Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দুঃখে ভরা চা শ্রমিকদের জীবনগাঁথা

Icon

শানু মোস্তাফিজ

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৫৭

দুঃখে ভরা চা শ্রমিকদের জীবনগাঁথা

শানু মোস্তাফিজ

চা শ্রমিক রাষ্ট্রের কাছে প্রায় অদৃশ্য। দুইশ’ বছর ধরে চরমভাবে বঞ্চিত ও অবহেলিত তাঁরা। এই শ্রমিকদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় উন্নত মানের চা বিদেশে রফতানি হয়। জিডিপিতেও রয়েছে বিশেষ অবদান; কিন্তু তারপরও প্রতিদিনের জীবনে তাঁদের অতিক্রম করতে হচ্ছে হাজারো সমস্যা। রয়েছে সংকুচিত ও অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান এবং ভূমির সমস্যা।

স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত, কঠোর দৈনন্দিন জীবনে নেই আনন্দ-বিনোদন ও নিরাপত্তা। রয়েছে শিক্ষা, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাব। এসব বিষয় নিয়ে শানু মোস্তাফিজ-এর কলামে সাজানো হয়েছে চা শ্রমিকদের এক অজানা জীবনগাঁথা।

অবিরাম চেষ্টা ও পরিশ্রম করলে মানুষ সাফল্য অর্জন করেন; কিন্তু এ কথাটির কোনো মূল্য নেই, চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। তাঁরা যথার্থ অর্থেই আলোর বিপরীতে অন্ধকারে বাস করেন। সবুজের সমারোহে অপরূপ সৌন্দর্য্যে ভরপুর চা বাগানগুলোতে মাথায় ঝুঁড়ি নিয়ে যাদেরকে দেখে মানুষ রোমাঞ্চিত হন, সেই সব মানুষের কঠিন ও কষ্টকর জীবনের কথা শুনলে যে কেউই দারুণভাবে আহত হবেন। 

দুইশ’ বছর আগে ব্রিটিশরা সিলেট অঞ্চলের চাবাগানগুলোতে কাজ করার জন্য চা শ্রমিকদের ভারত থেকে নিয়ে আসে। তখন থেকেই বংশ পরম্পরায় চা বাগানগুলোতে প্রায় ৭০-এর অধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন কাজ করছেন। তাঁরা বাংলাদেশে বিশেষভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন অথবা ‘বাধা’ শ্রমিক হিসেবে পরিচিত ও বিবেচিত। প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার চা শ্রমিক, তাঁদের দিন শুরু করেন নানারকম বঞ্চনা এবং কঠিন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে।

চা বাগানগুলোতে কাজ করার নিয়ম হলো শ্রমিকরা অবসরে গেলে, তাঁদের সন্তানরা সেই কাজ পান। এখানে স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের শ্রমিক আছে। স্থায়ী শ্রমিকরা তাদের নামে একটি ঘর, রেশন ও সামান্য (তিন-পাঁচ কেয়ার) জমি পান, যাকে তারা ‘ক্ষেতল্যান্ড’ বলেন। অস্থায়ী শ্রমিকরা শুধু কাজ পায়। রেশন ও জমি পান না। শ্রমিকদের অবসর বা মৃত্যুর পর সেই কাজ, ঘর, রেশন এবং জমি তাদের মনোনীত সন্তান বা উত্তরাধিকারীদের দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মা তাদের কাজ ও জমি সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। এভাবে কেউ বাগানের কাজ, কেউবা জমি পান। 

শ্রমিকরা চা বাগানের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করেন। যে জায়গায় সংঘবদ্ধ হয়ে তারা বাস করেন, সে জায়গাটিকে ‘লেবারলাইন’ বলে। সাধারণত লেবারলাইনগুলো বাগান থেকে খানিকটা দূরে বা বাগানের পাশেই অবস্থিত হয়। লেবারলাইনগুলো সমতল বা টিলার উপর অবস্থিত। চা বাগান, কারখানা, বাগানের নার্সারি, ক্ষেতল্যান্ড, লেবারলাইন সবকিছু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একটি নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর মধ্যে থাকে, যা মূলধারার শহর বা গ্রাম থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। যেখানে বাইরের মানুষদের জন্য প্রবেশ অবারিত নয়। লেবারলাইনে একসঙ্গে অনেকগুলো পরিবার বাস করে। প্রত্যেক পরিবারের সীমানা নির্দিষ্ট থাকে।

সাধারণত একটি ঘরে বাবা-মা, সন্তান এমনকি নাতি-নাতনীসহ আট-দশ একত্রে বাস করতে বাধ্য থাকেন। তাঁদের আবাসন সমস্যা প্রকট। একটি পরিবারের জন্য কোম্পানি কর্তৃক একটি ঘর বরাদ্দ থাকে। বাড়তি ঘর তুলতে কোম্পানির অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে যারা এ কাজের দায়িত্বে থাকেন, তাদেরকে ঘুষ না দিলে কাজ হয় না বলে অভিযোগ করেন শ্রমিকরা। বেশিরভাগ শ্রমিক একই ঘরে গরু-ছাগলসহ বসবাস করে। কয়েকটি পরিবার মিলে একটি নলকূপ ব্যবহার করেন। অনেকের আলাদা বাথরুম ও পায়খানা থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সামান্য উঠানের এক পাশে তাঁরা রান্না করেন। যদিও ব্রিটিশ আমলে তাঁদের ঘরের এক কোণায় চুলা বসানো ছিল। এখনো এর ব্যবহার আছে। 

চা শ্রমিকদের মজুরি কম। তাদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো মাঝে মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও, আবাসন এবং ভূমি সমস্যার বিষয়টি মানুষ সেভাবে জানে না। ২০১৫ সালে সরকার হবিগঞ্চের চান্দপুর এলাকায় একটি বাগানের জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করলে শ্রমিকরা প্রতিবাদে ফুসে ওঠেন। সে সময় তাঁদের ভূমি সংক্রান্ত বিষয়গুলো স্বল্প পরিসরে আলোচনায় এসেছিল। দুইশ’ বছরের অধিক সময় ধরে যেখানে বসবাস করছে তাঁরা বংশ পরম্পরায়, সেখানে বাস করতে পারবে। কিন্তু জমি কেনাবেচা বা এর মালিকানা পাবেন না। কোম্পানীর অনুমতি ও নিয়ম ছাড়া তাঁরা কিছুই করতে পারবে না। 

অনেক সময় বাগান মালিক বা গ্যাস কোম্পানি তাঁদের ক্ষেতল্যান্ড বা জমি নিয়ে নেয়। একটি জমি শ্রমিকরা সত্তর-আশি বছর ধরে ব্যবহার করছিল। একদিন একটি গ্যাস কোম্পানির নজর পড়ে সেই জমির ওপর। এতে বাগান মালিক গ্যাস কোম্পানির কাছে জমিটি হস্তান্তর করে।

এ বিষয়ে শ্রমিকদেও বক্তব্য হলো, ‘শুধু একজনের জমি গ্যাস কোম্পানি নেয়নি। প্রায় আশিজন শ্রমিকের জায়গা পুরোটাই নিয়েছে। এতে আমরা বিপদে পড়েছি; কিন্তু বিনিময়ে বাগান কর্তৃপক্ষ বা গ্যাস কোম্পানি আমাদের কিছুই দেয়নি। এ বিষয়ে বাগানের কাছে আমাদের কোনো দাবি নেই। তবে গ্যাস কোম্পানি যদি আমাদের কিছু দিতো, তাহলে আমাদের খুব উপকার হতো। বাগানের দেওয়া জমিতে আমাদের মালিকানা না থাকলেও, সেটি ছিল আমাদের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল। বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের বাবা-দাদারা জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে সেটা চাষাবাদের উপযুক্ত করেছেন। আমাদের এভাবে বঞ্চিত করা ঠিক হয়নি।’

চা বাগানগুলোতে তাঁদের মতো অনেক শ্রমিক জমি হারিয়ে এ রকম দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। বাগান মালিক শ্রমিকদের জমি অনেক সময় গ্যাস কোম্পানি বা এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা এক শ্রমিকের জমি অন্য শ্রমিককে দিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের বিষয়ে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে ওই সব শ্রমিক পরিবার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। শ্রমিকরা বলেন, ‘আমরাও মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক। আমাদেরও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার ভোগ করার অধিকার রয়েছে। আমরা ভোট দিচ্ছি; কিন্তু আমাদের পক্ষে কেউ কথা বলেন না।’ 

আইনজীবীরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী ওই জমি এখন তাঁদের। এক্ষেত্রে তাঁদের দাবি সংগঠিতভাবে উপস্থাপন করতে হবে এবং এতে আইনগত সহায়তাও প্রয়োজন। রাষ্ট্র যেখানে প্রথাগত অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে, সেক্ষেত্রে তারাও এর মধ্যে আসতে পারে। এটা আইন না হলেও সংবিধানে স্বীকৃত রয়েছে। এ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আইনগত ভিত্তি রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এটা যদি অন্য জাতিগোষ্ঠীর মাঝে স্বীকৃত হয়, তাহলে চা বাগানের ক্ষেত্রে কেনো স্বীকৃত হবে না।

চা শ্রমিক নেতারা বলেন, এগুলো সরকারি জমি। চা বাগানের জমিগুলো সরকারের কাছ থেকে বাগান মালিকরা লিজ নিয়েছে। তাই সরকার প্রত্যেক পরিবারকে পাঁচ শতক জমি দিলে পাঁচ হাজার একর জমি লাগবে; কিন্তু চা বাগানে এর চেয়েও অনেক জমি রয়েছে। এখনই যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দেখা না হয়, তাহলে আগামীতে তা বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। 

শ্রমিকদের অবশ্যই সরকারের প্রভাবশালী মহল এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। এতে তাঁদের কণ্ঠস্বর সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবে। তাঁদের লড়াই করতে এবং আইনগত অধিকার প্রয়োগ করে ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন প্রয়োজন বলে কথা হচ্ছে। চা শ্রমিকরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কেননা তাঁরাও এদের মতো। তাঁদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

(চলবে)

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫