Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

নারায়ণগঞ্জেও ইভিএম বিতর্ক

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ১০:২০

নারায়ণগঞ্জেও ইভিএম বিতর্ক

আমীন আল রশীদ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী।

তিনিই যে জয়ী হবেন, সে বিষয়ে খুব বেশি শঙ্কা না থাকলেও ভোটের মাঠে নানা মেরুকরণ; বিশেষ করে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের সঙ্গে আইভীর ঠান্ডা লড়াই, বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারের ব্যক্তি ইমেজ, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহীদের কাছে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের বিপুলভাবে পরাজয়সহ নানা কারণে অনেকের হয়তো এটি মনে হয়েছিল যে, নারায়ণগঞ্জেও বোধ হয় নৌকা হেরে যাবে; কিন্তু সেটি হয়নি। বরং আইভী জিতেছেন বিপুল ভোটে। যদিও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নিয়ে। কেন এই বিতর্ক বা ইভিএম নিয়ে অনাস্থার কারণ কী?

ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে কয়েকটি যুক্তি ছিল। যেমন- ১. ইভিএমে দ্রুত ভোট নেওয়া যায় এবং দ্রুত গণনা করে দ্রুত ফলাফল ঘোষণা করা যায়; ২. আগে যেমন ব্যালট বাক্স ব্যালট পেপার ছিনতাই করা যেত, ইভিএমে সেই সুযোগ নেই; ৩. স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স হলেও অনেক ব্যালট পেপারে আগেই সিল মেরে রেখে দেওয়া প্রতিহত করা যায় ইত্যাদি।

এসব যুক্তিতে এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের আমলে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১০ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির মুখে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়; কিন্তু ওই কেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে মামলাও হয়। ইভিএম নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। জটিলতার কারণে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দ্বিতীয়বার নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনেও একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে যায়। এসব কারণে ২০১৩ সালের পর থেকে আর কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি।

২০১৬ সালে এসে কাজী রকিব উদ্দীন কমিশন আগের প্রযুক্তিটি বাদ দিয়ে নতুন প্রযুক্তির একটি ভোটিং মেশিন তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয় ডিজিটাল ভোটিং মেশিন (ডিভিএম)। মেশিনটি তখন কমিশনের সামনে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তা করাও হয়। বলা হয়, মেশিন ভেঙে ফেললেও বা পানিতে ডুবিয়ে দিলেও ব্ল্যাকবক্সের মাধ্যমে প্রদত্ত ভোটের হিসাব পাওয়া যাবে। এরপর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বহু তর্ক-বিতর্কের মধ্যেও ইভিএমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। তখন বিএনপির তরফে আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, ইভিএমে ডিজিটাল কারচুপি হবে।

এবারও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। তিনি ইভিএমকে ‘জালিয়াতির বাক্স’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তাকে পরাজিত করেছে; ফলে তার এই অভিযোগটি হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।

অভিযোগ যিনি করেন, তার দায়িত্ব হচ্ছে অভিযোগটির সত্যতা প্রমাণ করা। না হলে ওই অভিযোগটির গুরুত্ব থাকে না। প্রশ্ন হলো, তৈমূর আলম খন্দকার কি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে যে কারচুপি হয়েছে, সেটি প্রমাণ করতে পারবেন বা সেটি প্রমাণের কি কোনো পদ্ধতি আছে? যদি থাকে তাহলে তিনি কি নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে যাবেন?

প্রশ্নটা এ কারণে জরুরি যে, ইভিএম নিয়ে অতীতেও অনেক প্রার্থীর তরফে অভিযোগ এসেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও এই মেশিনে হবে। সুতরাং কোনো একটি মেশিন যদি সব প্রার্থীর আস্থা অর্জন করতে না পারে এবং প্রার্থীদের মধ্যে যদি এই ধারণা থেকেই যায় যে, ইভিএমএ কারচুপি করা যায়, তাহলে ভোট যত শান্তিপূর্ণই হোক না কেন, আখেরে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। আর ভোট যত শান্তিপূর্ণ হোক, ভোটার উপস্থিতি যতই হোক কিংবা ভোট যত অংশগ্রহণমূলক এবং উৎসবমুখরই হোক না কেন, যে মেশিনে মানুষ ভোট দেবে, সেই মেশিনটি যদি সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাহলে সেই ভোটও বিশ্বাসযোগ্য হয় না।

সুতরাং নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে, ইভিএম নিয়ে সর্বসাধারণের মনে এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে কোনো ধরনের কারচুপির সুযোগ নেই এবং এখানে প্রকৃতই জনরায়ের প্রতিফলন ঘটে; কিন্তু ইভিএম চালুর পর থেকে এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের বিরাট অংশের মনে যে প্রশ্ন, সংশয়, তা দূর করতে নির্বাচন কমিশন খুব বেশি পদক্ষেপ নিয়েছে কখনো। আবার নির্বাচনের বেশ কয়েক দিন আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের মধ্যে এই মেশিনটি নিয়ে খুব বেশি প্রচার করেছে এবং হাতে-কলমে এর ব্যবহার শিখেয়েছে, তা বলা যাবে না।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হলেও ইভিএমের কারণে ভোটদানে ধীরগতি হয়েছে। সেখানে মক ভোটিংয়ের ব্যবস্থা করা হলেও সাড়া কম পাওয়া গেছে। ফলে কেন্দ্রেরলাইনে তাদের বুঝিয়ে দিতে হয়েছে। সেখানে সময় ক্ষেপণ হয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম হওয়ার পেছনেও ভূমিকা রেখেছে। প্রশ্ন হলো, কেন মক ভোটিংয়ে মানুষের খুব একটা সাড়া পাওয়া গেল না? তারা কি ভেবেছিল যে, মেশিনটিতে সহজ ভোট দেওয়া যাবে না বা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লাভ নেই অথবা ভোট আগেই হয়ে যাবে? মানুষ কেন মক ভোটিংয়ে এলো না বা আগ্রহবোধ করল না, সেই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পরাজয়ের তেমন কোনো কারণ ছিল না। নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ মার্কার প্রার্থীও ছিলেন না; কিন্তু তারপরও পরাজিত প্রার্থী যদি সত্যিই এটি মনে করেন যে, ইভিএম হচ্ছে ‘ভোট চুরির বাক্স’ তাহলে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে তার এই বক্তব্যের জবাব দেওয়া। আর তৈমূর আলমেরও উচিত হবে তার অভিযোগটি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে জানানো। না হলে তার এই অভিযোগটিকে নিতান্তই পলিটিক্যাল সুইপিং কমেন্ট এবং পরাজিত প্রার্থীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। আসলে যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য নেই।

মূলত জাতীয়ভাবে যে কোনো মেশিন ব্যবহারের আগে সেটির ব্যবহারবিধি সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া দরকার। আর ভোট যেহেতু ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় এবং গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্তই হচ্ছে, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ফলে সেই নির্বাচনে ভোটাররা যাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন এবং সেই ভোটিং ব্যবস্থাটি নিয়ে যাতে ভোটার বা প্রার্থীদের মনে কোনো ধরনের সন্দেহ তৈরি না হয়, সেজন্য পুরো পদ্ধতিটি স্বচ্ছ রাখা দরকার; কিন্তু অনেক বছর ধরে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার করা হলেও, এখনো এই মেশিনটির বিষয়ে জনমনে পুরোপুরি আস্থাতৈরি হয়নি। এটি নির্বাচন কমিশনেরই ব্যর্থতা। কারণ যে মেশিনে ভোট নেওয়া হবে, সেই মেশিনটির ওপরে যদি শত ভাগ মানুষের আস্থা না থাকে; দশজন ভোটারও যদি সন্দেহ করেন যে, তিনি ভোট দিয়েছেন কলা মার্কায়; কিন্তু সেটি বোধ হয় চলে যাবে তরমুজ মার্কায় এমন সন্দেহ থাকলে পুরো পদ্ধতিইটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং যা প্রশ্নবিদ্ধ করবে আসলে পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাকে।

তবে শুধু সাধারণ ভোটার বা প্রার্থী নয়, একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট ইভিএমের বিরুদ্ধে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তিপত্র) দিয়ে কমিশনের সভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। শুরুতে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আইন করা হলেও, পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই মেশিন ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়; কিন্তু মাহবুব তালুকদার তখন এতে আপত্তি জানান। সুতরাং যে মেশিন নিয়ে কমিশনের মধ্যেই মতানৈক্য ছিল, সেই মেশিন নিয়ে সাধারণ ভোটার বা প্রার্থীদের মনে সংশয় তৈরি না হওয়ার কারণ নেই।

যদিও নির্বাচন কমিশনের তরফে এর আগেও বলা হয়েছে যে, ইভিএমে কারচুপির সুযোগ নেই; কিন্তু নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল যন্ত্রটির কারিগরি দিক নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করা। যারা এই মেশিনটি তৈরি করেছেন তারা যদি এর খুঁটিনাটি দিক নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতেন, এক ধরনের ডেমোনেস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে এ নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর হতো। গণমাধ্যমেও এই মেশিনের বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়নি। যে কারণে এর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়নি। বরং ভুল বোঝাবুঝি রয়ে গেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫