
মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম
স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানুষ হয়েও, ইংরেজের করা অমানবিক কিছু আইন আজও কাঁধে চেপে বসে আছে আমাদের। আইনগুলো যে সবই সাংবিধানিক, তা নয়। অনেক আইন আছে, যা আইন পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত নয়; কিন্তু প্রথার মতো রাষ্ট্রে প্রচলিত। চারিত্রিক সনদপত্র সেসবের মধ্যে একটি। সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে, সরকারি চাকরি করতে গেলে চারিত্রিক সনদপত্র অপরিহার্য। কিন্তু চাকরির দরখাস্তের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের সঙ্গে চারিত্রিক সনদপত্র দিতে হবে এটি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ। চাকরির ক্ষেত্রে এই সনদপত্র যেন এক অপরিহার্য অঙ্গ।
চাকরি যেহেতু দরকার, কাজেই নিরুপায় হয়ে এই সনদপত্র যুক্ত করা হয়; কিন্তু চাকরি প্রার্থীর ভেতরে থাকে এক ধরনের ক্ষোভ, দুঃখ ও গ্লানি। বুদ্ধিমান, বিবেচক ও যুক্তিমন্ত তরুণের পক্ষে এই আরোপিত অন্যায় মেনে নেওয়া কঠিন। যদিও চাকরি ক্ষেত্রের বিপুল প্রতিযোগিতার মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে অতি বড় নীতিবাদী ও বিপ্লবীর পক্ষেও সরকারের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু কেন এই চারিত্রিক সনদপত্র? এর প্রয়োজনীয়তা কী? সরকারের দিক থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, তা হলেও কী এর ন্যায্যতা আছে? একজন চাকরি প্রার্থীর চরিত্র ভালো কী মন্দ, তা নির্ণয় করবার জন্য এই সনদপত্র কী মোক্ষম অস্ত্র? তবে এর দরকার কেন? ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ছিল, অতএব বাংলাদেশেও চলুক! মজার সংবাদ এই যে, সরকারি অফিসের সবচেয়ে নিম্নপদের থেকে অতি উচ্চ পর্যায়ের চাকরিতে পর্যন্ত এই সনদপত্র হাজির করতে হয়। এটি যে একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং অপ্রীতিকর বিধান- যিনি প্রদান করেন তার পক্ষেও, যিনি গ্রহণ করেন তার পক্ষেও- এই বোধ-বিবেচনা কোথাও দেখা যায় না!
চাকরি প্রার্থীকে তার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য এমনিতেই অনেক প্রমাণপত্র হাজির করতে হয়। নানা স্তরের পরীক্ষায় পাশের প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট তো আছেই; এ ছাড়াও ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অথবা পৌর প্রধানের কাছ থেকে গৃহীত নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র, নানা সাইজের ছবি, ইদানীং এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র। তার ওপর চারিত্রিক সনদপত্রের মতো একটি বাড়তি ও অনাবশ্যক প্রমাণপত্র দরকার হবে কেন? এখানেই তো শেষ হয় না ব্যাপারটা। প্রার্থীর চাকরি হয়ে গেলে তার দেওয়া তথ্য এবং তার সম্পর্কে ভালো-মন্দ যাচাইয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বও থাকে। এই যাচাই পর্বটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’। চাকরিপ্রাপ্ত ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে যুক্ত কি-না, তার নামে কোনো মামলা-মোকদ্দমা আছে কি-না, রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কি-না, এমনকি সমাজে তার কাছের আত্মীয়দের বিরুদ্ধে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরুদ্ধ কোনো নালিশ আছে কি-না, সেগুলোও তো যাচাই হয়ে থাকে। দেখা যায়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের আগেই এই ভেরিফিকেশন হয়ে থাকে। চাকরির মাঝপথেও অবশ্য এটি হয়। এই তদন্তের কারণে অনেক সময় শুধু চাকরি নয়, চাকরি প্রার্থীর জীবনটাই বিপন্ন হয়ে ওঠে। এটি কতটা ভয়ানক ব্যাপার, যে এর শিকার হয়নি, তাকে বোঝানো কঠিন। ভাষার ঝুঁকি নিয়ে তবুও কিছু বলার চেষ্টা করা যাক।
সামাজিক মানুষের মন বড় জটিল। পারিবারিক বন্ধনেও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সব সময় মধুর সম্পর্ক থাকে না। ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, পিতা-পুত্রে মনোমালিন্য কোন পরিবারে নেই? সংসারে মতান্তরও আজ এক নিত্যকার ঘটনা। যেখানে স্বার্থ অন্ধ হয়, সেখানে বিবাদ অনিবার্য। দেখা যায়, চাচা-জ্যাঠাদের সঙ্গেও জমিনের সীমানা নিয়ে কলহ বাঁধে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেবার সামর্থ্য-অসামর্থ্যে বাপ-চাচার সন্তানের মধ্যে হেরফের হতেই পারে; কিন্তু এর ফলে সেখানে পরশ্রীকাতরতার মতো হিংসাত্মক ব্যাধিও গোপনে বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় চাকরির তদন্তের জন্য পুলিশ যদি ভাতিজার রিপোর্ট চাচার কাছ থেকে নিয়ে নেয়, তবে সে রিপোর্ট যথার্থ নাও হতে পারে। কারণ তেমন সুযোগে হয়তো চাচা যত্ন-আত্তি করে পুলিশকে রসগোল্লা খাইয়ে এমন রিপোর্ট দেবেন, যাতে ভাইপোর শুধু চাকরিটা চলে যাবে তাই নয়, পুরো জীবনটাই বরবাদ হয়ে যেতে পারে! অবশ্য এ জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করাও ঠিক হবে না। কেননা নিজের ভাইপো সম্পর্কে চাচা ভুল তথ্য দেবেন, এটি বিচার করে দেখা সেই মুহূর্তে তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে, ধরে নেওয়া যায়। আসলে কোনো একটি পদ্ধতি চালু করে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়াটাই মারাত্মক!
আলোচ্য সনদপত্রটির ব্যাপারে বড় আপত্তির জায়গা এই যে, এটি সম্মান হানিকর ও আত্মমর্যাদাবিরোধী। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রদানের আগে শর্ত থাকে, চারিত্রিক সনদপত্র নিতে হবে সরকারি কর্মে নিযুক্ত ও প্রতিষ্ঠিত প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবীর কাছে থেকে। কথাটা বলা হয় ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার কর্তৃক ‘সত্যায়িত’ হতে হবে। প্রথাটা যেহেতু ইংরেজের কাছ থেকে এসেছে, কাজেই সেটির তরজমা করে কথাটি বলা হয় বাংলায়। লক্ষণীয়, যে বাংলাটা বানানো হয়েছে, সেটিরও একটি ঘাপলা আছে। বাংলা ভাষায় ‘সত্যায়িত’ বলে কোনো কথা নেই। বাংলা অভিধান এ রকম শব্দের অনুমোদন করে না। বাংলা সংস্কৃত ভাষা থেকে গ্রহণ করেছে ‘প্রত্যয়িত’ [প্রত্যয়+ইত (যুক্তার্থে)] শব্দটি। অর্থ- বিশ্বস্ত, যাকে বিশ্বাস করা যায় কিংবা যাকে বিশ্বাস করা হয়েছে অথবা যে বিশ্বাসযোগ্য। ইংরেজি কথাটা হলো এটাস্টেট। এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, formal confirmation by signature. বানানো শব্দটির দিকেও কারো খেয়াল নেই। যা বানালাম, তা ঠিক অর্থ দিচ্ছে কি-না, কিছু মনোযোগ তো দেব? একেবারে যা খুশি তাই!
উল্লিখিত স্বাক্ষরটাও এখন মিথ্যায় ছেয়ে গেছে! কেননা প্রার্থীকে এত বিপুল প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয় যে, যিনি এই কাগজপত্র প্রত্যয়িত করে দেবেন, তার হাতে এত সময়ও নেই, ধৈর্যও নেই। আর উপযুক্ত সময়ে যে সেই প্রথম শ্রেণির অফিসারকে পাওয়া যাবে, সেটাও বলা মুশকিল। এ সব বিবিধ কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যিনি প্রার্থী, তিনি নিজেই নিজের প্রত্যয়ণকারী। এটি যে আত্মপ্রতারণা ও মিথ্যাচার, সেটা কে না জানেন? বলা নিষ্প্রয়োজন, সরকার ব্যবস্থাপনা আমাদের কলমে এই কালো দাগ মেশাতে বাধ্য করছে। মানুষের অন্তর এমনি করে মিথ্যায় কালো হয়ে যায়। তারপর চাকরিতে প্রবেশ করলে সব ধরনের আত্মপ্রতারণা ও মিথ্যাচারে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। জিজ্ঞাস্য এই- উল্লিখিত সনদপত্রে কী থাকে? দুটি প্রধান কথা সেখানে বলা হয়। যাকে প্রত্যয়ণ করা হয়, তার সম্পর্কে যিনি প্রত্যয়ণ করেন, তিনি বলেন যে, প্রার্থীর চরিত্র উত্তম আর তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। সুদীর্ঘকালের জানা-পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও কেউ কাউকে সহসা এমন সার্টিফিকেট দিতে পারেন না। রাষ্ট্রবিরোধিতার নানা স্তর আছে। সেই বিরোধিতা কোথাও ছোট হতে পারে, কোথাও বড় হতে পারে। আবার এ দুয়ের একটিও নাও হতে পারে। এটি নির্ণয় করা সহজ নয়। কাজেই সার্টিফিকেটে যা বলা হয়, তা পুরোপুরি মিথ্যাচার। অপরদিকে যা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়ংকর তা হচ্ছে কারও ‘চরিত্র উত্তম’ নির্ণয় করা! মানুষে যেটাকে চরিত্র বলে মনে করে, তার নানা স্তর আছে। নানা গুণের সমষ্টি নিয়ে মানুষের চরিত্র গঠিত হয়। সত্যপরায়ণতা ও নির্ভরযোগ্যতা মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে মহত্তম গুণ। ন্যায়পরায়ণতা, বিচারপরায়ণতা, অধ্যয়নশীলতা, বন্ধুবৎসলতা, সত্যানুসন্ধান, জিজ্ঞাসা, মানুষের কল্যাণ করা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি নিয়ে মানুষের চরিত্র গঠিত হয়। কাজেই যাকে চারিত্রিক সনদপত্র দেওয়া হচ্ছে তিনি কী এইসব গুণের অধিকারী? যিনি দিচ্ছেন তার মধ্যে কী এইসব গুণের কোনো-একটিও জীবন্ত আছে? কে নির্ণয় করবে এ সব সত্য? কাজেই আর দেরি না করে, অতি দ্রুত এই সনদপত্রের রেওয়াজটা তুলে দেওয়া দরকার।
আজকের যে-বাংলাদেশ আমরা দেখছি, তাতে মনে হয় না আমাদের লেখাপড়া জানা মানুষের দেহ খুঁড়লে উল্লিখিত গুণের কোনো-একটি যথার্থরূপে পাওয়া যাবে! কেননা চুরি, ডাকাতি, জালিয়াতি, চালিয়াতি, মিথ্যাচার, বদমাইশি, আত্মপ্রতারণা, ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট সরকারি চাকরিজীবী স্তর থেকে নিয়ে প্রশাসনের প্রায় সমস্ত মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান। বেসরকারি কর্মজীবী ও লেখাপড়া জানা মানুষের মধ্যেও উল্লিখিত জঘন্যতা কম-বেশি বিরাজ করছে। অবশ্য বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি চাকরিগুলোতে চারিত্রিক সনদপত্র চাওয়া হয় না। কাজের ধরন অনুসারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উচ্চতা আর প্রার্থীর কর্মতৎপরতা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ইত্যাদিগুণ সেখানে বড় করে দেখা হয়। সরকারি স্তরের চাকরিজীবী মাত্রই, ব্যতিক্রম ছাড়া আজ তার চরিত্রের প্রায় সমস্ত গুণ হারাতে বসেছে। শুরুতে মিথ্যা দিয়ে প্রবেশ, শেষে মিথ্যা দিয়ে সমাপ্ত- খোটায়-বাঁধা খোরাক খাওয়া মানুষের সম্ভবত এই এক বড় নিয়তি! সরকারি ব্যবস্থাপনার কর্তব্য সরকারি চাকরিজীবীদের ভেতরের সত্য ও সুন্দর বিকশিত করে তোলা।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি জরুরি কথা বলে নেওয়া দরকার। চাকরি থেকে নিয়ে নানা রকম কাজের ক্ষেত্রে অনেক রকম ফরম পূরণ করতে হয় আমাদের সন্তানদের। সেখানে নাম-ঠিকানা, পিতা-মাতার পরিচয় ছাড়াও বিবাহিত-অবিবাহিত অবস্থার সংবাদ থেকে জাতীয়তা ও ধর্মীয় পরিচয়ও দিতে হয়। সে নিজের পরিচয় দেয় মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ হিসেবে! ইদানীং কতকগুলো বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের পরিচয় নেওয়া হচ্ছে- ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে। মগ, মুরং, চাকমা, সাঁওতাল, গারো, হাজং প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে ধরে আঁটি বেঁধে আমাদের সামনে হাজির করা হয়েছে উল্লিখিত পরিচয়ে! মহাত্মা গান্ধী যেমন নানা ধরনের দলিত গোষ্ঠীকে একত্রে নাম দিয়েছিলেন হরিজন, এও তেমনি!
মানুষকে খাটো করবার যতরকম পদ্ধতি আছে আমাদের রাষ্ট্র তার সবকিছুই ব্যবহার করছে! লেখাপড়া জানা কিংবা না-জানা মানুষ যখন কোনো সামাজিক কিংবা ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণ করে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে সে তখন সেটি তার নিজের পরিচয়ের একটি মৌলসত্তা হিসেবে ব্যবহার করে। কোনো দিন যদি কোনো কারণে তার এ পরিচয়ের সংকট দেখা দেয়, তখন সে বুদ্ধি-বিবেচনা নয়, প্রয়োজনে হিংসার আশ্রয় নেয়। এই বাস্তব কারণে আমরা চাই উল্লিখিত ফরম থেকে ধর্মীয় পরিচয়টাও বাতিল করা হোক। কেননা এটি খুবই সংকীর্ণ ও অগণতান্ত্রিক পরিচয়। ফরমে উল্লিখিত অপশনটি পূরণ করতে হবে, এমন বাধ্য-বাধকতা থাকাও উচিত নয়। তবে বিকল্পে কেউ যদি সেখানে তার নিজের পরিচয়ে ‘মানবতাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে চায়, তবে তা সম্মানের সঙ্গে গৃহীত হওয়া উচিত। এটিই প্রকৃত আধুনিক ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। একালের শিক্ষাদীপ্ত মানুষের পক্ষে এটি হতে পারে একটি পথ ও পদ্ধতি।
লেখক- শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়