Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বাংলাভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা

Icon

যতীন সরকার

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৪৮

বাংলাভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা

যতীন সরকার

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের প্রাণের ইতিহাস। সে সময়ে এ আন্দোলন যেমন ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছিল- ঠিক তেমনিভাবে গ্রামাঞ্চলেও এর একটি প্রভাব পড়েছিল। নেমেছিল আন্দোলনের ঢল। এখনো যদি আমাদের গ্রামে যাওয়া হয়, এবং আজকের দিনে যারা বয়স্ক রয়েছেন- তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তবে তারা এ বিষয়ে বলতে পারবেন বেশ ভালোভাবে। যেমনটি আমাদের মফস্বল শহর নেত্রকোনায়ও ঘটেছিল। 

১৯৪৮ সালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাই স্কুলে পড়ি আমি। সম্ভবত মার্চের দিকে একদিন আমাদের ক্লাসে নাইন-টেনের ছাত্ররা এসে জানায়, “আমাদের মাতৃভাষা বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের কথিত জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে বলেছেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে চলেছে, সেখানে আমাদের সকলেই ‘না’ ‘না’ জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা কিছুতেই সেটা মেনে নেব না। আমাদের যে মাতৃভাষা বাংলা, সেই মাতৃভাষাই রাষ্ট্রভাষা হতে হবে। পুলিশ অত্যাচার করেছে ছাত্রদের ওপর, আমরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় বের হবো।”

তখন আমরা ছাত্ররা মিলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম স্কুল থেকে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্য মানি মানি না,’ ‘পুলিশের জুলুম বন্ধ কর’- এরকম আরও স্লোগান দিতে দিতে সারা শহর সেদিন প্রদক্ষিণ করেছিলাম। পরের দিন ভোরে নেত্রকোনা  শহরের মুক্তাঙ্গণের মাঠে একটি সভায় মিলিত হই। সে সভায় তীব্র নিন্দা জানান বক্তারা। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে তা আমরা কখনো ভাবিনি। ফলে আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। মানুষকে সচেতন করতে শুরু করি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠকও করি।

তারপরের ঘটনা আমি গ্রামের স্কুলে চলে যাই। ১৯৫২ সাল, আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। আচমকা খবর পেলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাওয়ার জন্য- ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। কিছু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সময়ে রেডিও ছিল না, টেলিভিশনও ছিল না গ্রামে। এজন্যই খবরটার বিস্তারিতভাবে জানা হয়নি তখন। কেবলমাত্র তমদ্দুন মজলিশের ‘সৈনিক’ পত্রিকা ছিল। ফলে এ পত্রিকার মাধ্যমেই খবর পেতাম। এরপর ৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খবর পাই এ হত্যাকাণ্ডের, তারপর বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। পাশের বাজার ছিল বসুর বাজার, সেদিন হাটবারও ছিল। আমরা হাটে পৌঁছে হাটুরেদের বলি- ‘আমাদের ভাষার ওপর পাকিস্তান সরকার উর্দুকে চাপিয়ে দিচ্ছে। এ প্রতিবাদে আমাদের ছাত্র ভাইদের ওপর ওরা বর্বরভাবে গুলি চালিয়েছে, হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে। আমরা এর প্রতিবাদ করব, মানব না আমরা ভাষার বঞ্চনা।’ আমাদের বক্তব্যের আবেগে হাটের অনেক মানুষ কেঁদেছিল সেদিন। 

তারপর আমরা বললাম, আজকে এর প্রতিবাদে গ্রামের এই বাজারে আমরা হরতাল পালন করব। গ্রামের মানুষজন হরতাল কী তা হয়তো চোখে দেখেনি- জানতো না; কিন্তু শব্দটা তাদের পরিচিত ছিল। ফলে আমাদের কথামতো তারাও একবাক্যে মেনে নিয়ে সব দোকান-পাট বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। এভাবেই গ্রামের সাধারণ মানুষ ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়েছিল।

ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত সাংস্কৃতিকভাবে একটি বড় আন্দোলন। কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য তার ভাষার ওপরে আঘাত করলেই পুরোটা শেষ হয়ে যায়। একটা জাতির নিজের ভাষার ওপরে যখন চাপিয়ে দেওয়া হয় অনৈতিক বোঝা, তখন সে মরে যায়। মরে যায় তার কৃষ্টি। ভাষা মরে গেলে সে জাতি কখনো দাঁড়াতে পারে না। আর ভাষা না দাঁড়াতে পারলে তো এমনিই পঙ্গু হয়ে যায় যে কোনো জাতি। বাংলার স্বর, সুরে যে গায়ক গান করেছেন, গান লিখেছেন তারা বাঙালির প্রাণ। লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এঁরা আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত। পাকিস্তান সরকার ’৫২ সালে এই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানতে চেয়েছিল। ভেঙে দিতে চেয়েছিল আমাদের মর্যাদাময় সংগীত, কবিতা আর সর্বোপরি প্রাণের ভাষাকে। আমরা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতাম যদি সেদিন এ আন্দোলন না হতো। আমরা তা হতে দিইনি। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আমরা রক্ষার চেষ্টা করেছিলাম বলেই পরবর্তীকালে আমাদের মানসিক শক্তি অটুট রয়েছে; আমরা পিছিয়ে পড়িনি বিশ্বের অন্যান্য অগ্রসর জাতি থেকে।

কিন্তু আজও ষড়যন্ত্রকারী প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন গোষ্ঠী যেন সক্রিয় হয়ে রয়েছে এদেশে। তারা আজও বাংলা বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। আর এক শ্রেণির অসচেতন মানুষেরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পাঠিয়ে তৃপ্তি পায়। তারা ভাবে না যে, ভাষার জন্য সারাবাংলা একদা কেঁপেছিল- প্রাণ দিয়েছিল আমাদের ভাইয়েরা, গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মতো খেটে মানুষেরাও পিছিয়ে ছিল না সেই আন্দোলনে, তারাও এ আন্দোলনে সাহায্য করেছিল। একাত্ম হয়েছিল আমাদের মিছিলে। তাদের বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন ইংরেজি ভাষায় শিক্ষায় কতটুকু উন্নত হবে আপনার সন্তানের জীবন? যে নিজের ভাষা জানে না সে কী করবে? যার নিজের সংস্কৃতি জানা থাকবে না সে কতটা আপনাকে ভালোবাসবে? যে মানুষ তার ভাষার কীর্তিমানদের না জানে সে নিজেকে গড়বে কী করে? আমি মোটেই অন্য ভাষার বিরুদ্ধে না। তবে নিজের ভাষাকে তো সম্মান করতে হবে, জানতে হবে সংস্কৃতির পুরোটাই।

এজন্য বলি, ইংরেজি ভাষা আগে নয়, আগে আমার মায়ের ভাষা শিখতে হবে। আজকের মিডিয়াগুলোর দিকে তাকান যদি, তারা বাংলা-ইংরেজি গুলিয়ে কথা বলে। উপস্থাপনার নামে এগুলো ঠিক কী হয় তা বুঝে নিতে কষ্ট হয়। ভাষার চর্চা সঠিকভাবে হচ্ছে না সবস্তরে। যে জন্য আমরা পিছিয়ে পড়তে পারি সামনের দিনে। বিদেশি ভাষার কবলেও পড়তে পারি। বিশ্বের দরবারে বাংলাভাষা আন্দোলনের যে একটি সুন্দর ঐতিহাসিক দিক রয়েছে তা দেখা যাবে ম্লান হচ্ছে। এ কারণে বলি, আমাদের ভাষার চর্চা করতে হবে, স্কুল-কলেজ, অফিস আদালত সবখানে। তা না হলে আমরা যে আশা নিয়ে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলাম, সেই আদর্শ থেকে সরে যাবে আগামীর তরুণেরা। 

এ বছর একইসঙ্গে আমরা বিজয়ের পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনা, যার ফল আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ, আলাদা মানচিত্র, আলাদা সংবিধান- এর প্রথম প্রেরণা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। এই সবই সম্ভব হয়েছে কেবল ভাষার জন্য। এ ভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা, এ ভাষা ভুলি কী করে? 

ভাষার মাসে মনে পড়ে আজ এতটা বছর পরে এসে- বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানার প্রতিবাদের মিছিল, সেই আন্দোলনের সময় যারা শহীদ হয়েছিলেন, যারা লড়াই করেছিলেন- তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বিশ্বের দরবারে তারাই আমাদের ভাষার মর্যাদা তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁদের স্মরণ করি শ্রদ্ধা ভরে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫