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংসদে ‘এমন একজনও নেই যিনি এই করোনাকালে নিজস্ব অর্থায়নে বা যে-ভাবেই হোক গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। .. আমাকে মাফ করবেন, কথা বলাটা কতটুকু যুক্তিসংগত জানি না। এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দেই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেয়। অথচ যারা প্রশাসনিক কর্মকর্তা, তারা কিন্তু যায়ইনি। .. এটা ঠিক না। একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’ সাবেক আমলা ও পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নানের ‘ফেরাউনের সময়ও আমলা ছিল’ মন্তব্যের সমালোচনা এবং ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে কর্মীরা আসতো। মন্ত্রীরা গ্রামগঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।’

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সাংসদরা সচিবদের ওপরে। আওয়ামী লীগ নেতার আলোচনার পর জাতীয় পার্টি, বিএনপি, গণফোরাম সাংসদরা এর পক্ষে কথা বলেন। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, উচ্চ পর্যায়ের আমলা বা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যে জনগণের সংযোগ নেই, তারা যে ফাইল দেখে নির্দেশ দিয়ে কাজ করেন, জনমতের তেমন তোয়াক্কা করে না প্রভৃতি কথাগুলো যথার্থ। সরকার যে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, দল যে প্রায় নিষ্ক্রিয় তা সংসদে আলোচনার আগেও প্রচার মাধ্যমের আলোচনায় এসেছে। তবে জেলার মন্ত্রীদের পুনরায় জেলার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি ফিরিয়ে আনা নিয়ে কোনো প্রস্তাব আগে শোনা যায়নি। বাতিল হওয়ায় ক্ষতি কতটা হয়েছে, তা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন; কিন্তু কোন আমলে এই প্রথা হয়েছিল আর কোন কোন যুক্তিতে পরে বাতিল হলো, তা, যদি সাবেক মন্ত্রী তোফয়েল আহমেদ বলেন, তবে এই ইস্যুতে জনমত গড়ে তোলা সহজ হবে বলে মনে হয়।

এটা কার না জানা যে, করোনা দুর্যোগে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলে ‘একটি লোককেও না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না’ এবং ‘ত্রাণ বিতরণে যে কোনো দুর্নীতির’ বিরুদ্ধে হুঁশিয়রি ঘোষণা দিয়ে ১৫ এপ্রিল ২০২০ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রশাসনের সঙ্গে সহায়তা- সমন্বয় করে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা, ওয়ার্ড পর্যায়ে ত্রাণ কমিটি গঠন, তা সাংগঠনিক জেলা শাখায় জমা দেওয়া এবং দল-মত নির্বিশেষে দরিদ্র দুস্থ অসহায়দের তালিকা করা প্রভৃতি তিনটি নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওয়ার্ড, উপজেলা, জেলা ভিত্তিতে ত্রাণ কমিটি কতটুকু গঠিত হয়েছে, এখনও কাজ চালু আছে কি না, প্রশাসন সহযেগিতা করছে কি না, প্রশাসন সহযোগিতা না করার বিষয়ে কোনো অভিযোগ আছে কি না প্রভৃতি অবশ্য তেমনভাবে জানতে পারা যায় নাই।

তবে এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, যদি কমিটি গঠন করে প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ মাঠে নামে তবে প্রশাসন নয়, আওয়ামী লীগই সামনে আসবে। আর বিচ্ছিন্ন কোনো দুর্নীতির ঘটনা যদি ঘটে, তবে অভিযোগের সোরগোল উঠবে, ত্রাণ চুরির মহোৎসব চলছে। এক্ষেত্রে বলতেই হয়, ব্যতিক্রম বাদে তৃণমূলের প্রশাসনও তো আর ধোয়া তুলসীপাতা নয়। যতটুকু মনে হয়, অভিজ্ঞতা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দল ও প্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে ত্রাণ যাতে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয়, সেই প্রচেষ্টা নিতেই উপরোক্ত তিনটি নির্দেশ দলকে দিয়েছিলেন।

দল সক্রিয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়িত করতে পারছে কি না, এটাই এখন বড় প্রশ্ন! দল যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, যদি দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবে আমলাতন্ত্র তো শূন্যতার সুযোগ নিবেই। মনে হয় বাস্তবে এমনটাই হচ্ছে। প্রসঙ্গত, কোম্পনিগঞ্জের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদেরের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা কাদের মির্জা বলেছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিরা নির্বাচিত হওয়া দূরে থাক, পালানোর দরজাও খুঁজে পাবে না।’ ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা সাঈদ খোকন প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে মেয়র ফজলে নূর তাপস ‘কতটুকু ভোটে নির্বাচিত’, ‘কত ভোট পেয়েছেন’ প্রভৃতি প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগ দলের নেতারাই যদি দলকে ‘ভিলেন’ বানায়, তবে আমলাতন্ত্র তো ‘নায়ক’ হবেই। 

পাকিস্তানি আমলে আমাদের জাতীয় অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এটা বলা যায় যে, প্রকৃতিতে কৃত্রিম কোনো কিছু টিকিয়ে রাখতে যেমন প্রয়োজন হয় বাইরের শক্তির; ঠিক তেমনি পাকিস্তানি শাসক- শোসকরা রাজনীতির মূল শক্তি গণশক্তির চাইতে সামরিক- বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই গণশক্তির ক্ষমতায়ন করতে জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু প্রথম সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন; কিন্তু যখন পরিষ্কার হয়ে যায়, সংসদীয় গণতন্ত্র অপব্যবহার করেই পরাজিত দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদী দল- গোষ্ঠী-মহল জাতীয় ও গণস্বার্থের চরমতম ক্ষতি করছে, তখন তিনি তখনকার সমাজতন্ত্র- ধনতন্ত্র যুগের বিশ^বাস্তবতায় সমাজতন্ত্র অর্থাৎ দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে রাজনৈতিক ও সামাজিক দল-শক্তি-ব্যক্তি এবং সামরিক- বেসামরিক প্রশাসনকে সমন্বিত করতে একদল গঠন করেন।

ফলাফল আমাদের জানা এবং একদল গঠনের সমালোচনা এখনও আওয়ামী লীগকে বহন করতে হচ্ছে। রাজনীতির ইতিহাসের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, রাষ্ট্রের মূল তিন স্তম্ভ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ, যার যার সুনির্দিষ্ট কাজ যদি কেউ না করে বা করতে দেওয়া না হয়, একে যদি অন্যের দায়িত্ব পূরণ বা দখল করে, অসঙ্গতি যদি থাকে; তবে অঘটন-বিপদ-বিপর্যয় অনিবার্য। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যখন জাতি পালন করছে, দেশ যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে; তখন যদি রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে পর্বতপ্রমাণ অসঙ্গতি বাসা বাঁধে, তবে সেইসব অসঙ্গতি আজ দূর করা একান্ত প্রয়োজন।

-কলাম লেখক, রাজনীতিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫