
আমীন আল রশীদ
ধর্ষণ ও ভ্রুণ হত্যার অভিযোগে সম্প্রতি একাত্তর টেলিভিশনের হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন একজন নারী, যিনি পেশায় একজন চিকিৎসক এবং একইসঙ্গে একাধিক টেলিভিশনের নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজ করেছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ৯-এর ১ ধারায় দায়েরকৃত মামলায় অভিযোগে বলা হয়েছে, কাজের সূত্রে শাকিল আহমেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই নারীকে বিয়ের আশ্বাসও দিয়েছিলেন শাকিল। একপর্যায়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলে শাকিল আহমেদ কৌশলে তার গর্ভপাত ঘটান। এরপর শাকিল তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান। অর্থাৎ এখানে অভিযোগ দুটি। ১. বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন- যা পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী ‘ধর্ষণ’ এবং ২. ভ্রুণ হত্যা।
আইন মতে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারীর অনুমতি ছাড়া কিংবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা জোর করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে অথবা তাকে বিয়ে করবেন এই কথা বলে বা তার সঙ্গে প্রতারণা করে শারীরিক সম্পর্ক করেন, সেটি ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে। এমনকি অনুমতি বা সম্মতি ছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ককেও ধর্ষণ বলা হচ্ছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে- ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’
এই ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ এখানে নারী বলতে বিবাহিত-অবিবাহিত সে কথা বলা হয়নি। তার মানে যে কোনো নারী এই অভিযোগে মামলা করতে পারবেন।
প্রশ্ন অন্য জায়গায়। সেটি হলো, দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ সম্মতিক্রমে যদি শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন এবং কোনো কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির সূত্রে দীর্ঘ দিন পরে ওই নারী যদি উক্ত পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন- সেটির আইনি ও নৈতিক ভিত্তি কতটুকু? তাছাড়া এই ধরনের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করা বেশ কঠিন। তদন্তকারী এবং বিচারকদের জন্যও এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
এই আইনটিকে আপাতদৃষ্টিতে নারীদের জন্য সুবিধাজনক মনে হলেও এর একটি যৌক্তিক কারণও রয়েছে। তা হলো, অনেক সময়ই কোনো নারীকে ধর্ষণের পরে সেটিকে সম্মতিতে ঘটিত বলে চালানোর অভিযোগ আছে। মূলত এই জাতীয় ঘটনা প্রতিরোধ করতে নারীর অভিযোগকে এই আইনে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়; কিন্তু আইনের যেহেতু ফাঁক-ফোকর থাকে এবং সব আইনেরই ব্যবহার ও অপব্যবহার উভয়ই হতে পারে। ফলে অনেক সময় অন্যকে ফাঁসাতেও এই আইনটি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে যে নারী ধর্ষণ ও ভ্রুণ হত্যার অভিযোগ এনেছেন, তিনিও বিবাহিত এবং তার স্বামী ও সন্তান রয়েছে। একজন পুরুষের সঙ্গে আইনগত সম্পর্ক থাকাকালীন এবং চার বছরের একটি সন্তান থাকা অবস্থায় আরেকজন বিবাহিত পুরুষের কথিত বিয়ের প্রলোভনে পা দিয়ে তিনি কেন তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হলেন এবং এখন কেন তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করলেন? ওই নারী নিজেও কি তার স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে প্রতারণা করেননি? কেন তিনি স্বামী ও সন্তান থাকার পরেও আরেকজন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হলেন? স্বামী থাকার পরেও তিনি কী করে আরেকজন বিবাহিত পুরুষের বিয়ের প্রলোভনে পড়লেন?
এখানে বিষয়টি স্পষ্ট যে, এই শারীরিক সম্পর্কটা হয়েছে উভয়ের সম্মতিতে এবং কিছু দেনা-পাওনার বিষয় ছিল। ওই নারী নিজেই সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, কাজের সূত্রে শাকিল আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। বস্তুত, যে কোনোভাবেই দু’জন নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এবং সেই সম্পর্কটি তারা কত দূর পর্যন্ত নিয়ে যাবেন, সেটি তাদের দু’জনের ব্যাপার। এখানে আইন ও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন যতই থাকুক, ব্যক্তি স্বাধীনতাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু ঘটনার অনেক মাস পরে যদি ওই পুরুষের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়, সেখানে অনেক প্রশ্ন সামনে আসে। অভিযোগকারী নারী বলবেন, তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে; কিন্তু তিনি এটা প্রমাণ করবেন কীভাবে? কারণ অভিযুক্ত এই অভিযোগ অস্বীকার করবেন। দ্বিতীয়ত, একজন নারীর স্বামী-সন্তান থাকা অবস্থায় আরেক পুরুষের বিয়ের প্রলোভনে পা দিয়ে তার সঙ্গে যে শারীরিক সম্পর্ক করলেন, এটিও কি তার স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে প্রতারণা নয়? এই অপরাধের শাস্তি কী?
শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন- এই অভিযোগটা দেখার পরই বুঝতে পেরেছি এখানে ঘাপলা আছে। কারণ এই নারীকে আমি চিনি। বছর দেড়েক আগে তিনি এ রকম অভিযোগের বিচার আমার কাছেও দিয়েছিলেন আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে। যখন বুঝেছি এসব তার মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যানডিংয়ের বিষয়, আমি পাত্তা দেইনি। তাই তিনি আর এগোতে পারেননি। এইবার হয়তো কাউকে বলেছেন। যারা সেখানে ঘি ঢেলেছেন।
তবে যেহেতু মামলা হয়েছে, সুতরাং এর তদন্ত হবে। সেই তদন্তে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে কে অপরাধী অথবা কোনো একজন না-কি উভয়ই অপরাধী এবং এর পেছনে অন্য কিছু আছে, যা আমরা এখনো জানি না। কারণ আমাদের গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত আরও নানারকমের ঘটনা ঘটে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের পুরুষশাসিত গণমাধ্যম তথা পুরো টেলিভিশন-চলচ্চিত্র ও বিনোদন দুনিয়াটা এখনো নারীবান্ধব নয়। নারীদেরকে কাজ পেতে গিয়ে এবং কাজটা টিকিয়ে রাখার জন্য নানারকম লড়াই করতে হয়। সেই লড়াইয়ের সুযোগ নেন এক শ্রেণির ক্ষমতাবান পুরুষ। যাদের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। তাদের মধ্যে যারা নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নন, তারা নারী সহকর্মীদের নানাবিধ সুবিধা দেওয়ার নামে তাদের শয্যাসঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকে সফল হন।
আবার মুদ্রার অন্যপিঠও রয়েছে। যেমন স্বার্থ হাসিল বা উপরে ওঠার জন্য অনেক নারীও স্বেচ্ছায় তাদের ঊর্ধ্বতনদের ঘনিষ্ঠ হন; অনেকের সংসারও ভেঙে যায়। আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকম নারীও আছেন, যাদেরকে এই মিডিয়ায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাদের স্বামীদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। অথচ একসময় সেই স্বামীকে তারা ছেড়ে দিয়েছেন। তার চেয়ে ক্ষমতাবান কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সুতরাং সমস্যাটা একপক্ষীয় নয়। এসব ক্ষেত্রে আইনের চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তির উচ্চাভিলাস, নীতি-নৈতিকতা, সুযোগের ব্যবহার-অপব্যবহার এবং সর্বোপরি পেশাদারি মনোভাব।
আমাদের গণমাধ্যমগুলোয় কতটুকু পেশাদারিত্বের চর্চা চলে আর কতখানি ব্যক্তি তোষণ; কেন এত বছরেও আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে পেশাদারিত্ব গড়ে উঠল না; এখনো কেন কর্মীদের জন্য একটা বেতন-কাঠামো গড়ে তোলা গেল না; গণমাধ্যমকর্মী সুরক্ষা এবং সম্প্রচার আইন এখনো কেন ঝুলে আছে। এসব নিয়েই বরং এখন প্রশ্ন তোলা দরকার। সেইসঙ্গে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও পরিপার্শ্বের অন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ যাতে না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার।