Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ঢাকাইয়া সোব্বাসীদের কথ্য ভাষা ‘ঢাকাইয়া উর্দু’ নয়

Icon

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২১, ১৩:৫৪

ঢাকাইয়া সোব্বাসীদের কথ্য ভাষা ‘ঢাকাইয়া উর্দু’ নয়

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু

বাংলার সুবাদার ইসলাম খাঁ চিশতী ১৬১০ সালে যখন ঢাকায় পদার্পণ করেন, তখন তার সঙ্গে অসংখ্য উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়, আফগান, ইরান-আরবি তথা বহিরাগত মুসলমান ও হিন্দু ঢাকায় এসেছিল এবং এই আগমন পরবর্তী আরও প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলমান ছিল। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠী বর্তমান পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এদের বংশধররাই বর্তমানে পুরনো ঢাকার আদি অধিবাসী।

আনিস আহামেদ ‘ঢাকা আসলি’ গ্রন্থে এই আদি অধিবাসীদের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘তাদের বংশধর যে ভাষায় কথা বলত, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা করত এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলত, তাকে এক কথায় ঢাকার হিন্দুস্তানি ভাষা ও হিন্দুস্তানি লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়’।

১৬১০ সাল থেকেই ঢাকায় বসবাসকারী সব উচ্চপদস্থ-নিম্নপদস্থ পরিবারগুলোর মধ্যে আরবি, ইংরেজি, গুজরাটি, তুর্কি, পালি, পর্তুগিজ, ফরাসি, ফারসি, মুণ্ডা, সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দুস্তানি (উর্দু, হিন্দি) ভাষার মিশ্রণে নতুন এক মিশ্রিত কথ্য ভাষার প্রচলন শুরু হয়; যা এখনো ঢাকার আদি অধিবাসীদের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা। পুরনো ঢাকার অসংখ্য আদি অধিবাসী এই ভাষায় পরিবারে, সমাজে, হাট-বাজারে, সামাজিক অনুষ্ঠানে কথাবার্তা বলেন। তবে ঠিক কতসংখ্যক মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন তার হিসাব কখনো করা হয়নি; হয়তো কেউ এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেননি। এই মিশ্রিত ঢাকাইয়া ভাষাকে বর্তমানে আদি ঢাকাইয়ারা ‘সোব্বাসী’ ভাষা বলেন এবং নিজেদেরকে ‘সোব্বাস/সোব্বাসী’ বলে পরিচয় দেন।

সুখে বাস করা বা সুখবাস শব্দ থেকে ‘সোব্বাস’ শব্দের উৎপত্তি। সোব্বাস ঢাকাইয়ারা ‘সুখ’ কে বলেন ‘সোখ’। সুখবাস থেকে সোখবাস আর তা থেকে সোব্বাস। অর্থাৎ সোখবাস>সোববাস>সোব্বাস>সোব্বাসী। ঠিক যেমন ‘চাঁদনী ঘাট’ থেকে ‘চান্নিঘাট’, ‘রায় সাহেব বাজার’ থেকে ‘রাসাবাজার’, ‘শেখ সাহেব বাজার’ থেকে ‘সিকসাবাজার’ বা মুণ্ডা ভাষার শব্দ ‘বইনটি’ সোব্বাসীতে ‘বায়ঠি’, ফারসি ‘তখৎ’ সোব্বাসীতে ‘তাক্তা’ হয়ে গেছে সেভাবেই সোখবাস হয়ে গেছে সোব্বাস। ভাষার এই পরিবর্তন ও মিশ্রণ ১৬১০ সাল থেকেই চলমান ছিল। 

ঢাকার কথ্য ভাষার মিশ্রণ প্রসঙ্গে ড. কানিজ-ই-বাতুল বাংলাপিডিয়ায় লিখেছেন, ‘আঠারো শতকে ঢাকা চাল ব্যবসায়ের কেন্দ্র ছিল এবং ব্যবসায়ীরা ছিলেন মাড়োয়ারি। তাঁরা বাংলাভাষী চাল বিক্রেতাদের সঙ্গে হিন্দুস্তানি বা রিখতা ভাষায় কথা বলতেন। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সভা ও কোর্ট-কাছারিতে হিন্দুস্তানির ব্যবহার প্রচলিত ছিল’। 

অর্থাৎ ১৬১০ সাল থেকেই ঢাকায় সব শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে মিশ্রিত হিন্দুস্তানি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং তা আরো পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে কথ্য সোব্বাসী ভাষায় পরিণত হয়েছে।

তবে পুরনো ঢাকার কিছু কিছু পরিবার; বিশেষ করে ঢাকার শিয়া সম্প্রদায়ের পরিবার, মাজারকেন্দ্রিক পরিবার, নবাব খাজা আব্দুল গণির পরিবার ‘ঢাকাইয়া উর্দু’ ভাষা ব্যবহার করতেন বা এখনো করেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে, খাজাদের পারিবারিক কথ্য ভাষা ছিল ‘কাশ্মীরি’ ভাষা। 

ড. কানিজ-ই-বাতুলের মতে, ‘উর্দু সাহিত্যের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে দিল্লি, লক্ষনৌ ও লাহোর কেন্দ্রের ন্যায় এক সময় বাংলার কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’ ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে ঢাকার মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যম ছিল ঢাকাইয়া উর্দু বা উর্দু। মির্জা জান তাপিশ (?-১৮১৪), আগা আহমাদ আলী ইস্পাহানি (১৮৩৯-১৮৭৩), খুজিস্তা আখতার (১৮৭৪-১৯১৯), মুনশি রহমান আলী তায়েশ (১৮২৩-১৯০৮), সৈয়দ মুহম্মদ আযাদ (১৮৫০-১৯১৬), হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭), নবাব খাজা আহসানউল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১) প্রমুখ ঢাকায় ‘ঢাকাইয়া উর্দু’ ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছেন- পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, নাটক লিখেছেন; কিন্তু এই ঢাকাইয়া উর্দু ভাষা কখনই তৎকালীন পুরনো ঢাকার ব্যাপক জনগোষ্ঠীর প্রচলিত কথ্য ভাষা ছিল না। এটি ছিল তৎকালীন অভিজাত মুসলমান শ্রেণির প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা।

এ প্রসঙ্গে ড. কানিজ-ই-বাতুল বলেন, ‘বাংলাদেশের মুসলিম অভিজাত শ্রেণির প্রায় সবাই উর্দু বলতে সক্ষম ছিলেন।’ এই ‘ঢাকাইয়া উর্দু’ ভাষা আর কখনোই পুরনো ঢাকার সকল শ্রেণির সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা হয়ে ওঠেনি।

সোব্বাসী কথ্য ভাষার সঙ্গে ঢাকাইয়া উর্দু ভাষার পার্থক্য পূর্বেও ছিল, এখনো আছে। এই পার্থক্য শব্দে, শব্দের উচ্চারণে বিদ্যমান। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি হয়তো পরিষ্কার হবে :

বাংলা : আমি ভাত খাবো।
সোব্বাসী : মায় ভাত খাঙে।
ঢাকাইয়া উর্দু : মেঁয় ভাত খায়ুঙ্গা।
বাংলা : আমি ঢাকায় থাকি।
সোব্বাসী : মায় ঢাকামে রাহেতে।
ঢাকাইয়া উর্দু : মেঁয় ঢাকামে রাহেতাহু।
বাংলা : আমাদের বাসায় তোমাদের নিমন্ত্রণ।
সোব্বাসী : হামোকা বাড়িমে তোমোকা দাওয়াত।
ঢাকাইয়া উর্দু : হামলোগকা ঘারপে তুমলোগকা দাওয়াত।

তাছাড়া ঢাকাইয়া উর্দু নাস্তালিক লিপি বা উর্দু বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখা হতো; কিন্তু সোব্বাসী ভাষা কখনোই কোনো বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখা হয়নি। তবে ইদানীং বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে সোব্বাসী ভাষায় লেখালেখি হচ্ছে এবং ১৫ জানুয়ারি ২০২১ ‘বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি’ নামে সোব্বাসী অভিধান প্রণীত হয়েছে।

এখানে একটি কথা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে হয়; আর তা হলো- ১৯৪৭ সালে যে সকল মুসলমান জনগোষ্ঠী ভারতের বিহার পাটনা থেকে পুরাতন ঢাকায় এসে বসতী স্থাপন করেছিলেন, যারা ঢাকায় ‘বিহারি’ নামে সুপরিচিত, তারা বিহারের উর্দু ভাষায় কথাবার্তা বলেন।

বর্তমানে ঢাকায় সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার, লালবাগ থানার অন্তর্গত বিভিন্ন মহল্লায় সোব্বাসীরা বসবাস করছেন। তবে এটা ঠিক যে, সঠিকভাবে না জানালে সোব্বাসী ভাষাকে ঢাকাইয়া উর্দু, বিহারি উর্দু বা উর্দু-হিন্দির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার আশঙ্কা বিদ্যমান।

নির্দেশিকা :

আনিস আহামেদ- ঢাকাইয়া আসলি, ঢাকা ২০১৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ।

ড. কানিজ-ই-বাতুল- উর্দু ঢাকা ২০১৪ বাংলাপিডিয়া ইলেকট্রনিক সংস্করণ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।

লেখক- প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থকার

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫