Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

আইভীর বিজয় জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ দেখাবে কি?

Icon

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৩৮

আইভীর বিজয় জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ দেখাবে কি?

শেখর দত্ত

২০০৩ সালে বিএনপি-জামায়াত আমলে পৌরসভা নির্বাচনে ৩৭ বছরের আইভী যখন প্রথম পৌরসভা নির্বাচনে বিজয়ী হন; তখন চুনকার মেয়ে, রাশিয়াফেরত ডাক্তার, শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদিকা-এমনটাই ছিল নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে তাঁর পরিচয়। ছিলেন নিতান্তই তৃণমূলের এক নেতা; কিন্তু ১৯ বছর পর আজ! যে জাতি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে করতে স্বাধীনতা এনেছে, গণতন্ত্র যখন পূর্বাপর আমাদের জাতীয় পছন্দ, গণতন্ত্রের প্রধান বিষয় ও সূচনাবিন্দু ভোট নিয়ে যখন দেশবাসী উদ্বিগ্ন ও হতাশ; তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে সেলিনা হায়াৎ এখন দেশবাসীর কাছে গণতন্ত্রের সিম্বল। এমন কৃতিত্ব অর্জন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা আহমেদ আলী চুনকার মেয়ের পক্ষে স্বাভাবিকই ছিল।

পাকিস্তান আমলের কঠিন-কঠোর দিনগুলোতে ১৯৬৬ সালে পিতা যখন বাংলার জনগণের গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের ‘মুক্তিসনদ’ ৬ দফা নিয়ে ৭ জুনের ঐতিহাসিক হরতাল সফল করতে ব্যস্ত, তার একদিন আগে প্রথম কন্যা আইভীর জন্ম। রাজধানী ঢাকা যদি হয় বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র; তবে রাজধানী সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জ অবশ্যই সেই হৃদপিণ্ডেরই অংশ। ওই বছর ৬-দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ঝটিকার বেগে যেসব জনসভা করেন, এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের জনসভা ছিল সর্বশেষ সর্ববৃহৎ ও অভূতপূর্ব। জনসভা থেকে ফেরার পথেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন এবং পরে তথাকথিত আগরতলা মামলার প্রধান আসামি হন। ৭ জুন নারায়ণগঞ্জ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলে ৬ জন শহীদ হন। আইভীর জন্মের ক্ষণে অর্ধশত বছর আগে গণতন্ত্র তথা ভোটের সংগ্রামে নারায়ণগঞ্জ ছিল অগ্রসেনানী, এবারে সেদিনের সেই শিশু আইভীর নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ যেন সেই ভূমিকাই নিল। দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়ে গেল আগামী দিনেও ‘আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব’ স্লোগানের সংগ্রামে দেশের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ এগিয়ে থাকবে, নেতৃত্ব দেবে। আইভী থাকবেন সেই মিছিলে।

মেয়র আইভীর বিজয় মানে নারায়ণগঞ্জবাসীরই সর্বাংশে বিজয়। গণতন্ত্রেরও বিজয়। বিজয়ের পথ কিন্তু কখনো ফুল বিছানো থাকে না। কণ্টকাকীর্ণ, আঁকাবাঁকা, বন্ধুর পথ তাতে পাড়ি দিতে হয়। নারায়ণগঞ্জবাসী কিংবা চুনকা বা আইভীকেও তেমন পথই পাড়ি দিতে হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থীকে পরাজিত করে ১৯৭৩ সালে আলী আহমদ চুনকাকে পৌরসভা নির্বাচন বিজয়ী হতে হয়েছে। প্রবাদ বলে, ‘বাপকা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া বহুত না হয়তো থোড়া থোড়া।’ কিন্তু বেটি আইভী বাপকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থী মহাক্ষমতাধর শামীম ওসমানকে (পত্রিকা ও আইভীর ভাষায় গডফাদার) পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে গণতন্ত্রের পতাকাকে অগ্রসর করছেন। সাত খুনসহ অজস্র রক্ত বিশেষত বালক ত্বকীর রক্তে নারায়ণগঞ্জের গণতন্ত্রের পথ রঞ্জিত। এবারের বিজয়ের ভেতর দিয়ে আইভী ও নারায়ণগঞ্জবাসীর রক্ত-ত্যাগ-শ্রমের ঐতিহ্যবাহী সেই পথকেই আরও সংক্ষিপ্ত করলেন এবং দেশবাসীকে সংক্ষিপ্ত করার পথ দেখালেন। 

এটা বোধকরি কারোই অস্বীকার করার জো নেই যে, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে আলো-অন্ধকারের দুই ধারাই পাশাপাশি বিরাজমান। আলো যত উজ্জ্বল, অন্ধকার ততই নিকষকালো। ষাট ও সত্তরের দশকে গণতন্ত্রের যে আলো প্রজ্বালিত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে, তা এখনো জাজ্‌বল্যমান থেকে পথ অতিক্রম করছে। এবারে ও বিগত ২০১৬ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভী আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সর্বৈব সমর্থন পান। স্থানীয়ভাবে দলীয় বিরোধিতা বন্ধ করতে তিনি সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এদিকে ২০১৭ সালেই অন্ধকারকে সতর্কবার্তা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়রকে উপমন্ত্রীর মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। এ থেকে সুস্পষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বান্তকরণে সমর্থন-সহযোগিতা রয়েছে আইভীর নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জবাসীর গণতান্ত্রিক উত্থানে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা কী চান, এটা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভেতর দিয়ে রাজনীতিক ও দেশবাসীর কাছে সুস্পষ্ট করে দিলেন। 

আইভীর বিজয় প্রমাণ করল, ভালো প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের মার্কা নৌকা যদি থাকে, তবে ওই দলকে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পরাজিত করা বাস্তবেই অসম্ভব। আওয়ামী লীগের মার্কা হারে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ‘সাইজআপ’ করার সংস্কৃতি বাসা বেঁধে থাকা এবং নিতান্তই মন্দ-নিন্দিত প্রার্থী মনোনয়নের কারণে। মনোনয়নে যদি গলদ না থাকে কিংবা সাইজআপ যদি না থাকে, তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীজামানত হারায় কীভাবে? বাস্তবে এতটা সংগ্রামী ঐতিহ্য, দেশের জন্য এত রক্ত-ত্যাগ স্বীকার, ক্ষমতায় থেকে দেশের এতটা উন্নয়ন, সুবিন্নস্ত-সুবিস্তৃত গণবান্ধব কর্মসূচি এবং বিশেষভাবে এমন একজন একনিষ্ট ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা থাকার পর সেই দলের মার্কা ও প্রার্থী হারতে পারে কীভাবে? 

নারায়ণগঞ্জের এই নির্বাচন দেখিয়ে দিয়ে গেল, আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা নির্বাচনে গলদ রয়েছে। এটা কেবল ওই দলের সমস্যা নয়; আমাদের দেশের রাজনীতির সমস্যা, রাজনীতিকে অর্থ ও অস্ত্রের নর্দমা থেকে ঐতিহ্যের ভূমিতে টেনে আনার ক্ষেত্রের সমস্যা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সমস্যা। আওয়ামী লীগের প্রয়াত জনপ্রিয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলতেন, আওয়ামী লীগ পাল্টালে দেশ পাল্টাবে। কথাটা কেবল বর্তমান বাস্তবতার কারণেই নয়, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সত্য। ধারণা করি বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দলে ‘কাউয়া’ শব্দটা এ কারণ বিবেচনায় নিয়েই উচ্চরণ করে থাকেন। স্বাধীনতার পর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও ক্যু-পাল্টা ক্যু, হত্যা-ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে দেশের ত্যাগ ও সংগ্রামের গৌরবমণ্ডিত রাজনীতি যখন অর্থ-অস্ত্রের কাছে বন্দী হয়ে অনেকটাই নর্দমায় নিপতিত; তখন জাতীয় রাজনীতির মূল ধারার প্রধান দল আওয়ামী লীগ গলদ থেকে দেশের গণতন্ত্রকে উদ্ধারের পথ দেখাক, এটাই আইভীর নির্বাচনের বিজয়ের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে দিক-নির্দেশ দিয়ে গেল।

সৎ ও জনদরদী হলেই ভাল প্রার্থী এমন একটা ধারণা রাজনীতির অঙ্গনে রয়েছে। বিষয়টি কেবল তাতে সীমাবদ্ধ নয়; এ দুইগুণ তো থাকতেই হবে। বিষয়টি হলো বাস্তববাদী প্রার্থী, কার্যকর প্রার্থী, দূরদর্শী প্রার্থী, জনগণের সুখ-দুঃখের সাথী প্রার্থী। জনগণের মধ্যে থেকে, জনগণের সাথী হয়ে, জনগণকে নিয়ে লক্ষাভিমুখী অগ্রসর হওয়ার প্রার্থী। কয়েক দিন আগে ব্যক্তিগত কাজে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে আলাপ হচ্ছিল একজন রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে। তিনি বললেন, আইভীর বিজয় সুনশ্চিত; কারণ আইভী জনগণের সঙ্গে আছেন এবং বোঝেন শহর ও জনগণ কী অবস্থায় রয়েছে এবং কোথায় নিতে হবে। সাহস, ধৈর্য ও কাজ রয়েছে আইভীর। তিনি ব্যক্তিস্বার্থ পেছনে ফেলে অগ্রাধিকার দেন দল, শহরবাসী তথা দেশকে।

ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাইজআপের ঘোরপ্যাঁচে পড়েও পিতা ও কন্যা কখনো আওয়ামী লীগ ছাড়েননি। দলের মিশন-ভিশনকে বাতিঘরের মতো রেখে, মূল নেতৃত্বকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে, দলের ঐতিহ্য ও চেতনার ধারাকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে জনতার দরবারে গিয়েছেন। মনোনয়নপ্রাপ্তি না হবার পর গোস্যা করে বা বিক্ষুব্ধ হয়ে দল ছাড়েননি, নেতাকেও ছাড়েননি। এমন অবস্থান উদাহরণ বিশেষ। নিঃসন্দেহে এটা ছিল একটা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ; কিন্তু আজ! সারা দেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। সারাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে এমন কেন্দ্র যদি ছড়িয়ে পড়ে, তবেই হবে আইভীর বিজয়, নারায়ণঞ্জবাসীর বিজয় সফল ও স্বার্থক।

নির্বাচনে বিজয়ের পর জনগণের নেতা আইভী এবারেও যা দেখালেন, তাতে চমৎকৃত না হয়ে পারা যায় না। বাসায় মিষ্টি নিয়ে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তৈমূর কাকাকে মিষ্টি খাওয়ালেন। বললেন, ‘ভবিষ্যতে কাজ করতে গেলে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নেব।’ আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকবে।’ পরাজিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারও বলেন, ‘আপনারা সবাই আইভীকে সহযোগিতা করবেন। ... আইভীর পাশে বিপদে আপদে আছি।’ একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বর্ষিয়ান নেতা তৈমূর ভুল করেননি। মানুষের একাংশ তাঁর সঙ্গেও আছেন। ভুল করেছে তাঁর সাবেক ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বিএনপি।

দলটি গণতন্ত্রের রীতিনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠ দিয়েছে। অনেকটাই পলায়নের মতো, ঠিক যেমন পালিয়ে গেছেন বিএনপির বর্তমান প্রধান তারেক রহমান। বিএনপি দলের নেতা তৈমূরকে বহিষ্কার করেছে। তবুও তিনি ভোট পেয়েছেন প্রায় ১ লাখ। বিএনপির কমিশনার পেয়েছে ১০টি। এভাবে পলায়ন দলের জন্য আত্মঘাতী। আর বিরোধী দল না থাকাটা গণতন্ত্র ও দেশের ক্ষতি। জামায়াতের প্রার্থী এবারে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী মাঠে ছিল না। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ঘাতক-দালালদের এই দলটি আসলেই বাংলাদেশের সঙ্গে যায় না। এই দলের সঙ্গে জোট ত্যাগ করে বিএনপি যদি সত্যিকারের সংগ্রামী নেতা সামনে নিয়ে আইভী-তৈমূরের মতো গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে অগ্রসর হয়, তবে জাতীয় চার মূলনীতির একনীতি গণতন্ত্র তথা ভোটের রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫