Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন

Icon

এম আর খায়রুল উমাম

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ১৩:৫৫

শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন

এম আর খায়রুল উমাম

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। লক্ষ্য পূরণে সরকার জাতীয় শিশুশ্রম নীতি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিল্পনা প্রণয়ন করেছে। দেশের আগামী দিনের নাগরিকদের জন্য সরকারি এই উদ্যোগ সাধুবাদ যোগ্য। আমাদের আগামী দিনের নাগরিকরা সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলুক তা সর্বমহলের কাম্য। তাই শিশু অধিকার নিশ্চিত ও শিশুশ্রম বন্ধ করতে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সবাই একত্রে কাজ করবে আশা করা যায়। তবে প্রথমেই শিশুশ্রম নিরসনে আমাদের সকলের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতাই শিশুকে শ্রমজীবী হতে বাধ্য করে। সরকার যদি জণগণের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসার নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারতো তা হলে আজকের শিশুশ্রমের দশভাগ শিশুশ্রম সমাজে দেখা যেতো না। তাই সরকারের নীতি সরকার শতভাগ বাস্তবায়ন করুক- আমরা অভিশাপমুক্ত হই এই দাবি জানাই।

সরকার শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় শিশুশ্রম নীতি-২০১০ এবং এই জাতীয় নীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘জাতীয় কর্মপরিকল্পনা: ২০১২-২০১৬’ প্রণয়ন করেছে। এই নীতি বাস্তবায়ন করে সরকার আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নির্মূল করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ ২০১৫ সাল পর্যন্ত সরকার প্রদত্ত আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে আপাতত দিন পার করুক। বাস্তবতা হলো ২০১৩ সালের এক-চতুর্থাংশ পার হয়ে গেলেও এখনো ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমের তালিকাই চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। তালিকা চূড়ান্ত করার পরে অঙ্গীকারকৃত সময়ের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূল করতে জনগণের অনেক প্রত্যাশা কথামালায় সাজিয়ে সময় পার করে দেয়। অতীতে এমন হাজার উদাহরণ আমাদের সামনে আসে। এখন শিশুশ্রম নিরসনে সরকার তেমন আর একটা উদাহরণ বাড়াচ্ছে বলেই মনে হয়। 

বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। শিশুশ্রম নিরসনে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ আইএলও কনভেনশনের প্রভাব। সত্যিকারভাবে সরকার শিশুশ্রম নিরসন করতে চায় কিনা তা গবেষণার বিষয়। সরকার আন্তরিক হলে প্রথমত, এভাবে সময় নষ্ট করতো না, দ্বিতীয়ত একটা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন তার কোনো ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেদের সমস্যার সমাধান করা যায় না। সরকার পরিকল্পনা করে বসে আছে; এখন কে কত ঋণ দেবে তার উপর বাস্তবায়ন নির্ভর করলে শিশুশ্রম নিরসন আকাশ কুসুম কল্পনাই থেকে যাবে। কারণ আইএলও কত টাকা জোগাড় করে দেবে এনজিওরা কত টাকা সাহায্য আনবে তা দিয়ে আর যাই হোক শিশুশ্রমের মতো বিশাল বিষয়ের সমাধান আশা করা যায় না। বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজন বিবেচনা করে সরকারকে অর্থের সংস্থান করতে হবে।

বাংলাদেশে সরকারগুলোর সবচেয়ে বড়গুণ আন্তর্জাতিক যে কোনো চুক্তি সামনে পেলেই হয়, স্বাক্ষর দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করে না। এসব চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয় এমনটা দেখা যায় না, শোনাও যায় না। হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে- বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাজ শেষ। আন্তর্জাতিক শ্রমনীতিসহ বিভিন্ন চুক্তিগুলো সংসদে অনুমোদন নিয়ে দেশে যে গল্প প্রচারিত আছে তা যেমন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না আবার তা মেনে নেওয়া যায় না। বিনা আলোচনায় চুক্তি স্বাক্ষরের ফল দেশের মানুষ ভোগ করছে। এমন চুক্তির মধ্যে কি আছে তা সরকার যেমন জানে না তেমন তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও গ্রহণ করে না। তাই সরকার কোনো চুক্তি সই করলে সাধারণ মানুষের আশা জাগে কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই আশা মিলিয়ে যেতেও সময় লাগে না। তাই আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে আমাদেরও তেমন কিছু আশা করা অন্যায় হবে।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। শিশুশ্রম হ্রাসে সরকারের মতো বিশাল কলেবরে কাজ করতে না পারলেও অঞ্চলভিত্তিক কাজ করে থাকে। কিন্তু সরকারের কোনো উন্নয়নের মডেল ও মনিটরিং না থাকার কারণে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অর্জন নিয়ে রকমারি কথা বলার ও শোনার সুযোগ থেকেই যায়। কাজের কাজ কতটা কি হয় বা হচ্ছে তা সাধারণের বোধগম্যের মধ্যে থাকে কিনা সন্দেহ। অথচ এইসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রশাসন, সুশীল সমাজ ও এলাকার মানুষদের দেখা যায়। এতে এখানেও আশার জাগরণ দেখা যায় কিন্তু তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো এক-দুই বছর কাজ করার পর এখন কাজ বন্ধ করে দেওয়া তারপর আস্তে আস্তে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। কেউ অর্জনটা ধরে রাখার জন্য কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ না করার ফলে পুরো অর্জনটাই এক সময় হারিয়ে যায়। অর্থ ও সময় সবই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তা সাধারণ মানুষ বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। এখানেও সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়। বাংলাদেশে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার লোকের বিশাল সংকট। কেউ যেমন ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। আবার তেমনি কাউকে বিশ্বাসও করে না। ফলে মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যন্ত দায়িত্বভারে জর্জরিত একেক জন শতাধিক কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া অন্য কোনো কাজ করতে পারে বলে মনে হয় না। সবারই নিজ নিজ কিছু দায়িত্ব আছে, গণযোগাযোগ আছে তারপর এই কমিটিগুলোর দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। ফলে দায়িত্বে জর্জরিত নেতাদের কোনো কাজের চালিকা শক্তি হিসেবে পাওয়াটা খুবই কঠিন। কিন্তু তাই বলে এরা দায়িত্ব থেকে সরে অন্যকে দায়িত্ব দিতে রাজি নয়। নিজেদের প্রধান রেখে অন্যদের কাছে কাজ চায়, যাদের তারা বিশ্বাস করে না। এ কারণে কোনোখানেই কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে চায় না বা কাজের মধ্যে যে আনন্দ তা-ও পায় না। সর্বক্ষেত্রে প্রচণ্ড স্থবিরতা লক্ষণীয়। এতে সরকারের কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। বরং সাধারণভাবে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জনবল নেই শুনতে হয়। কত জনবল হলে দেশের প্রশাসন গতিশীল করা সম্ভব তার একটা সঠিক হিসেব করা দরকার। কারণ সচিবালয় থেকে উপজেলা প্রশাসনে, তথ্য দপ্তর থেকে সমাজকল্যাণ দপ্তর, হাসপাতাল থেকে প্রকৌশল দপ্তর, স্কুল থেকে কলেজ, পৌরসভা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ, রাজস্ব থেকে আয়কর দপ্তর সর্বক্ষেত্রে জনবলের সংকটের কথা শুনতে হয়। তাই জনবলের সমস্যা সমাধান না করে কোনো কাজে হাত দিলে তা কল্যাণকর হবে না। 

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে মূল সমস্যায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। দেশের সব শিশুর খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে একজন শিশুকেও শ্রমের বাজারে পাওয়া যাবে না। আমাদের দারিদ্র্য সব শিশুর অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তা প্রদানে ব্যর্থ। পিতা-মাতা তাদের এ ব্যর্থতা থেকে বাঁচতে শিশুদের অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রমে নিয়োজিত করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার জনসংখ্যার ভারে এতটাই ভারাক্রান্ত যে এদিকে নজর দিতে পারছে না। তাই শিশুশ্রম নিরসনে প্রকৃত কাজ শিশুর বা দেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা। দেশের পরিসংখ্যান বলে স্বাধীনতার ৪২ বছরে আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রেই অগ্রগতি সাধন করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তা আমাদের জনসংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে ব্যর্থ হয়েছে।

এখনো মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার বেশি হওয়ায় জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং চলছে। সরকারের উদাসীনতা এবং ভুল পরিকল্পনার কারণে দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পথ হারিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার কার্যক্রম যথাযথ পর্যায়ে উন্নত করতে না পারায় আজ দেশের সব পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যুদস্ত। জাতীয় শিশুশ্রম নীতি- ২০১০ কে এই ব্যর্থতার বাইরে রাখা যাবে বলে মনে হয় না।

দেশের জাতীয় আয় বেড়েছে, জাতীয় ব্যয় বেড়েছে, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, গড় জীবনকাল বেড়েছে, বিলাস বেড়েছে। 

এতকিছু বৃদ্ধির আনন্দের মাঝে বেড়ে চলেছে দারিদ্র্য অপুষ্টি,বস্তি, অসহায় মানুষের হাহাকার। দেশের সব উদ্যোগই জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের কাছে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। জনশক্তি বিদেশে প্রেরণ করে আর আমাদের মতো দেশের জন্য মুক্তির পথ তাতে দ্বিমত না থাকলেও তার সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। আমাদের ভূমি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, পরিবেশ, সামর্থ্য বিবেচনা করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

লেখক- সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫