-61fb96e975815.jpg)
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ৬৯ বাংলাদেশির তথ্য হাইকোর্টে জমা দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ইতিপূর্বে দুর্নীতি দমন কমিশনও অর্থ পাচারকারী ৪৩ জনের তালিকা তৈরি করে তা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে জমা দিয়েছে।
২০১৬ সনে পানামা পেপারসে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিজেএস সারাবিশ্বের অর্থ পাচারকারীদের একটি তালিকা প্রকাশ করে; সেই তালিকায় ছিল বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা। ২০১৭ সনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্যারাডাইস পেপারসেও ২৯ বাংলাদেশি পাচারকারীর নাম প্রকাশিত হয়। এই অবস্থায় সুইস ব্যাংক এবং অপরাপর দেশে যারা অর্থ পাচার করেছেন তাদের নামের তালিকাসহ পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছিল হাইকোর্ট।
বহু বছর ধরে বাংলাদেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সত্ত্বেও তা করতে দুর্নীতিবাজরা ভয় পায়; কারণ এত বেশি অবৈধ টাকা সাদা করতে গেলে সকলের নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অসাধু ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ধারণা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তাই অবৈধ উপায়ে গড়ে তোলা তাদের সম্পদের পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয় জরুরি। গ্যাস বা বিদ্যুতের অনেক মিটার রিডারের সম্পদের পরিমাণ দেখলেও ভিমরি খেতে হয়। ঋণ খেলাপি, দুর্নীতিগ্রস্ত বিত্তশালী ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশে বাড়িঘর করে বসবাস করলেও তা বিস্ময়কর নয়, বিস্ময়কর হচ্ছে নির্দিষ্ট আয়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে বাড়িঘর, সম্পত্তি করার খবর। বিনিয়োগ কোটায় দেশ থেকে অবৈধ অর্থ স্থানান্তরিত করে স্থায়ী অভিবাসনের ঘটনা প্রচুর। মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ, এটাকে বলে ‘সেকেন্ড হোম’ স্কিম।
২০১৪ সনে বিনিয়োগ কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার আগে মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার বা এক কোটি ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে যে কেউ কানাডার নাগরিকত্ব পেয়ে যেত। মালয়েশীয়ার সেকেন্ড হোম ভিসা পেতে হলে বর্তমানে এক মিলিয়ন মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ফিক্সড ডিপোজিট রাখতে হয়, আগে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল অনেক কম। সেকেন্ড হোম হিসেবে যেসব বিদেশি নাগরিক মালয়েশিয়াকে বেছে নিচ্ছেন- তাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান তৃতীয়, চীন প্রথম, জাপান দ্বিতীয়। মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোমের ব্যাপারে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করে না।
মিডিয়ায় প্রচারিত কানাডার ‘বেগম পাড়া’র কথা প্রায় সবাই জানে। বেগম পাড়া হচ্ছে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশি অভিবাসী ‘বেগমদের’ বিলাসবহুল আবাসিক অঞ্চল। বাংলাদেশের ধনী ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিবাজ আমলারা দেশে অবস্থান করে; কিন্তু তাদের স্ত্রীরা স্বামীদের প্রেরিত অবৈধ অর্থ দিয়ে সেখানে বাড়িঘর কিনে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন, অবসর গ্রহণের পর দুর্নীতি করার সুযোগ যখন আর থাকে না তখন সাহেবেরাও চলে যান বেগম পাড়ায়। ২০০৭-০৮ সনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হলে এই বেগম পাড়ার উদ্ভব হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের কেনা সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখানো হয়, বিভিন্ন ভিডিওতে বাড়ির মালিকের পরিচিতিও তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন দেশে অসংখ্য অভিবাসী বাঙালি রয়েছে যাদের বৈধ আয়ে ওইসব দেশে সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর হয়েছে। বিদেশে বাড়ি কেনা খুব কঠিন কিছু নয়, অভিবাসীর ক্রেডিট রেকর্ড ভালো হলে এবং বন্ধকীকৃত বাড়ির ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকলে সামান্য পরিমাণ অর্থ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই বাড়ি কেনা সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাদের নাম আসে তাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক পরিবারের লোক, তাই সব তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্যও অনেক সময় এমন প্রপাগান্ডা করা হয়ে থাকে। কিছু অনলাইন টিভিতে সত্যের চেয়ে আজগুবি গল্প বেশী থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত একজন ডেপুটি গভর্নর সম্পর্কে কানাডা থেকে প্রচারিত এক অনলাইন টিভি প্রোগ্রামে যে তথ্যগুলো পরিবেশন করেছে- তার সামান্যতম কোন ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয়নি। তারা বলেছে এই ডেপুটি গভর্নর আঠারো হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, আমেরিকায় তার বাড়ি আছে এবং তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন; কিন্তু শত রকমের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও একজন সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে তার এক জীবনে ১৮ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, তাকে আমি চিনি, তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন, তাকে আমি সৎ ও নিষ্ঠাবান অফিসার হিসেবে পেয়েছি। বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে এমন আজগুবি গল্পের জন্য আসল পাচারকারীরা পর্দার অন্তরালে থাকার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
কারেন্ট অ্যাকাউন্টই শুধু কনভার্টিবল, অর্থাৎ আমদানি ছাড়া আর কোনো খাতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করা বা নেয়া যায় না। বিদেশে লেখাপড়া, চিকিৎসা, ভ্রমণসহ অভিবাসন ফি প্রেরণের ক্ষমতা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর অর্পণ করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাংকে অর্থ রাখা হলে এক সময় তা গ্রাহক ছাড়া আর কারো পক্ষে জানার সুযোগ ছিলো না; এমনও হয়েছে, গোপনীয়তার কারণে গ্রাহকের মৃত্যুর পর ব্যাংকের টাকা তার উত্তরাধিকারীরাও খুঁজে পাননি।
অবৈধভাবে মুদ্রা-মাদকপাচার ও জঙ্গিবাদের মতো অপরাধে অর্থায়ন বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সংগঠন এগমন্ট গ্রুপের ১৬৬টি দেশ একে অপরকে সহায়তা করে যাচ্ছে। কিন্তু এদের প্রদত্ত তথ্য দ্বারা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না, কারণ তাদের দেয়া তথ্যের উৎস প্রকাশ নিষিদ্ধ। এদের কাছ থেকে প্রাপ্ততথ্য শুধু বাংলাদেশে তদন্তকারীর ইন্টেলিজেন্স বা ধীশক্তিকে সহায়তা করবে। প্রাপ্ত তথ্যের উৎস প্রকাশ করা না গেলে সেই তথ্য কোথাও দালিলিক প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয় না। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশে গিয়ে তদন্ত করাও অসম্ভব, কারণ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ছাড়া কোনো দেশ তথ্য দেবে না। বাংলাদেশ চাইলেই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়ে যাবে তাও ঠিক নয়। অর্থ পেয়ে যে দেশগুলো উপকৃত হচ্ছে সেই দেশগুলো তাদের স্বার্থ আগে দেখবে। তাই বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হওয়ার পরও অর্থ পাচার বন্ধ বা হ্রাস করতে পারেনি।
অর্থ পাচারের বহুবিধ পন্থা রয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের পন্থা অনেক পুরানো। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এই অবৈধ পথটি সাধারণ লোকেরাও ব্যবহার করে থাকে। হাজার হাজার বাঙালি বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য গমন করেন, তাদের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনও থাকেন। চিকিৎসার জন্য বৈধভাবে যে টাকা নেয়া হয় তা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত, চিকিৎসা খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে হুণ্ডির মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকার ব্যবস্থা করতে হয়। প্রবাসী শ্রমিকেরা রেমিট্যান্সের সিংহভাগ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠান। তারা যদি হুন্ডির মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে সব টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতেন, তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েকগুণ বেশি হতো। বিদেশে যারা বাড়িঘর করেন তাদের টাকা প্রেরণের আরও বহুবিধ অবৈধ পথ রয়েছে। সরকারের বড় বড় আমলারা ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পান, তারা দেশ বিদেশের আইন-কানুন সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত থাকেন, এরা ভিআইপি পথ দিয়ে বিমানে ওঠেন, এদের বাক্স-পেটেরা কদাচিৎ চেক হয়, বিদেশে এদের বিশেষ ব্যবস্থাধীনে রিসিভ করা হয়।
এছাড়াও ক্ষমতাবান ও দুর্নীতিবাজ আমলাদের বিদেশের অ্যাকাউন্টে পাউন্ড-ডলার জমা দেয়ার ব্যবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরাই করে থাকেন। ব্যবসায়ীরা আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস এবং রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস করে বিদেশে টাকা পাচার করে থাকেন। এ ছাড়াও আমদানির নামে অনেক ভুয়া ব্যবসায়ী এলসি খুলে টাকা পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। পাচার করা টাকা দিয়ে ব্যবসায়ীরা শুধু নিজেদের জন্য বাড়িঘর তৈরি করেন না, দেশের কিছু মন্ত্রী-আমলা-রাজনীতিবিদের ঘুষের টাকাও বিদেশে পরিশোধ করেন। ইন্ডেন্টিং ব্যবসা যারা করেন তারাও তাদের আয়ের সব টাকা দেশে আনেন না।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যতীত আর কোনো পাচার করা টাকা বিদেশ থেকে আনা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু কোকো নয়, এমন কোকো প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই আছে। তাই রাজনীতির মাঠ গরম করার জন্য ‘বেগম পাড়ার’ খবর মাইকে বাজতেই থাকবে, কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হয় না। তবে ইতিবাচক খবর হচ্ছে, কানাডার সাধারণ বাঙালিরা অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যানার এবং পোস্টার দিয়ে মানববন্ধন করেছেন, ‘লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও’। প্রকৃতপক্ষে অর্থ পাচারকারীদের সঙ্গে চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, গজনীর সুলতান মাহমুদ, ইংরেজ আর পাকিস্তানি শোষকদের খুব বেশি পার্থক্য নেই।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক