
এমাজউদ্দীন আহমদ
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। আমাদের গৌরবের এবং গর্বের মাস। একটি গর্বিত জাতি হিসেবে সগর্বে মাথা উঁচু করার স্পর্ধা আমরা অর্জন করি এ মাসেই। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং আত্মদানের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার সরল রাজপথে আমরা প্রবেশ করেছি ডিসেম্বরেই। তাই জাতির কাছে ডিসেম্বর হয়ে উঠেছে বিজয়ের মাস।
এ মাসকে আমরা পেয়েছি আমাদের বিকশিত সত্তার উজ্জ্বল প্রতীক রূপে, আমাদের জাতীয় অর্জনের শ্রেষ্ঠতম স্মারক হিসেবে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমরা ভুলিনি। আমাদের বিজয় এসেছে রক্তসিক্ত পথে। এসেছে এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ছোপ ছোপ রক্তের সিঁড়ি বেয়ে। এক নদী রক্তের তীর ঘেঁষে। নিজেদের রক্তের বিনিময়ে এ বিজয় অর্জিত বলেই এটি আমাদের এত কাঙ্ক্ষিত সম্পদ।
ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পর্যায়ে এত কাম্য, হৃদয় নিংড়ানো সম্পদ বলেই এত মোহনীয়। হৃদয়ের এত কাছাকাছি। লাল গোলাপের মতো সবার কাছে এত মনোলোভা। এত হৃদয়গ্রাহী। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তার উত্তর দেওয়ার জন্য এ লেখা নয়। আমরা জানতাম, কেন আমরা যুদ্ধ করি। সন্তান-সন্ততিদের জন্য প্রশান্তি, ভাইয়ের মুক্তি। একটি সুন্দর পৃথিবী, একটি পরিচ্ছন্ন প্রজন্ম।
আমাদের সন্তান-সন্ততিরা যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বেড়ে ওঠে, যেন ভাই-বন্ধুরা উদার আবহাওয়ায় বিকশিত হতে পারে সে জন্যই তো এত রক্তদান। হিংসা-প্রতিহিংসাপীড়িত, নিপীড়ন-নির্যাতন জর্জরিত পৃথিবীটা যেন স্নেহ- প্রেম-প্রীতির আবহে পূর্ণ হয়ে সুস্থ মানবতার আবাসভূমি হয়ে উঠতে পারে এবং সেই পরিবেশে বেড়ে উঠে নতুন প্রজন্ম যেন পরিপূর্ণতার আর্শীবাদ মাথায় নিয়ে বিশ্বমানবতার জয়গানে মুখর হয়ে উঠতে পারে সে জন্যই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টিতে ছিল এমনই স্বপ্ন।
বর্তমানে মুক্ত বাংলাদেশ, ভবিষ্যতে দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সারা বিশ্বে শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অন্বেষণ ছিল তাদের স্বপ্ন। এজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। বিজয়ের মাসে কোনো হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন নেই। নেই কোনো সুক্ষ্ম ব্যালান্সশিট তৈরির প্রয়োজন। তবে প্রয়োজন রয়েছে ভেবে দেখার। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যা চেয়েছিলেন তার কতটা কাছাকাছি এ জাতি আসতে পেরেছে? জাতীয় জীবন কী ঠিক পথে রয়েছে? আমরা পথভ্রষ্ট হইনি তো?
এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। শুধু এটুকু বলব, আমরা চলেছি, তবে পথ খুব বন্ধুর। খুব অসমতল। তার পরও চলেছি। অব্যাহত গতিতে। হ্যাঁ, সত্য, আজকের বাংলাদেশ একাত্তরের বাংলাদেশ থেকে হয়েছে ভিন্ন। হয়েছে অগ্রগামী। অগ্রসরমান। এ অগ্রগতির ছাপ যেমন পড়েছে শহরাঞ্চলে, তেমনি পড়েছে গ্রামবাংলায়, বিশেষ করে হাজার বছর ধরে যে গ্রামগুলো ছিল অবচেতন, আধা ঘুমে-আধা জাগরণে। বিগত চার দশকে বাংলাদেশ সেই প্রাচীন স্থবিরতা কাটিয়ে উঠেছে। ঘুমের আড়মোড়া কাটিয়ে চলতে শুরু করেছে, শুধু হাজার বছরের সেই সনাতন কৃষিকে আলোকিত করে নয়, বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আধুনিকতার আলোকে সমুজ্জ্বল হয়ে বাংলাদেশ যে এগিয়ে চলবে, পেছন ফিরে যে তাকাবে না, সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে অগ্রগামী হবে, তা সুস্পষ্ট হয়েছে গ্রামবাংলায় নতুনভাবে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টির মহোৎসবের নিরিখে। কেননা ৮৫ হাজার গ্রামেই বাংলাদেশের হৃৎপিন্ড স্পন্দিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কি সাড়ে সাত কোটি। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। জন্মহার হ্রাস পেয়েছে, এবং মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। মাতৃমৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। একটি কথা জোরেশোরে বলতে চাই এবং তা হলো এ জন্য প্রধানত ভূমিকা পালন করেছে এ দেশের নারীসমাজ। সনাতন সমাজে বাস করেও তারা অত্যন্ত সচেতন। এ দেশে এখনো পরিবার তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ রচনার পীঠস্থান এখনো এ দেশে পরিবার। মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে সুস্থতাও। শহর ও গ্রামাঞ্চলে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি অনেকটা কিংবদন্তির মতো। যে পরিবারে একজন উপার্জনক্ষম নারী রয়েছে সেই পরিবারটি হয়েছে গতিশীল, সম্মুখপানে অগ্রসরমান। সেই পরিবারে অশিক্ষা-কুশিক্ষা সঙ্কুচিত। পুরোপুরি আলোকিত হয়নি বটে, তবে ভবিষ্যতে যে আলোকোজ্জ্বল হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আশার কথা, নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগই গ্রামাঞ্চলের। বেশভূষায় পরিবর্তন দেখবেন। দেখবেন, এক ধরনের আত্মপ্রত্যয় পুরো সমাজকে যেন উদ্দীপ্ত করে চলেছে। যেন জীবনের চারদিকে তা উপচে পড়ছে। বয়স্ক নারী ও পুরুষের শিক্ষা বিস্তৃত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই নির্মম সময়ে দেখেছি প্রায় প্রতি গ্রামে নিজেরা না খেয়ে, পরিবারে যা কিছু আছে উদার হাতে তার সবটুকু পাশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাতে তুলে দিয়ে, এ দেশে মহীয়সী নারীরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তা ঐতিহাসিক। তাদেরই স্নেহ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে, আমাদের অকুতোভয় সন্তানরা যেভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধকে সফল পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে এ জাতিকে নতুন ঠিকানা উপহার দিয়েছেন তা ঐতিহাসিক। এ দেশের প্রায় প্রতিটি ঘর তাদেরই সহায়তায় রূপান্তরিত হয় এক একটি দুর্গে। তাই তো চারদিকে অসংখ্য রক্তস্রোত সৃষ্টি করে মাত্র ৯ মাসে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর। ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হওয়ার ঐতিহ্য তাদের নেই। রাতারাতি চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে কুঁড়েঘরে ছেড়ে সাতমহলা প্রাসাদে ওঠার ঐতিহ্য তাদের নেই। তাই বাংলাদেশ যখন দুর্নীতিতে একাধিকবার শীর্ষস্থানের অধিকারী হয় তখন তারা বিমূঢ় হয়েছিল। তাদের অনুধাবনে আসে না কি ভাবে তা সম্ভব। তারা জানে, গতর খাটিয়ে যা অর্জন করা যায় তা-ই প্রকৃত অর্জন। চুরি-ডাকাতির মত দুর্গন্ধময় নর্দমাগুলো বন্ধ হলে প্রবৃদ্ধির হার যে অনেক বেড়ে যাবে তাও তাদের ধারণায় নেই। কিন্তু তারা কাজ করেই চলেছে। দুদিন পর তাদের প্রিয় দেশটির ভাগ্যে এখনো ‘অনগ্রসর’, ‘পশ্চাৎপদ’ দরিদ্র প্রভৃতির মতো নির্মম অভিধা শোভা পাচ্ছে। যখন তারা তাদের পরিচালকদের দুর্বুদ্ধির ফাঁকফোকর জেনে যাবে তখনই দেশের রাজনীতিও সুস্থ হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে কল্যাণকর। হবে সার্থক। জনস্বার্থভিত্তিক।
বাংলাদেশের রাজনীতি যে অপরিণত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অপরিণত বলেই আমাদের রাজনীতিকদের প্রতিনিয়ত-শুনতে হয় বিদেশিদের ছোট মুখের বড় বড় কথা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্য সাধারণ নির্বাচন যে অপরিহার্য এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তথা নির্বাচন-উত্তর পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা যে অবশ্য প্রয়োজনীয় তাও শুনতে হয় তাদের কাছ থেকে। ডিসেম্বরের তাৎপর্য কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তাৎপর্য ভিন্ন ১৬ ডিসেম্বরের। সেদিন জাতি যে বিজয়তিলক কপালে ধারণ করে তা এদেশের জনগণের অর্জন। তা এ দেশের ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবীর অর্জন। গ্রামের কৃষক-শ্রমিক-দুরন্ত তরুণের কীর্তি। শহরের সংস্কৃতিসেবী-বুদ্ধিজীবী-সাধারণ মানুষের কীর্তি। তারাই রক্ত দিয়েছেন। তারাই স্বাধীনতার অগ্রপথিকের ভূমিকায় ছিলেন। তাদেরই হৃদয় নিংড়ানো রক্তধারায় সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার মহান সৌধটি।
লেখক : প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। (লেখাটি সাম্প্রতিক দেশকাল আর্কাইভ থেকে নেওয়া হয়েছে)