Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ক্ষমতায়নের জন্য সমতা

Icon

হামীম কামরুল হক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ১৪:১৪

ক্ষমতায়নের জন্য সমতা

হামীম কামরুল হক

অনেক আগের একটা গান মাঝে মাঝেই কানে বাজে: ‘‘সামনে চলার অনেক পথ/ সঠিক পথটি চিনতে হয়/ এগিয়ে যাওয়ার সাহস রেখো/ থেমে থাকার নেই সময়।’’ সময় বয়ে যায় আর মানুষ ক্ষয়ে যায়। জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাত সইতে সইতে অনেকেরই দশা হয় করুণ। এই দশা নিদারুণভাবে ভেতরে ভেতরে কাউকে শেষ করে দেয়। এর প্রধান কারণ সীমাবদ্ধ জীবনবোধ। মন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বড় ও বৃহত্তর দিকে ছড়িয়ে দিতে না পারলে মানুষ ছোট একটা গণ্ডিতে ঘুরপাক খেতে খেতেই শেষ হয়ে যায়। 

রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, ‘‘কেউ নিজেকে মুক্ত ভাবলেই সে মুক্ত, বদ্ধ ভাবলেই সে বদ্ধ হয়ে যায়।’’ মুক্তভাবার জন্য কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকাতে হয়। এটাই হলো সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার। মুক্ত হতে হলে তো কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকার দরকার নেই, অথচ তা-ই করতে হয়। জীবনের এও এক দ্বান্দ্বিক সত্য। মুক্ত হতে হয় নিজের সীমাবদ্ধ চিন্তা ও গণ্ডি থেকে, তাকেই বলে মুক্তি আর যুক্ত হতে হয় মহত্তর-বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে। সেই জীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা উপায় হলো ইংরেজি ভাষা নিষ্ঠার সঙ্গে শেখা। কিন্তু কোনো কিছুকে ভালো না বাসলে তা কখনোই জুৎসইভাবে রপ্ত করা যায় না। কেবল স্বার্থ উদ্ধারই যেখানে প্রধান বিষয় হয়ে থাকে, তা দিয়ে সত্যিকারের কোনো কিছু সাধন করা যায় না। ইংরেজির ক্ষেত্রেও তা-ই। 

ইংরেজির ভাষার সঙ্গে আমাদের যতটা স্বার্থের সম্পর্ক, ভালোবাসার সম্পর্ক ততটা নেই বলেই বোধ করি। আর সবাই জানেন যার সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্ক তলে তলে তার প্রতি এক ধরনের অদ্ভুত ঘৃণাও কাজ করে। ইংরেজির প্রতিও আমাদের এক ধরনের ঘৃণা কাজ করে। ঘৃণাটা নিহিত আছে আমাদের যৌথ অবচেতনে। বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু ইংরেজি শিখে যখন এগিয়ে যাচ্ছে, বাঙালি মুসলমান তখন ইংরেজি থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে অনেক দূরে। পরবর্তীকালে এই দূরত্ব আসলে তেমন ঘুচেনি। কিন্তু ওই কর্মের ভেতরও উৎকর্ষের দৃষ্টান্ত ছিল যেমন ছিলেন আব্দুল্লাহ রসুল, স্যার আজিজুল হক বা হুমায়ুন কবিরের মতো লোকজন। তাঁদের ইংরেজি লেখালেখিই শুধু নয়, জীবনের বৃহত্তর ও মহত্তর ক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি, তাদের যেখানে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালি মুসলমানের জন্য সেটি আজো বিস্ময়কর।

সেদিন এক প্রবাসী বন্ধু বলছিলেন তাঁর বড় ভাইয়ের কথা। বড় ভাই সব সময় ভাবতেন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে কেবল লেখালেখি করবেন। কিন্তু দেখলেন- সবকিছু ছেড়ে দিলে আসলে কিছুই করা হয় না। আমি তাকে বলি, কথাটি মোক্ষম। কিন্তু সত্যিকারে যে লেখক, সে যদি লেখালেখিতেই পরম ও চরম লক্ষ্য ধরে নেয় এবং নিজেকে এতে নিবেদিত ও নিয়াজিত করে তো একটা সময় এসে তার জীবনের অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিজে থেকেই খসে যেতে থাকে।

এমন অনেকের সঙ্গে কথা হয়। এদের কাউকে কাউকে যখন বলি, ইংরেজিভাষী দেশে থাকার মহাসুযোগটা তারা গ্রহণ করছেন কিনা মানে ইংরেজি ভাষাটি খাসাভাবে আয়ত্ত করার সুযোগ- কিন্তু বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই শুনতে হয়, তারা সেটা করেননি। বা পারেন না। জানা আছে অনেকেরই যে লন্ডনে থাকা বাঙালিদের বেশিরভাগেরই ইংরেজি ভাষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ গুটি কয়েক শব্দ ছাড়া আর কিছুই জানেন না। ভেবে দেখেছি যেকোনো স্থানেই কেউ থাকুক না কেন- জীবনযাপনের জন্য খুব বেশি শব্দ কারো দরকার হয় না। এক হিসেবে দেখা গেছে মাত্র ৫০টি ইংরেজি শব্দ জানা থাকলেই কোনো ব্যক্তি তার দরকারি কাজগুলো করে নিতে পারে। আরো দেখা গেছে গড়ে মানুষ ৫ হাজারের বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে না। যে কজন বিখ্যাত ইংরেজের খবর মেলে, তাতে নাকি সবচেয়ে বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, তার ভেতরে আছেন উইনস্টন চার্চিল। তিনি তো আদতে লেখক হিসেবে পরিচিত নন, কিন্তু তাঁর লেখালেখির জন্য এবং তার ভাষায় সাহিত্যগুণের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন।

আমাদের লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো যেকোনো ভাষা শব্দভাণ্ডার যার যত বেশি, তার ততো সেই ভাষায় দক্ষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, কেবল শব্দভাণ্ডার থাকলেই হয় না, তারচেয়ে অপেক্ষাকৃত কম শব্দ দিয়েই ভালো কাজ করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইংরেজি শিক্ষকের কথা শুনেছিলাম, তার নাকি ‘অক্সফোর্ড অ্যাডভান্স লার্নারস ডিকশনারি’র প্রতিটি শব্দ জানা ছিল, জানা ছিল বানান ও উচ্চারণসহ। তাতে ফল কী পেলেন তিনি? তিনি কি ইংরেজি ভাষায় তেমন কোনো কাজ উপহার দিতে পারলেন? 

এতে করে মনে হয়, বাংলা ভাষাটাকেও আমরা কাজের ভাষা করে তুলতে পারিনি, ইংরেজিটকেও কাজে লাগাতে পারিনি। আসলে ভাষাকে কী করে কাজে লাগাতে হয়, সেই ব্যাপারটি থেকে আমরা কী করে যেন অনেক দূরে রয়ে গেছি। ইদানীং কেউ কেউ ইংরেজিতে গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন। কমবেশি খ্যাতিও পাচ্ছেন। তাহমিমা আনাম, কে. আনিস আহমেদের মতো মানুষদের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি বাংলাদেশের জন্য বড় কিছু তারা এনে দেবেন। পাশাপাশি একটি বিষয় খেয়াল করার দরকার যে, ইংরেজিতে চিন্তামূলক লেখা, যা কিনা সাহিত্যগুণ সম্পন্ন- সেদিকে আমাদের তেমনভাবে যাওয়া হয়নি। হ্যাঁ, গবেষণার বিপুল বইপত্র তো ইংরেজিতে আছেই। বাংলাদেশেরএক ইউপিএল থেকেই কম বইপত্র, যেগুলি কিনা এদেশের মানুষেরই লেখা, প্রকাশিত হয়নি, তারপরও ইংরেজিতে চিন্তামূলক লেখালেখিতে আমাদের অর্জন কম। একজন পাকিস্তানি তারিক আলি বা ভারতীয় অরুন্ধতী রায়ের মতো কণ্ঠস্বর আমরা পাচ্ছি কই? কিন্তু বাস্তবতা হল কোনো ভাষা যতক্ষণ না চিন্তার ক্ষেত্রটিকে বিস্তার দান না করে ততক্ষণ সেই ভাষায় বদ্ধতা কাটে না। সেই বদ্ধতা আমাদের নিজেরদের বাংলায় আমরা কাটাতে পারিনি, ইংরেজিতে তো কাটানোর প্রশ্নই ওঠে না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে কেবল ভাষা শেখাটাই যথেষ্ট নয়, একটি ভাষা নিয়ে কী কী করার যেতে পারে সেদিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ও স্বচ্ছ নয়। এই বিশেষ স্বচ্ছতার অভাবে ভাষা নিয়ে আমাদের যাবতীয় কিছুই ভাসা ভাসা- আসে, এসে চলে যায়, কিছুই থাকে না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, কোনো কিছুতে ভাসা ভাসা জ্ঞানে যা হয় তা কাজ চালানের চেয়েও অচল হয়ে ওঠে। ভাষার ক্ষেত্রে সেটি কতটা তা তো বলাই বাহুল্য। 

আমাদের কবে জানা হবে যে ভাষাই মানুষের অস্তিত্ব। যার ভাষা নেই তার অস্তিত্ব নেই। এই ভাষা কেবল কেউ মুখ দিয়ে কথা বলে সেই ভাষা তে নয়, যে সত্যিকারভাবে তার নিজেকে, নিজের আশেপাশের পরিবেশ প্রতিবেশে কথা বুঝে তা নিয়ে সোচ্চার হতে পারে, তাকেই আমরা কণ্ঠস্বর বলি। আমাদের এখানে ‘কণ্ঠস্বর’ হলো ‘মানি-মেশিন ও মাসলের’ তোষণপোষণকারী রাজনীতিবিদরা। যারা স্বার্থছাড়া আর কোনোকিছুই খুব একটা বোঝেন না। ভাষার বিষয় নিয়ে এসব বোঝাবুঝির তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ ভারতের একজন কৃষকও এখন বোঝেন- ইংরেজি ছাড়া তার সন্তানের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। 

কদিন আগে বাংলা একাডেমীতে বক্তৃতা করতে এসে গৌতম ভদ্র বললেন ভারতে বিভিন্ন গ্রামে একটি নতুন দেবীর পূজা শুরু হয়েছে। তার নাম ইংরেজিদেবী। গ্রামের কৃষক শ্রমিক দিনমজুরেরা দাবি তুলেছে তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য ইংরেজিমাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা স্পষ্টই বুঝেছে ইংরেজি হলো- ‘এক্সেস টু পাওয়ার’- ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবেশ পথ ইংরেজি। আমাদের দেশের মধ্যবিত্তরাও তাই বোঝে। তারা প্রকাশ্যে ইংরেজিদেবীর পূজা তো আর করে না, কিন্তু তলে তলে ইংরেজিদেবীর প্রতি টান কারোরই কম নেই। কিন্তু সেই টানে ভক্তির চেয়ে স্বার্থটাই বেশি। ফলে ওই যা হয়, ইংরেজিটা হয় কোনোমতে শেখা ও ভাসা ভাসা। আর ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে তো কোনো কাজের কাজ হয় না। 

দেশে এত ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল হয়েছে, কাজের কাজ তা দিয়ে খুব একটা হয়নি। সবচেয়ে বড় কাজ ছিল ইংরেজিটা রপ্ত করে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে বাংলাভাষায় এনে হাজির করা। সেটি আমাদের করা হয়নি, ওই কারণেই, তার হল স্বার্থের সম্পর্ক, স্বার্থ উদ্ধারই সব। ইংরেজি কেন, ভাষা নামের জিনিসটির প্রতিই আমাদের ভালোবাসা কম। অথচ ভাষা নিয়ে আমাদের অস্তিত্ব। এদেশটাই সৃষ্টি হতো না যদি বাংলা প্রতি পাকিস্তানিদের অবজ্ঞা অবহেলা না দেখা দিত। কিন্তু আজ এ ভাষাকে কারা অবজ্ঞা করে? আমরা ছাড়া আর তো কেউ নেই। ফলে আজও দেশের মানুষের দুর্ভোগ কমেনি, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি শোষণ শাসনের অবসান হওয়ার পরও। এই শোষণ কেবল অর্থনৈতিক নয়, চিন্তাগত ক্ষেত্রে যাতে আমরা এগুতে না পারি সেটি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। আর চিন্তার মূল উপদান ভাষা। ভাষার শক্তির থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ও দূরে সরে থাকার মাধ্যমেই তা ঘটছে। ফলে ইংরেজি কি বাংলা ভাষা শেখাটা মূল সমস্যা নয়, ভাষার শক্তি নিয়ে সত্যিকারে সচেতনতা এবং ভাষাপ্রেম আমাদের নেই। আর তার ফলে মনে মনে পূজা ইত্যাদি করলেও তা নিয়ে খুব কাজে লাগতে পারে তেমন কিছু আমরা এখনো করে উঠতে পারিনি।  


লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫