ঢাকাইয়া সোব্বাসী ভাষার শিকড়ের খোঁজে

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৩৮

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু
ঢাকাইয়া সোব্বাস (একবচন), সোব্বাসী (বহুবচন) মানুষের ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে খুব ভালো গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয় না। ঢাকায় প্রচলিত সোব্বাসী কথ্য ভাষা একটি নাগরিক বা নগর উপভাষা (Urban Dialect) হওয়ার পরও এর উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে গবেষণা কম হওয়ার একটি কারণ হয়তো- এই ভাষার, প্রাচীন কোনো নমুনা না থাকা।
যেহেতু এটি কথ্য ভাষা, তাই লিখিত নমুনা না থাকাই স্বাভাবিক। সোব্বাসীরা বংশ-পরম্পরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার মাধ্যমে এই ভাষা এবং ভাষার ইতিহাস-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং দিচ্ছে; এভাবে পৌঁছানোর এই প্রক্রিয়া ১৬১০ সাল থেকেই চলমান। সোব্বাসীদের নিজস্ব গল্প, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ইতিহাস এভাবেই শ্রুতির মাধ্যমে চলমান। ঢাকাইয়াদের ভাষা প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রচলিত মত আছে; তারমধ্যে কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো :
এক. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের মতে, মুঘল প্রশাসকদের ভাষা ছিল ফার্সি এবং আরবি। জনসাধারণের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের প্রয়োজন হতো না বলে বাংলা ভাষা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। প্রশাসনিক প্রয়োজনে হিন্দুস্তানি ভাষা ব্যবহৃত হতো।
ড. সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ঢাকার ফ্যাক্টর জন বেন ইউরোপীয় নিয়োগকর্তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় ভাষা শেখার জন্য, যাতে তারা স্থানীয় নিয়োগকর্তা এবং দালালদের কথার প্যাঁচ অথবা চাতুরী ধরতে পারেন। জন বেন একটি কৌশলও শিখিয়েছিলেন। কৌশলটি ছিল হিন্দুস্থানি মিশ্রিত বাংলা ব্যবহারের।
দুই. মউদুদ-উর রশীদের মতে, সোব্বাসীরা নবাবদের সহচর এবং শৌখিন সংস্কৃতির সেবক। এরা মোগল আমল ও পরবর্তীকালে ফারসি চর্চা করেছেন। এরা কোম্পানি আমলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও আরবি-ফারসি ভাষার সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক বন্ধন সর্বদা অটুট রাখার চেষ্টা করেছেন।
তিন. শায়লা পারভীন এর মতে, সুখবাসরা বহির্বাংলা থেকে ঢাকায় আগমনকারী অভিবাসীদের বংশধর। মুগল আমলে প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিকসহ বিভিন্ন কারণে এরা ভারতের আগ্রা, দিল্লিসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ঢাকায় বসতি স্থাপন করেন। এদের অধিকাংশেরই ভাষা ছিল হিন্দুস্তানি।
চার. হেকিম হাবীবুর রাহমানের মতে, এরা তারাই যাদের পূর্ব পুরুষ দিল্লি এবং আগ্রা থেকে এখানে আগমন করেছিল। তাদের ভাষা উর্দু। আলবত তারা পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গের কোনো গুরুত্ব অনুভব করে না বা গ্রাহ্য করে না। তিনি আরও বলেন, হোলীসমূহের প্রত্যেকটা দল হিন্দুস্তানি ভাষায় গান গাইত। এমনকি যাদের মাতৃভাষা একমাত্র বাংলা ছিল তারাও হিন্দুস্তানিতে গাইত। হোলীর গান রচনাকারী কবিগণ বেশিরভাগ হিন্দু আর অল্পসংখ্যক মুসলমান ছিল।
পাঁচ. হাশেম সূফির মতে, ইংরেজ আমলে উর্দু চর্চার প্রাণকেন্দ্র হলো লক্ষ্ণৌ, দিল্লি, হায়দ্রাবাদ ও আগ্রা। ফার্সি চর্চার বিকল্প হিসেবে উর্দু ১৮৩০ সালের পর ঢাকায় চালু হয়।
ছয়. অধ্যাপক আব্দুল মমিন চৌধুরীর মতে, উর্দুর প্রসঙ্গ অবান্তর, কেননা উর্দুভাষার জন্মই তখনো হয়নি। পরবর্তীকালে ঢাকার নবাব পরিবার উর্দুভাষা ব্যবহার করতেন।
সাত. কানিজ-ই-বাতুলের মতে, আঠারো শতকে ঢাকা চালের ব্যবসায়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং ব্যবসায়ীরা ছিলেন মারোয়াড়ি। তাঁরা বাংলাভাষী চাল বিক্রেতার সঙ্গে হিন্দুস্তানি বা রিখতা ভাষায় কথা বলতেন। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সভা ও কোর্ট-কাচারিতে হিন্দুস্তানির ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
পুরান ঢাকার ভাষা দুই ধরনের - সোব্বাসী এবং কুট্টি। দুটিই ঢাকার নগর উপভাষা হলেও, সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দ এবং উচ্চারণে মিলের চাইতে অমিলই বেশি। এ দুটোকে এক করে দেখার সুযোগ নেই। যেমন -
১। বাংলা : কুঁজোর আবার চিত হয়ে ঘুমানোর শখ।
সোব্বাসী : কুজাকা ফের চেত হোকে শোনেকা শাওখ।
কুট্টি : গুজারবি আবার চিত অয়া হুইবার সক।
২। বাংলা : কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না।
সোব্বাসী : কোত্তাকা পেটমে ঘি হাজাম হোতানি।
কুট্টি : কুত্তার প্যাটে গি অজম অহে না।
হেকিম হাবীবুর রাহমানের মতে, ‘আলবত তারা পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গের কোনো গুরুত্ব অনুভব করে না বা গ্রাহ্য করে না’ - এটা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। সোব্বাসীরা পুং এবং স্ত্রী লিঙ্গ সূচক শব্দ অবশ্যই ব্যবহার করে। যেমন -
১। বাংলা : আমার বোন ভাত খাবে। সোব্বাসী : মেরা বাহেন ভাত খাগি।
বাংলা : আমার ভাই ভাত খাবে। সোব্বাসী : মেরা ভাই ভাত খাগা।
২। বাংলা : মা ডাকছে। সোব্বাসী : আম্মা/আম্মাজান বোলারাহি।
বাংলা : বাবা ডাকছে। সোব্বাসী : আব্বা/আব্বাজান বোলারাহা।
জেমস টেলর ১৮৩৮ সালে ঢাকাবাসীদের ১৬২টি পেশার তালিকা প্রদান করেছেন। এই পেশাজীবীরা কোনো সুনির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলতো না। নিজেদের মধ্যে এক রকম ভাষায়, কিন্তু হাটে-মাঠে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে সাধারণ কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষায় কথা বলতো। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ সোব্বাসী। তাদের প্রচলিত কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষার উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৬১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কে যদি ধরা হয় তাহলে :
১৬১০ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত ফারসি ভাষার প্রভাব, ১৮৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজি, উর্দু ভাষার প্রভাব, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত উর্দু ভাষার প্রভাব এবং ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রভাব।
প্রচলিত যে কোনো কথ্য ভাষার উপর রাজনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক, সামাজিক প্রভাব বিদ্যমান থাকে। মোগল আমলে সোব্বাসীদের প্রচলিত কথ্য ভাষার উপর তৎকালীন প্রশাসকদের ভাষা ফারসি, আরবির প্রভাব ছিল। এমনকি কোম্পানি আমলে নিমতলির বারোদুয়ারিতে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আনোয়ার পাশা ভবনের অন্তর্ভুক্ত) যখন সোব্বাসী সরদাররা মোগল নবাব তথা নায়েব নাজিমদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, তখন ফারসি ভাষায় যে কোনো আলোচনা হতো। কিন্তু সরদারগণ সমাজে, পরিবারের মধ্যে হিন্দুস্তানি/সোব্বাসী ভাষায় কথাবার্তা বলতেন। আবার ১৮৭৫ সালে যখন খাজা পরিবার ঢাকার নবাব, তখন উর্দুর ব্যাপক প্রভাব ছিল যা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত থেকে অসংখ্য মুহাজির ঢাকায় প্রবেশ করে, তখন সোব্বাসী ভাষার ওপর এই মুহাজিরদের, যাদের ‘বিহারি’ বলা হয় তাদের উর্দু ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখনো অনেককেই ঢাকার এই বিহারি উর্দুর সঙ্গে সোব্বাসী ভাষাকে গুলিয়ে ফেলতে দেখা যায়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর সোব্বাসী ভাষায় ব্যাপক হারে বাংলা শব্দের প্রবেশ ঘটেছে এবং ঘটছে। ইদানীং ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের সুবাদে হিন্দি শব্দ প্রবেশ করছে। যেমন -
বাংলা : এর কারণ কি? সোব্বাসী : ইস্কা ওজা কেয়া? বাংলা/হিন্দি চ্যানেলের প্রভাবে : ইস্কা কারাণ কেয়া?
বাংলা : আমার গর্ব হচ্ছে। সোব্বাসী : মেরা/হামরা ফাকার/ফাখার মাহেসুস হোরাহা। বাংলা/হিন্দি চ্যানেলের প্রভাবে : মেরা/হামরা গার্ভ হোরাহা।
ভাষা প্রবাহমান নদীর মতো; প্রবাহ পথে যা পায় তাকেই সঙ্গী করে সামনের দিকে ধাবিত হয়, পেছনে ফেরার উপায় নেই। প্রতিনিয়তই সোব্বাসী ভাষায় নতুন শব্দের সমাহার হচ্ছে, আবার অনেক পুরানো শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। তথাপি বলা যায় একটি নাগরিক বা নগর উপভাষা হিসেবে বর্তমানে প্রচলিত সোব্বাসী কথ্য ভাষার যে যাত্রা ঢাকায় ১৬১০ সালে হিন্দুস্তানি কথ্য ভাষা থেকে শুরু হয়েছিল তা বিভিন্ন ভাষার প্রভাবে বিবর্তিত হয়ে এখনও ঢাকার বুকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সোব্বাসীরা এখন বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে সোব্বাসী ভাষায় লেখালেখি করছেন।
লেখক- প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থকার