Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

৫০ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা কতটা এগোলো?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৩৫

৫০ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা কতটা এগোলো?

আমীন আল রশীদ

কোনো একটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, সেটি বোঝার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, সেই দেশের মানুষের ভয়ের পরিমাণ কেমন সেটি জানা। অর্থাৎ যে দেশের মানুষ যত বেশি ভয়ের মধ্যে থাকে, সেই দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি তত নাজুক। পক্ষান্তরে যে দেশের মানুষের জীবনে ভয়ের উপলক্ষ কম, বুঝতে হবে সেই দেশে মানবাধিকার তত বেশি শক্তিশালী।

এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পরে গত ৫০ বছরে এই দেশের মানুষের মনে ভয় কি আগের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে? নাগরিকের ভয়ের কারণসমূহ কী কী এবং এর সবই কি যৌক্তিক? নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো কতটা শক্তিশালী এবং রাষ্ট্রের প্রান্তিক, দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সুরক্ষাবলয় কতটা মজবুত তাও খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে।

দেশ স্বাধীন হবার পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯৭২ সালে যে সংবিধান গৃহীত হয়, তার প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।

এই যে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য এবং সুবিচারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, এর প্রত্যেকটির সঙ্গে নাগরিকের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। নিরাপত্তা শুধু ব্যক্তির নয়। বরং নাগরিকের নিরাপত্তা মানে তার সামাজিক নিরাপত্তা। সমাজে মানুষ হিসেবে ভয়হীনভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তার নামই হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। সামাজিক নিরাপত্তা মানে একজন নাগরিক শুধু পয়সা আয় করবেন আর সেটি খরচ করবেন তা নয়। সামাজিক নিরাপত্তা মানে সামাজিক জীব হিসেবে, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তিনি তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন; ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন এবং নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কারণে তাকে কোনো ধরনের আক্রমণ বা জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে না; তিনি মন খুলে তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে পারবেন; যে কোনো বিষয়ে তার নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার থাকবে এবং সেটি সামাজিক যে কোনো পরিসরে হোক সেটা কোনো অনুষ্ঠানে, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনকি গণমাধ্যমে। তার এই মতামত প্রকাশের জন্য (যদি সেটি রাষ্ট্রবিরোধী এবং নৈতিকতার মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়) রাষ্ট্রের কোনো পর্যায় থেকে তিনি কোনো ধরনের ভয়-ভীতি বা হুমকির সম্মুখীন হবেন না বরং মত প্রকাশের জন্য তিনি যদি কোনো ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানের তরফে কোনো ধরনের ভয়-ভীতি, হুমকি বা আক্রমণের শিকার হন, তাহলে রাষ্ট্র তাকে সুরক্ষা দেবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না রাষ্ট্রের একজন অতি সাধারণ মানুষও তার দেশে এরকম নিরাত্তা উপভোগ করবেন বা তিনি ভয়মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার অর্জন করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি বলা যাবে না যে, সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি সন্তোষজনক।

বর্তমান বাংলাদেশের নাগরিকদের মনে নিরাপত্তা বোধ কেমন তা বোঝার জন্য খুব বড় কোনো গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। প্রতিদিনের গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই বাস্তবতা উপলব্ধি করা যাবে।

সাম্প্রতিক একটি সংবাদ হচ্ছে, খুলনার একটি আবাসিক হোটেলে ঢুকে সন্তানের সামনে এক নারীকে ধর্ষণ করেছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। একজন সাধারণ নাগরিক যখন আরেকজন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেন, তখন সেটি ফৌজদারি অপরাধ; কিন্তু যখন রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী, কোনো প্রতিষ্ঠান নাগরিকের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে, ফৌজদারি অপরাধ করে, তখন সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। অপরাধটি তখন রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি। খুলনায় যে নারী একজন পুলিশ কর্মকর্তার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, রাষ্ট্র কি দায় এড়াতে পারে? রাষ্ট্র কেন গত ৫০ বছরে এমন একটি বিচারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারল না বা ব্যর্থ হলো যার কারণে একটি আবাসিক হোটেলে ঢুকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এক সদস্য সন্তানের সামনে এক নারীকে ধর্ষণ করার সাহস পায়?

আশার সংবাদ হলো, ওই পুলিশ সদস্যকে ঘটনার পরেই গ্রেফতার করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে নিশ্চয়ই তার শাস্তিও হবে। এটাই হচ্ছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যেহেতু মানুষ অপরাধপ্রবণ এবং সুযোগ পেলেই সে তার চেয়ে কম ক্ষমতাবান লোকের ওপরে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়। ফলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, ক্ষমতাবানের লাগাম টেনে ধরা। যদি ধর্ষণের পরেও ওই ব্যক্তি গ্রেফতার না হতেন বা তাকে বিচারের মুখোমুখি করা না হতো, তাহলে এটি স্পষ্টতই মানবাধিকার লঙ্ঘন হতো এবং যার জন্য রাষ্ট্রকেই দায়ী করা সঙ্গত হতো; কিন্তু যেহেতু অপরাধীকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তার বিচারটি যদি সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্তভাবে সম্পন্ন হয় এবং ভিকটিম নারী যদি ন্যায়বিচার পান এবং সেই বিচারে তিনি যদি সন্তুষ্ট হন, তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তার ইস্যুতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে; কিন্তু যে সিস্টেমের কারণে বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যে ক্ষমতা কাঠামোর কারণে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এখনো সুযোগ পেলে একজন নারীকে ধর্ষণ করতে পারছে, সেই সিস্টেমের কোথাও না কোথাও বড় ধরনের গলদ যে রয়ে গেছে, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই।

কারণ এরকম ঘটনা যে গত ৫০ বছরে এই প্রথম ঘটল তা নয়। বরং নিয়মিত বিরতিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে এরকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে সাদা পোশাকে নাগরিকদের ধরে নিয়ে গুম করে ফেলা; আদালতে অপরাধ প্রমাণের আগেই কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নামে বিনা বিচারে হত্যা করে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে গুরুত্বহীন করে তোলা; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নাগরিকদের নির্যাতন; মামলায় জড়ানোর ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করার অভিযোগও নতুন নয়।

এই ইস্যুতে নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব সদস্যদের হাতে সাত খুন একটি বড় কেসস্টাডি। এর বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যুও নিয়মিত আলোচনার বিষয়। আবার অনেক অপরাধেই অভিযুক্তরা শাস্তিও পান; কিন্তু একই ধরনের অপরাধ চলতেই থাকে। তার মানে কোথাও একটা বড় ধরনের ঘাপলা রয়ে গেছে। হয় এ সব শাস্তির বার্তা সবার কাছে ঠিকঠাক পৌঁছাচ্ছে না, অথবা অপরাধীরা ভাবছে যে ক্ষমতার বলয়ে থেকে কোনো না কোনোভাবে পার পাওয়া যাবে। যদি এই বোধটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য এবং সরকারি কর্মচারীদের মনে ভেতরে গেঁথে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি এখনো নড়বড়ে। বরং রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা এবং অন্যায় করলে তাকে দলমত ও আদর্শ নির্বিশেষে বিচারের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রথম শর্ত। সেই শর্ত পূরণে এখনো বাংলাদেশকে অনেক দূরে যেতে হবে।তবে এই নিরাপত্তা শুধু সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় পরিসরে নয়। বরং পারিবারিক পরিসরেও নাগরিকের, বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে।

২০১৫ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি বিবাহিত নারী তাদের সঙ্গীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। যে কারণে বলা হয়, নারী সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় তার ঘরেই। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা ঘরের ভেতরের এই নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেন না; কখনো সংসার টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে; কখনো পারিবারিক ও সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে। তবে মুদ্রার অন্যপিঠ হলো, নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে ভুক্তভোগী নারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও রেফারেন্স সেবা প্রদানের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক মাল্টি সেক্টোরাল কর্মসূচির আওতায় বিভাগীয় পর্যায়ে ৮টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এবং ৬০টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল পরিচালনা করছে। সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর সব প্রয়োজনীয় সেবা একটি কেন্দ্র হতে প্রদানের জন্য এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৮০৪ জন ভুক্তভোগী কেন্দ্র হতে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। আর সহিংসতার শিকার ভুক্তভোগী দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ৩৭৪৭ জন।

তার মানে সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলার আগে নাগরিকের পারিবারিক, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করাও জরুরি, যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এমন আইন ও নীতি প্রণয়ন করা; এমন পদ্ধতি বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে একজন নাগরিক আরেকজন নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা সংকটের কারণ হতে না পারে। তাতে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যই হোন আর কারও স্বামীই হোন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫