পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি
হঠাৎ এসে বললো

খন্দকার ইসমাইল
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৫৭
ছবিতে (বাঁ থেকে) খন্দকার ইসমাইল, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুন রশীদ ও সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান হয়ে শান্তি ফেরে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির কল্যাণে। পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পাহাড়িদের একটি সংগঠনের সঙ্গে চুক্তি করে। বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। সেই অনুষ্ঠানে ধারাবর্ণনা করেছিলেন টিভি উপস্থাপক খন্দকার ইসমাইল।
শান্তিচুক্তির ২৪ বছরে সেই স্মৃতি বর্ণনা করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে একদিন অনুষ্ঠান ঘোষণা করছিলাম। হঠাৎ একজন এসে বললেন আপনাকে আলী ইমাম সাহেব ডাকছেন, খুব জরুরী। আলী ইমাম ভাই তখন উপস্থাপনা শাখার অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ ছিলেন। আমি ভাবলাম কোনো ভুল ঘোষণা করলাম কি না? ভয়ে ভয়ে ইমাম ভাই’র রুমে গিয়ে তাঁর পাশের চেয়ারে বসলাম। উল্লেখ্য যে, বিটিভিতে আমার প্রথম পদার্পন এই আলী ইমাম ভাই’র মাধ্যমে। আলী ইমাম ভাই বললেন “এক্ষুনি জি.এম. নওয়াজেশ আলী খান সাহেবের কাছে তোমার বায়োডাটা দিয়ে আস। তোমাকে খাগড়াছড়ি যেতে হবে”। আমি এতক্ষন যে ভয়ের আশংকায় ছিলাম তা কেটে গেল। বায়োডাটা জমা দিলাম সিকিউরিটি পাসের রুমে।
খাগড়াছড়ির কথা শুনে খুব ভালো লাগলো। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা লোকমুখে অনেক শুনেছি, বই-পত্রে পড়েছি। খাগড়াছড়ি একটি নদীর নাম। নদীর পাড়ে খাগড়ার বন থাকায় পরবর্তীকালে তা পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে উঠে, ফলে তখন থেকেই এটি খাগড়াছড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। এখন সেখানেই আমাকে যেতে হবে ভেবে মনে দারুন আনন্দ লাগছে।
বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সময়কার সংঘর্ষ, রক্তপাত, হানাহানির বিবরণ। কিন্তু কি কারণে এত হানাহানি কখনো জানতে পারিনি। বিগত দিনে যারা দেশের ক্ষমতায় ছিলেন তারাও কখনো এই বিষয়টি জনগণকে জানতে দেয়নি। দীর্ঘদিনের এই হানাহানি, রক্তপাত বন্ধের জন্য বহুদিন আগে থেকেই শান্তি বাহিনীর সাথে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরবর্তীতে ৯৬-এ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শাসন ভার গ্রহণ করার পর তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য সমস্যাকে একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে সাংসদ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে চেয়ারম্যান করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করে। এই কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা নামে পরিচিত) ও অন্যান্য সদস্যদের দীর্ঘ আলোচনার পর ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে দীর্ঘ কাঙ্খিত ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি দেশ বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। শান্তি চুক্তির অনেক গুলো শর্তের মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের দিন তারিখ স্থান নির্ধারন করা হবে। তারই ধারাবাহিকতায় ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি পাহাড় টিলা পরিবেষ্টিত সবুজে ঘেরা খাগড়াছড়ি জেলার নবনির্মিত স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমাদানের ঘোষণা দেয়া হয়। ঐ দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৭৩৯ জন সদস্য সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম দফা অস্ত্র জমা দেবে, সূচিত হবে আরো একটি ঐতিহাসিক দিন।
অনুষ্ঠানটিকে সফল করার জন্য চলতে থাকে বিপুল আয়োজন। খাগড়াছড়ির চারদিকে সাজ সাজ রব।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে সরাসরি সম্প্রচার সম্ভব নয়। কথা চলছে কোলকাতা দুরদশনের সাথে। সফল হয়নি আলোচনা। আবারো অনিশ্চয়তা। কিন্তু অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। পুরো জাতির দৃষ্টি খাগড়াছড়ির দিকে।
পরবর্তীতে তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এর প্রচেষ্টায় ৮ই ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর ভিত্তিক একটি কোম্পানীর সাথে চুক্তি হয় সরাসরি সম্প্রচারের। বাংলাদেশ বেতারও সরাসরি সম্প্রচার করবে এই অনুষ্ঠান। ১০ই ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে ঐতিহাসিক অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ধারাভাষ্য সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের, আবেদ খান, শাহরিয়ার কবির, ড. হারুন অর রশিদ এবং সার্বিক উপস্থাপনা ও বর্ণনার জন্য বিটিভি’র পক্ষ থেকে আমাকে নির্বাচন করা হয়। এত বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও ব্যাপক। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে বিটিভি’র নিজস্ব প্রযুক্তির ইতিহাসে এই প্রথম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে। অনুষ্ঠানের গুরুত্ব আরো বেশি উপলব্ধি হলো তখন, যখন তথ্য মন্ত্রনালয়, ডিজি’র অফিস কিংবা কখনো টেলিভিশন থেকে বারে বারে ফোন আসে আমার কাছে। সবার প্রশ্ন একটাই খাগড়াছড়ি যাওয়ার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছি কিনা? কারণ পুরো অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনার দায়িত্ব একমাত্র আমার উপর ন্যাস্ত।
যা হোক অনুষ্ঠানটিকে সফল করার জন্য খাগড়াছড়ি যাওয়ার আগে ৮ই ফেব্রুয়ারি ধারাভাষ্যকার আমরা সবাই সৈয়দ হাসান ইমাম ভাইয়ের অফিসে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মিটিং করে অনুষ্ঠানটি কি ভাবে করবো, কে কি বলবো, কতটুকু বলবো- তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করি। মিটিং এর মাঝে দিয়ে আবার বেশ কিছু মজার মজার গল্পও হয়েছে। যেমন আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১০ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর ধারাভাষ্য দেয়ার সময় হাসান ভাই প্রধানমন্ত্রীর ইন্টারভিউ নেবেন। আবেদ ভাই তখন বললেন, “আচ্ছা হাসান ভাই ধরুন ইন্টারভিউ নেয়ার সময় আপনাকে কেউ গুলি করলো, আপনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন আপনার কাজ আমি কি ভাবে চালিয়ে নিতে পারি বলুন তো?”। হাসান ভাই তখন বললেন, “আমি গুলি খেলে তোমাকে আর অনুষ্ঠান চালাতে হবে না”। আবেদ ভাই মুখ গম্ভীর করে বললেন, “কেন”? হাসান ভাই বললেন, “ছোট বেলায় একটা ধাঁধাঁ আমরা প্রায়ই একজন আরেকজনকে বলতাম, তা হলো একটি গাছে ৬টি পাখি আছে। একটিকে গুলি করলে আর কয়টি থাকবে”। এই কথা শোনার সাথে সাথে আমরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়িতে হাজারো অতিথি যাবেন। এই ছোট্ট শহরে এত লোকের থাকা খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা হবে কি না এ বিষয়ে সবাই সন্দিহান ছিলাম। ম.হামিদ ভাই বললেন (বিটিভি’র অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ), “কোথায় থাকা হবে জানি না, হয়তো সবাইকে কষ্ট করতে হতে পারে” তিনি সবাইকে মশার কয়েল, কিছু শুকনো খাবার, চিড়া, গুড় এবং পানি সাথে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কেউ আবার খাবার স্যালাইন এবং ওষুধপত্র নিয়ে যেতে বললেন। আমার ভেতর এক ধরনের ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। আমি সবার কথা রাখলাম। ৯ই ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় হাসান ভাই’র অফিসের সামনে থেকে আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব। আগের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত জিনিসপত্র গোছালাম, স্লিপিং ব্যাগ, গরম পানির ফ্ল্যাক্স, মিনারেল ওয়াটার, বিস্কুট,জুস, মশার কয়েল, ঔষধ, জামা-কাপড়, সেভিং এর জিনিষপত্র, টুথব্রাশ, ক্রীম, টাই, ব্লেজারসহ আরো অনেক কিছু নিয়ে বড় এক ব্যাগ ভর্তি করলাম। বুঝলাম একজন মানুষ বাইরে কোথাও যেতে হলে কত কিছুর প্রয়োজন হয়, যা ঘরে থাকলে বোঝা যায় না।
ভোর হলো, যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ। আমার স্ত্রী বিলকিস নাহার স্মৃতিসহ এক সাথে বের হলাম। সে মতিঝিলে অফিসে যাবে। আমি বিএমএ ভবনে হাসান ভাই’র অফিসে নেমে গেলাম। সবাই একত্র হলাম। আমাদের যাওয়ার বাহন ছিল ৪টি বড় গাড়ি, ২টি মাইক্রো, ২টি পাজেরো এবং একটি ছটলু ভাইয়ের (আলী যাকের) গাড়ি।
সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। দলের সব চাইতে কনিষ্ঠ সদস্য হলাম আমি। শাহরিয়ার কবির, আবেদ খান, আলী যাকের এক গাড়িতে। সাংবাদিকবৃন্দ এক গাড়িতে, মন্ত্রনালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এক গাড়িতে, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুন অর রশিদ এবং আমি অন্য আরেকটি গাড়িতে। সব গাড়িতেই কিছু কমলা এবং পানীয় বোতল দেয়া হলো। রওয়ানা হবার আগে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো চলতি পথে হাইওয়ে-ইন রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে একসাথে লাঞ্চ করবো। যাই হোক যাত্রা হল শুরু। তখন সকাল ১০টা। ঢাকা শহরের অতি পরিচিত ঐতিহ্যবাহী চিত্রের মুখোমুখি হলাম। প্রেসক্লাব থেকে ডেমরা যেতে এক ঘন্টা সময় লাগলো। যদিও ১৫ মিনিটের পথ। তারপরের পথ ছিলো খুবই আরামদায়ক। গাড়িতে গল্প করতে করতে দুপুর দেড়টা বেজে গেল।
হাইওয়ে ইন রেস্টুরেন্টের সামনে তিনটি গাড়ি থামালাম। ছিমছাম চমৎকার রেস্টুরেন্টের দোতলায় সবাই বসলাম। অন্য গাড়িটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাংবাদিকদের নিয়ে ঐ গাড়িটি ভুলে অন্য এ রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেছে। অবশ্য খাগড়াছড়ি পৌছার আগে পথে তাদের সাথে আর আমাদের দেখা হয়নি। যাই হোক হাসান ভাই খাবারের অর্ডার করলেন। তিনি ভেজিটেবল পছন্দ করেন তার সাথে মাছ, আমিও হাসান ভাইয়ের দেখা-দেখি ভেজিটেবল এবং মাছ নিলাম। এর আগে আমরা সবাই সুপ খেলাম। সবাই খাচ্ছি আর গল্প করছি। অনেক গল্পের মাঝে ছটলু ভাই (আলী যাকের) তার বাবার স্মৃতিচারণ করলেন। তার বাবা একজন আইনজীবি। “দরিদ্র পরিবারের একটি ছেলে তার মাকে বটি দিয়ে আঘাত করলে এলাকার লোকজন ক্ষুব্দ ছেলেটিকে ধরে মারধর করে এবং তার মাকে দিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করায়। সমস্যাটি তাহের সাহেবের (আলী যাকেরের বাবা) কাছে যায়। তিনি মামলাটি অন্যভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এলাকাবাসীর জোর দাবী ছেলের বিচার হতে হবে। তাহের সাহেব ছেলে আর ছেলের মাকে একটি রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করলেন এবং একজনকে বললেন একটি বড় কাঁঠাল নিয়ে আসতে। তিনি দু’জনের সাথেই কথা বললেন। এলাকাবাসীর দাবী ছেলের বিচার চাই। কাঁঠাল আনা হল । তাহের সাহেব কাঁঠাল হাতে নিয়ে একটি গামছা দিয়ে ছেলের পেটে কাঁঠাল বেঁধে এক ঘন্টা হাঁটতে বরলেন। কিন্তু ১০ মিনিট হাঁটার পর ছেলের কষ্ট দেখে মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, ছেলেও মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। তখন তাহের সাহেব হাসতে হাসতে ছেলেকে বললেন তোমার মা ১০ মাস ১০ দিন কষ্ট করে তোমাকে পেটে ধরেছেন আর তুমি তাকে মারতে গেলে। ছেলে মা’র কাছে ক্ষমা চাইলো মা তখন ছেলেকে ক্ষমা করে দিলেন। মামলা তুলে নিলেন”।
এরই মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ। কিন্তু প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল কেউ উঠছে না, অবশেষে আমি বললাম এবার মনে হয় আমরা উঠতে পারি। সবাই সহাস্যে সম্মতি জানালেন। ভাল সময় কাটলো রেস্টুরেন্টে। যাত্রাপথের বিরতি স্থানগুলো এখন আগের চেযে অনেক আধুনিক হয়েছে। আমরা যে যেই গাড়িতে ছিলাম আবার সেভাবে যাত্রা শুরু করলাম।
আমরা কথা বলছি, গাড়ী চলছে দ্রুতগতিতে। পথে একটা বাস পড়ে থাকতে দেখেছি। সম্ভবত কিছুক্ষন আগে দুর্ঘটনা ঘটেছে। মনটা খারাপ হলো। আমি প্রায় সময় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবি। প্রতিদিন আমাদের দেশে এখানে সেখানে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছেই। কত নারী, পুরুষ, শিশু মারা যাচ্ছে। আমরা কেউ তাদের খোঁজ খবর রাখি না। এ বিষয়টা আমরা কখনই ভাবিনা যে, একটা পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী পুরুষ বা মহিলাটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। পরবর্তীতে ওই পরিবারের কী করুণ অবস্থা হয়?
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গাড়ী চলছে হঠাৎ চোখে পড়লো- “বিধ্বস্ত সেতু ধীরে চালান। সড়ক ও জনপদ বিভাগ”। দুঃখ হচ্ছে যেখানে আমরা জানি বিধ্বস্ত সেতু অথচ এই বিধ্বস্ত সেতুটিকে মেরামত করা হচ্ছে না।
গাড়ী চলছে- সড়ক ও জনপদ বিভাগের আরেকটি লেখা চোখে পড়লো ভাষাগত চমৎকারিত্বের জন্য- ‘একেবারে না যাওয়ার চেয়ে দেরীতে যাওয়া ভাল’। লেখাটি দেখে চালককে আস্তে চালাতে বললাম।
ফেনী পার হয়ে আমরা রামগড় দিয়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রামগড়ে চুক্তি বিরোধী ৮/১০ টি কালো পতাকা চোখে পড়েছে। কিছু দুর যাওয়ার পর অনেকগুলো সাদা পতাকা চোখে পড়লো। শংকামুক্ত হলাম। আমি আগে কখনো খাগড়াছড়ি যাইনি। অনেকগুলো পাহাড়, টিল উঁচু নিচু পথ পেরিয়ে আমরা খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ভীষন ভালো লাগছে। হঠাৎ গাড়ী থেমে গেল। ড্রাইভার বললো এটা সবচেয়ে বড় পাহাড়। এ পাহাড়ের উপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হবে। গাড়ীর পানি শেষ। ইঞ্জিন গরম। ঠান্ডা না হওয়ার আগে যাওয়া যাবেনা। আরো ৭/৮ মাইল পথ বাকি। আমাদের সাথে অন্যরা আগেই চলে গেছে। কি করি, কোথায় পানি পাবো! হাসান ভাই, হারুন আমরা সবাই চিন্তিত। ১০/১৫ মিনিট পর রোডস্ এ্যান্ড হাইওয়ের ২টি ট্রাক আমাদের ক্রস করে যাওয়ার সময় হাসান ভাইকে দেখেই গাড়ী থামালো। হাসান ভাইকে তারা সবাই চেনে, তাদের পছন্দের শিল্পী, কিন্তু আমি বা হারুন স্যারকে কেউ চেনে না। যা হোক তারা গাড়ী থামিয়ে আমাদের গাড়ীর জন্য পানি এনে দিল দুই বালতি। আধা ঘণ্টা পর আমাদের গাড়ী পাহাড়ের উপর দিয়ে যাত্রা শুরু করল। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহরের নবনির্মিত স্টেডিয়াম দেখতে পেলাম। এর মধ্যে হাসান ভাই এই পাহাড়ী এলাকার তার চলচ্চিত্র জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
খাগড়াছড়ি শহরে ঢুকতেই ট্রাফিক আমাদের গাড়ী থামালো। কিন্তু দুরেই দেখতে পেলাম ৩/৪ টি আর্মির গাড়ী, আর তার পেছনে আসছে ১৪/১৫ টি বড় বাস। কাছাকাছি আসতেই তারা হাত বাড়ালো-আমরাও হাত উচিঁয়ে তাদের অভিবাদন জানালাম। এরাই জনসংহতি সমিতির সদস্য। আগামীকাল অস্ত্র জমা দেবে। তাদের পেছন পেছন আমাদের গাড়ীও চললো। তারা স্টেডিয়াম অভিমুখী, আমরা প্রেসক্লাব। তখন বিকাল ৫টায় প্রেস ক্লাবে গিয়ে দেখি আগামীকালকের অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাংবাদিকদের মাঝে মত বিনিময় হচ্ছে। আমরাও সেখানে যোগ দিলাম। সেখানে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়িদ, বিটিভির ডি.জি সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, ডি.ডি.জি. মোস্তফা কামাল সৈয়দ ও বেতারের ডি.জি.এম. আই. চৌধুরীসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা থেকে আমরা যে কয়জন রওয়ানা করেছিলাম, প্রেসক্লাবে সবাই একত্রিত হলাম। এবার আমাদের জন্য থাকার জায়গা খোঁজা শুরু হলো। তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়িদ এর নেতৃত্বে এক বাসা দেখতে গেলাম। সেখানে উল্লেখ্য যে, ১০ তারিখের অনুষ্ঠান কে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে সবগুলো সরকারি কোয়াটার খালি করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি, নানার বাড়ি, দাদার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের এই সাময়িক কষ্টের জন্য আমরা দুঃখিত।
যাহোক দোতলা বাড়িতে আমরা সবাই গেলাম। সবারই মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। বাঁধ সেধেছেন ছটলু ভাই (আলী যাকের)। সমস্যা একটা, তাঁর হাই কমোড চাই। স্থানীয় ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে খোঁজা শুরু হলো হাই কমোড ওয়ালা বাসা। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোথাও পাওয়া গেলোনা। এরই মধ্যে রাত ৮টা বেজে গেল। পরে আলী যাকের, রুনু ভাই(আবেদ খান) এবং শাহারিয়ার কবির হাই কমোডের সন্ধানে সম্ভবত রাঙ্গামাটি চলে গেলেন। আমি হাসান ভাই, ড. হারুন থেকে গেলাম অন্য একটি দোতলা বাড়ীর নীচ তলায়। দুটো রুম তিনটি খাট। হাসান ভাই সিনিয়র মানুষ উনাকে একটা বাথরুমসহ সিঙ্গেল রুমটি দিয়ে, আমি ও ড. হারুন অপর রুম নিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে রুমে গল্প করতে বসলাম। এর মধ্যে একজন ম্যাজিষ্ট্রেট আমাদের খোঁজ নিলো। আমাদের পাশের বাসায় স্থানীয় স্কুলের হেড মাষ্টার থাকেন। তিনি তার বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ২ ছেলে মেয়ে। ছোট ছেলের বয়স ৭/৮ বছর মেয়েটি সম্ভবত দশম শ্রেনীর ছাত্রী। হাসান ভাই একজন বড় মাপের শিল্পী। মেয়েটি হাসান ভাইকে দেখে ভীষন খুশী হলো। আর আমাকে অনুষ্ঠান ঘোষনায় দেখেছে বলে জানাল। মেয়েটি ছোটবেলায় ভাল নাচ করতো। বছর দুয়েক আগে ছাদ থেকে পড়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে এখন আর নাচতে পারে না- হাসান ভাইকে জানাল। হাসান ভাই চা খেতে চাইলেন সাথে সাথে চা করতে চলে গেল।
কিছুক্ষন পর গাড়ী আসবে আমাদের সার্কিট হাউজে নিয়ে যাবে। ডিনার ও মিটিং হবে। এরই মধ্যে হাসান ভাইকে বলে কিছুক্ষনের জন্য বাইরে যেতে চাইলাম। ঢাকা থেকে শুনেছি এখানে সুন্দর সুন্দর উপজাতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। হাসান ভাই বললেন-‘খন্দকার We Are On Duty তাড়াতাড়ি চলে এসো’। আমাদের রেস্ট হাউজ থেকে আধা কিলোমিটার এর কম দুরে শহরের বেশ কয়েকটি ভাল দোকান। সেখানে যাবো। সাথে নিচ্ছি আমাদের কেয়ার টেকার চান্দু কে (চাকমা)। দ্রুতগতি তে ছুটলাম দোকানে। একটা দোকানে ঢুকতেই আমার মনে হলো আমি ঢাকার কোন দোকানে । আমার সামনেই নৃত্য শিল্পী নীপা, শিবলীসহ আরো অনেকে। আগামীকাল স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে তারা নাচ পরিবেশন করবে। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে কেনাকাটায় মনোযোগ দিলাম। সময় বয়ে যাচ্ছে হাসান ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে তাড়াতাড়ি রুমে ফিরতে হবে। একটা বেড শীট, মেয়েদের একটা জামা, আমি পছন্দ করলাম। ভাবলাম জুতো ছাড়া বাকী জিনিসগুলো খাগড়াছড়িতে তৈরি। প্যাকেট করার পর দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম এগুলো এখানেই তৈরি তো? দোকানি বললো এগুলো কুমিল্লা থেকে আনা খদ্দেরের তৈরি। মনে বড় দুঃখ পেলাম। কি আর করা প্যাকেটগুলো নিয়ে দ্রুত রুমে ফিরলাম।
রুমে গিয়ে দেখি হাসান ভাই, ড. হারুন নেই। গাড়ী এসেছে আমার জন্য ১০ মিনিট অপেক্ষা করে চলে গেছেন। আমি পোষাক বদলিয়ে রিক্সাযোগে সার্কিট হাউজ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখি একজন ম্যাজিষ্ট্রেট এসেছে গাড়ী নিয়ে। আমাদের খোঁজ নিতে। তাঁর সাথে সার্কিট হাউজে গেলাম। অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য হাসান ভাইকে স্যরি বললাম। হাসান ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে কনফারেন্স রুমে ডাক পড়লো। সেখানে উপস্থিত আছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়িদ, স্থানীয় সাংসদ ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাথে সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুনুর রশিদ ও আমি। আলোচ্য বিষয় আগামীকাল অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, বর্ণনা করবেন সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের (ইংরেজীতে), শাহারিয়ার কবির, আবেদ খান ও ড. হারুন। মিটিং শেষে সার্কিট হাউজে ডিনার শেষ করে রাত ১১:৩০ মিনিটে রুমে গেলাম।
হাসান ভাই ড. হারুন ও আমি আধা ঘণ্টা আলোচনার পর হাসান ভাই ঘুমাতে গেলেন। ড. হারুন তাঁর বক্তব্য তৈরিতে ব্যস্ত। আমি ধারাবাহিকভাবে পুরো অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট তৈরিতে ব্যস্ত। আমার উদ্দেশ্য আগামীকাল অনুষ্ঠান ভাল করতে হবে। সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি খাগড়াছড়িতে। সরাসরি সম্প্রচার হবে। এতটুকু ভুল করা চলবে না। আমার স্ক্রিপ্ট হারুন স্যার কে শুনালাম। স্যারেরটা আমি শুনলাম। রাত প্রায় দেড়টার দিকে শুয়ে পড়লাম। মশক সঙ্গীত ও নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বেশ কয়েকবার স্প্রে করা হলো। ওখানকার মশাগুলোর জীবনীশক্তি অনেক বেশি, হতে পারে পাহাড়ি ট্রেনিংপ্রাপ্ত। কারন স্প্রে করার পর মশাগুলো সেন্সলেস হয়ে ছিল, ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার শুরু করে আক্রমণ। আবার স্প্রে-তেও ভেজাল থাকতে পারে। কিন্তু ভেজাল নাই মশার কামড়ে। যাই হোক শান্তিচুক্তির বিষয় মশারা জানে না, কাজেই অশান্তি করার অধিকার তাদের আছে।
সকাল ৭টায় ঘুম থেকে তিনজনই উঠে তৈরি হলাম। পাশের বাসার হেডমাষ্টারের সেই মেয়েটি আবারো চা করলো। আমার ব্যাগে বিস্কুট ছিল, সেটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সার্কিট হাউজে গেলাম। সেখানে নাস্তার বিরাট আয়োজন। ড. হারুন বললেন হাসান ভাই আর না খেলে চলবে। হাসান ভাই হাসতে হাসতে বললেন ‘আরে ভাই খেয়ে নিন, সময়মত উটের মত কাজে লাগাবে। আমি অবশ্য খাওয়ার পক্ষেই ছিলাম। নাস্তার টেবিলে বসলাম পরটা, ডিম, ভাজি, পাউরুটি। তৈলযুক্ত পরটা না খেয়ে তিন জনই পাউরুটি, ভাজি, ডিম নিলাম। ড. হারুন ১টা ডিম, ভাজি, পাউরুটি নিলেন, হাসান ভাই আবার ডিমের কুসুম খান না। সাদা অংশ নিয়ে আমাকে দুটো ডিমের কুসুম দিলেন। নাস্তার পর রওয়ানা করলাম স্টেডিয়ামে। পথে পথে হাজার হাজার নারী পুরুষের ভীড়ে অতি কষ্টে ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ী স্টেডিয়ামের গেটে পৌঁছালো। চারিদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে জোয়ারের মত। উৎসবমুখর পরিবেশ।
মেটাল ডিটেক্টর পেরিয়ে আমরা ভেতরে গেলাম সকাল ৮:৩০ মিনিটে। সেখানে বিটিভি’র ডি.জি., ডি.ডি.জি, হামিদ ভাই ও রিয়াজ উদ্দিন বাদশা ভাই (প্রযোজক) এর সাথে অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আলোচনা সেরে নিলাম। তখনো আলী যাকের, আবেদ খান, শাহারিয়ার কবির এসে পৌঁছাননি। অনুষ্ঠানসূচি নিয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা সেরে নিলাম। বেলা ১০টা মূল মঞ্চের পাশে আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসলাম। ততক্ষন আলী যাকের, আবেদ খান, শাহারিয়ার কবির এসে পৌঁছালেন। এদিকে হাজার হাজার দর্শকে নবনির্মিত স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ। মাঠের পূর্ব দিকে সেনাবাহিনীর বাদক দলের পরিবেশন চলছে। টি.ভি. ক্যামেরা, মাইক্রোফোন সব পরীক্ষা করে দেখলেন। সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনা ততই বাড়ছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, সাংসদবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীগন সহ বিদেশী কুটনীতিকরাও উপস্থিত হয়েছেন।
ঠিক পৌনে ১১টায় স্যাটেলাইট কানেকশান পাওয়া গেল। আমাকে বলা হলো মূল অনুষ্ঠান শুরু করতে। আমি স্টেডিয়ামের সকল দর্শক এবং টি. ভি. সেটের সামনের সকল দর্শকদের অভিনন্দন আর সাদর আমন্ত্রন জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলাম। কিছুক্ষন বলার পর আবেদ ভাইকে মাইক্রোফোন দিলাম। তিনি কিছুক্ষন পটভূমি বলে ড. হারুনকে দিলেন। একে একে হাসান ভাই, আলী যাকের, শাহারিয়ার কবির সবাই বলার পর আবার আমি কিছুক্ষন স্টেডিয়ামের বর্ণনা দিলাম। এভাবে চলতে থাকলো কিছুক্ষন।
হঠাৎ শুনতে পেলাম সেনাবাহিনীর বাদক দল উপজাতীয় সঙ্গীতে একটি চমৎকার সুর বাজাতে শুরু করেছে। সাথে সাথে স্টেডিয়ামের গেট দিয়ে আজকে যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান তারা অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে একে একে মাঠে প্রবেশ করতে শুরু করলো। মাঠের মাঝখানে তাদের জন্য যেখানে নির্ধারিত আসন ছিল সেখানে গিয়ে তারা বসলো। দর্শক করতালি দিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে প্রবেশ করলো জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সৈন্যরা সাথে সাথে ঘোষণা দিলাম টি.ভি.র দর্শকদের বিষয়টি তাৎক্ষনিক অবগত করলাম। এরই মধ্যে শুনতে পেলাম বাংলাদেশ বেতার থেকেও আমাদের কথাই সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। শুনেই ভালো লাগলো।
তার মানে আমাদের মাইক্রোফোন থেকে একই সাথে স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিতে অভূতপূর্বভাবে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে। যাক সে কথা, জনসংহতি সমিতি সদস্যদের মাঠে প্রবেশ শেষ হওয়ার পর, তারা সকলে সামরিক কায়দায় মাঠে তাদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসেছে। এরই মধ্যে একজন এসে আমাকে বললো, জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জোতিরিন্দ্র মাঠে প্রবেশ করেছেন। সাথে সাথে আমি সে ঘোষণা প্রচার করে দিলাম। আলী যাকের সাহেব ইংরেজীতে ঘোষণা করলেন। একদিকে আমরা স্টেডিয়ামের চিত্র তুলে ধরছি বর্ণনার মাধ্যমে। অন্যদিকে বাদক দলের বাজনা আর কানায় কানায় পূর্ণ স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষ। গ্যালারিতে দর্শক আর উঠতে পারছে না। মাঠের বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে। সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখন আসবেন।
কিছুক্ষন পর বাদক দল জয় বাংলা, বাংলার জয় গানটির সুর বাজাতে শুরু করলো। আবেদ সাহেব ৭১-এ গানটির ভুমিকা সম্পর্কে কিছুক্ষন বললেন। এরই মধ্যে খবর এলো প্রধানমন্ত্রী আসছেন। সাথে সাথে আমি প্রধানমন্ত্রীর আগমনবার্তা ঘোষণা করে দিলাম। তিনি স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন। সবাই দাঁড়িয়ে এবং করতালির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানালেন। মঞ্চে আসন গ্রহনকারী অন্যান্য অতিথিদের নাম আমি একে একে ঘোষণা করলাম।
এরপর ঘোষণা করলাম-সুধী দর্শকবৃন্দ এখন জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হবে- আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম শুরু হলো জাতীয় সংগীত। এরপর কোরআন তেলোয়াত, গীতা পাঠ, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ শেষ হলো। এরপর ঘোষণা করলাম- সুধীবৃন্দ এখন মূল্যবান ভাষন প্রদান করবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁর অক্লান্ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই ১০ই ফেব্রুয়ারি। সুধীবৃন্দ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী .. .. আলী যাকের সাহেব ইংরেজীতে ঘোষণা করলেন।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষনে তিন পার্বত্য জেলার অনেক সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। শান্তির পতাকাতলে একত্রিত হবার আহবান জানালেন এবং অস্ত্র জমাদানকারী সকল সদস্যকে সাদরে বরণ করে নিলেন। প্রধানমন্ত্রী ভাষন শেষ করলেন।
এরপরই ঘোষণা করলাম সুধী দর্শক এখন সুচিত হচ্ছে বহু কাঙ্খিত সেই ঐতিহাসিক মুহুর্তটি, যে মুহুর্তটির জন্য খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে সমগ্র দেশবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট অস্ত্র জমাদান পর্ব। হাসিমুখে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক দাড়িয়ে করতালির মাধ্যমে শান্তির পক্ষে সম্মতি জানালো এবং এই ঐতিহাসিক মুহুর্তটিকে আরো প্রানবন্ত আকর্ষনীয় করে তুললো। প্রধানমন্ত্রী সন্তু লারমার হাতে একজোড়া সাদা গোলাপ তুলে দিলেন। সুচিত হলো শান্তির আরেক নব দিগন্ত।
প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথির সাথে সন্তু লারমা মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। এরপর ঊষাতন তালুকদারের নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির ৭ শত ৩৯ জন সদস্য নির্ধারিত স্থানে অস্ত্র জমা দিল। আরেকটি ঘোষণা দিলাম। প্রধানমন্ত্রী শান্তির পায়রা উড়িয়ে দিলেন খাগড়াছড়ির উন্মুক্ত আকাশে। একই সাথে গ্যালারী থেকে রং বেরঙের বেলুন উড়ানো হলো- সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। প্রধানমন্ত্রী জমাকৃত অস্ত্র পরিদর্শনে গেলেন এবং সমিতির সদস্যদের সাথে কুশল বিনিময় করে মঞ্চে আসন গ্রহন করলেন। এরপর শুরু হলো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের আয়োজনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পরিবেশনায় ঢাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগীত ও নৃত্য শিল্পীদের অংশ গ্রহনে শামীম আরা নীপার পরিচালনায়-আনন্দ সংগীত ও দলীয় নৃত্য। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন আজাদ রহমান, মহাপরিচালক (শিল্পকলা একাডেমী)।
ঐতিহাসিক দিনটির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের স্থান থেকে বিদায় নিলেন। স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শক ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে বাড়ঈ ফিরতে শুরু করলেন। মাঠের মাঝখানে তখন ও সারিবদ্ধভাবে বসে আছে জনসংহতি সমিতির অস্ত্র জমাদানকারী ৭৩৯ জন সদস্য। প্যাভিলিয়ন থেকে আমাদের ঘোষণা মঞ্চের দিকে এগিয়ে এলেন গোলাম কুদ্দুস (জেনারেল সেক্রেটারী) সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তিনি সকাল ১১টায় হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে অন্যান্যদের সাথে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তাঁর সাথে কুশল বিনিময় করে হাসান ভাই, ড. হারুন, গোলাম কুদ্দুস ও আমি জনসংহতি সমিতির সদস্যদের সাথে কথা বলার জন্য মাঠের ঠিক মাঝখানে গেলাম। হাসান ভাই, আমি ৩/৪ সদস্যর সাথে হ্যান্ডশেক করতে চাইলে তারা অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে হাত এগিয়ে দেয়। নাম জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না। ধরে নিলাম তারা আমাদের কথা বোঝেনি যেহেতু তারা গভীর জঙ্গল এ বাস করতো। সাধারন মানুষের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ তাদের হতো না। তাদের চোখে মুখে দেখেছি হতাশা, ভয়, আতংক। মনে হয়েছে তারা বিশ্বাস করতে পারছে না যে, তাদের কে সরকার সাধারণ ক্ষমা করেছে। তাদের চাকুরী দেয়া হবে মাথাপিছু ৫,০০০/- (পাঁচ হাজার) টাকা.. .. ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সদস্যদের মধ্যে যারা অস্ত্র জমা দেয়নি বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়নি হয়তো এদেরকে বলেছে, অস্ত্র জমা দিলে সরকার সবাইকে একসাথে মেরে ফেলবে। আর সে জন্য তাদের চোখে মুখে এত আশংকা।
সবাই মাঠ ছেড়ে যাচ্ছে যে যার মত করে। আমরাও বের হতে শুরু করলাম।
মাঠের বাইরে এসে দেখি মামুনুর রশীদ (নাট্যকার ও অভিনেতা) হাসান আরিফ, আফজাল হোসেনসহ পরিচিত আরো অনেক। সবাইকে একসাথে দেখে মনে হলো যেন টি.এস.সি. তে আছি। টি.এস.সি. তে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সাংস্কৃতিক অংগনের প্রায় সব ব্যাক্তিত্বরা একত্রিত হন।
আমি, হাসান ভাই, ড. হারুন আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত গাড়ীর সন্ধানে ছুটলাম হাজারো মানুষের ভীড় আর ধুলাবালি উপেক্ষা করে। এর মধ্যে গোলাম কুদ্দুস বললেন তিনি আমাদের সাথে যাবেন। অনুষ্ঠানের দিন সকালে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে বা বিমান যোগে এসেছে অনুষ্ঠান শেষ হলে আবার তাদের জন্য নির্ধারিত বিমান বা হেলিকপ্টারের ঢাকায় ফেরার কথা। হাসান ভাই, কুদ্দুস ভাই কে বললেন তুমি হেলিকপ্টারের আরামের জার্নী ছেড়ে আমাদের সাথে মাইক্রোতে যেতে চাচ্ছো কেন? কুদ্দুস ভাই তখন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে খাগড়াছড়ি আসার বর্ণনা দিলেন এভাবে। হাসান ভাই আমি আগে কখনো হেলিকপ্টারে উঠিনি- এই প্রথম। সবাই বসলাম, এরপরই দেখলাম একজন এসে দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিলেন। পরক্ষণেই দেখলাম একই লোক চালকের আসনে বসলো। ভাবলাম তাকে হেল্প করার মতো কেউ নেই? খুব দুঃখ হলো। স্টার্ট হলো হেলিকপ্টার উপরে উঠতে লাগলো। অনেক উপর দিয়ে আমরা উড়ে যাচ্ছি আর ভাবছি খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙামাটি তিন পার্বত্য অঞ্চলের কথা। দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সমস্যার একটা সফল সমাধান হতে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য আজ স্বচক্ষে দেখবো। ততক্ষণে আমরা অনেক উপরে। হঠাৎ দেখি পাইলট আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সবার খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছে। পাইলটের আসনে তাকালাম, আসন শুন্য। আমি চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম। হেলিকপ্টার দ্রুত চালিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন রীতিমত ঘামছি। এ কি করে সম্ভব। আমরা এখন কার নিয়ন্ত্রনে যাচ্ছি, কী ভাবে যাচ্ছি। আদৌ যেতে পারবো কি না? যা হোক শেষ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি এসে পৌছালাম। আপনাদের সাথে দেখা হলো- তবে আমি আর হেলিকপ্টারে যাবো না। আপনাদের সাথে চার চাকায় পাহাড় পর্বত দেখতে দেখতে যাবো। (পুরো বর্ণনা নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়) কুদ্দুস ভাইয়ের বর্ণনা শুনে আমরা আর না করতে পারিনি। চারজনই মাইক্রোতে বসলাম। প্রথমেই গেলাম রাতে যেখানে ছিলাম সেখানে। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে কিছু খাবার খেয়ে নিলাম। কুদ্দুস ভাই বললেন দুপুর বেলা ভালো ভালো খেতে পারলে ভালো হতো। একটু ঘুমাতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল তখন। গতকালের ৮/৯ ঘণ্টা জার্নি, রাতভর আগামী দিনের স্ক্রিপ্ট তৈরি, সকাল ৭টায় উঠে ৮টায় অনুষ্ঠান স্থানে উপস্থিত, বেলা ২টা পর্যন্ত রোদে বসে অনুষ্ঠান পরিচালনা, সবকিছু মিলেমিশে সবাই ক্লান্ত। বিশ্রাম নেয়া আর হলো না। কারন, আর কিছুক্ষন পরেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে।
বিরোধী দল ই.ঘ.চ. সহ সাত দল ১০ই ফেব্রুয়ারী শান্তি চুক্তি কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিভাগে হরতাল ডেকেছে। কিন্তু খাগড়াছড়িতে হরতালের ছোঁয়া লাগেনি। হাসান ভাই বললেন চলো সবাই সার্কিট হাউজে যাই। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হবো। সার্কিট হাউজে গিয়ে দেখলাম দুপুরের খাবারের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। সার্কিট হাউজ পাহাড়ের উপর। খাগড়াছড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। চমৎকার ছিম-ছাম সার্কিট হাউজ। একদিকে কনফারেন্স রুম অন্যদিকে ডাইনিং রুম। চারজনই বসে গেলাম খাবার টেবিলে। কুদ্দুস ভাইয়ের ডাল ভাতের স্বপ্ন হলো সত্যি। ভাতের পরে ডাল। শীতাতপ বিল্ডিং ডাইনিং রুমের পাশে বিশাল কনফারেন্স। সেখানে আমরা প্রায় কুড়ি মিনিট বিশ্রামের সময় ঢাকায় ফেরার সময় নির্ধারন করি এবং আজকের অনুষ্ঠানের ভুল ত্রুটি নিয়ে খুটিনাটি আলাপ শেষে ঠিক ৩:৩০ মিনিটে সার্কিট হাউজ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই।
গাড়ী চলছে কয়েক ঘণ্টার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে লাগল। খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজ থেকে মাইল খানেক বা তারও কম রাস্তা পার হয়ে সবচেয়ে বড় পাহাড় দিয়ে যেতে হয়। আমরাও যাচ্ছি পশ্চিম দিকে। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো খাগড়াছড়ি দেখায়। দালান কোঠা সব কিছু অনেক নিচে ছোট ছোট দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে ছোট বড় গাছ গুলোর পাতায় সূর্যের সোনালী আলো চিকচিক করছে। হাসান ভাই বললেন, কুদ্দুস তুমি হেলিকপ্টারে গেলে এই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারতে না। আমি তো আমার আরামের Journe ত্যাগ করে আপনাদের সাথে পাহাড় পর্বত পার হয়ে যাচ্ছি বললেন কুদ্দুস ভাই। আমি বললাম ‘আপনার এই ত্যাগ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে’ হেসে উঠলেন সবাই। হাসান ভাই বললেন-তুমি তো ভয়ে হেলিকপ্টারে যাওনি।
দ্রুতগতিতে চলছে আমাদের মাইক্রো। পাহাড়ী এলাকার উঁচু নিচু পথ পেরিয়ে আমরা রামগড় পার হয়ে বিশ্ব রোডে এসে পড়লাম। তখন সূর্য ডুবু ডুবু। গাছ গাছালীর ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশ্ব রোডে উঠে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। বাকি পথ কোন প্রকার ঝাকুনী ছাড়া পার হওয়া যাবে। বিশ্ব রোডে উঠে পাশের গ্লাসটি নামিয়ে দিলাম। দুরে অন্ধকার মাঝে মাঝে মধ্যে আলো দেখায়। দুরে অনেক দুরে। গাছ-পালা দ্রুত পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে।
নীরবতা ভেঙে হাসান ভাই আবার তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের কথা শুরু করলেন। অনেক কথার মাঝে ৬০-এর দশকের চিত্র নায়ক আজিমের তখন একটা বক্স ওয়াগন ছিল। আমরা দুজন যাচ্ছিলাম পুরনো ঢাকার সরু রাস্তা দিয়ে। ড্রাইভ করছিলো আজিম। আমি পাশের সীটে। আজিম একটু অন্যমনস্ক হলো। আর তখনই ঘটলো বিপত্তি। আমাদের গাড়ির ধাক্কায় সামনের রিক্সা চালক রাস্তায় ছিটকে পড়লো। আকস্মিক এই ঘটনায় আমরা দু’জনেই হতভম্ভ হয়ে পড়লাম। আশে পাশের মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আজিম গাড়ী থেকে নেমে রিক্সাচালককে ‘করো কি মিয়া রাস্তায় রিক্সা চালাও একটু দেখে শুনে চালাতে পারো না। তোমাদের জন্য তো রাস্তায় গাড়ী বের করা যাবে না’। রিক্সাচালক এবং আশে পাশের মানুষ কার ভুলের কারনে এই দূর্ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই আজিম গাড়ী স্টার্ট দিয়ে দ্রুত প্রস্থান। না হলে সে দিন গণধোলাই খেতে হতো।
আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফেনীতে যাত্রা বিরতি, চা পান করতে। পুনরায় ফেনীতে সে রেস্টুরেন্টের সামনে আমাদের গাড়ী থামলো সেখানেই আলী যাকের, আবেদ খান ও শাহরিয়ার কবির তিনজনের সাথেই দেখা। উনারা আমাদের আগেই রওয়ানা হয়েছিলেন খাগড়াছড়ি থেকে। যা হোক কিছু কথা হলো তারপর তাঁরা তিনজন রওয়ানা হলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। আমরা চায়ের অর্ডার দিলাম। কুদ্দুস ভাই এর বমি বমি ভাব তিনি চা খাবেন না- একটা এভোমিন ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। এরই মধ্যে ফেনী কলেজের কয়েকজন ছাত্র এগিয়ে এলো- বিশেষ করে হাসান ভাইকে দেখে। হাসান ভাই এর আগে বেশ কয়েকবার ফেনী কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসছেন। ছাত্ররাও হাসান ভাইয়ের পরিচিত। আর হাসান ভাইতো সর্ব পরিচিত। সবাই আজকের অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানের প্রশংসা করলো, প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে। আমাদেরও তাই । চা খাওয়া শেষ হলো, কিন্তু বিল দিলেন হাসান ভাই। বেরিয়ে আসলাম গাড়ীতে উঠবো, এমন সময় একজন ছাত্র বললো একটু দাঁড়ান প্লীজ। আপনাদের সাথে কয়েকটি ছবি তুলবো, ফটোগ্রাফার আসছে। স্ন্যাপ নেওয়া হলো কয়েকটি। ছাত্রদের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে বসলাম। এবার কুদ্দুস ভাই সামনের আসনে চালকের পাশে। আমি, হাসান ভাই ও ড. হারুন মাঝখানের আসনে বসলাম।
যাত্রা শুরু বৃহত্তর নোয়াখালীর বর্তমান ফেনী জেলার উপর দিয়ে। আমার বাড়ী নোয়াখালী জেলার মাইজদীতে। ফেনী অতিক্রম করার সময় বাড়ীর কথা মনে পড়লো। দীর্ঘ দিন নানা কাজের চাপে বাড়ি যাওয়া হয় না। একে একে বাড়ির সবার কথা মনে পড়তে লাগলো। হঠাৎ গাড়ীর ব্রেক বাস্তবে ফিরে আসি। শুনলাম আমরা একটা মারাত্মক দূর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছি। আমার এক সহপাঠী বন্ধু বলেছিলো চালকের অদক্ষতা, অসতর্কতা ও নানাবিধ কারনে লং ড্রাইভে গেলে ৮/১০ বার দূর্ঘটনায় পড়তে হয় এবং তাই হলো। আমরাও বেশ কয়েকবার .... থাক এখনো অক্ষত আছি। হঠাৎ সামনে চিৎকার ভাংচুর দেখে আমাদের গাড়ী থামলো। কি ব্যাপার জানতে চাইলাম একজন পথচারীর কাছে। পথচারী জানালেন আজকের হরতালের প্রতিক্রিয়া। আগেই বলেছি শান্তি চুক্তির প্রতিবাদে বি.এন.পি. ও সাত দল চট্টগ্রাম বিভাগে হরতাল ডেকেছে। সবার একটাই প্রশ্ন হরতাল শেষ হয়েছে প্রায় দু’ঘন্টা হতে চললো এখন কেন ভাংচুর। অন্যজন বললেন ভাই আমাদের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। আরো খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কুমিল্লা শাখা বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে। আর কারো একমাত্র সম্পদ অতি প্রয়োজনীয় গাড়ী ভাংচুর না করলে বিক্ষোভ জমবে না। কেন? এই রীতি চলে আসছে দীর্ঘ দিন যাবৎ। ৭১-এর আগে জ্বালাও-পোড়াও অসহযোগ, অবরোধ, ভাংচুর এসব হতো পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর সেই প্রক্রিয়া আমরা এখন নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছি। ভাবতে কষ্ট হয়। যা হোক পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমরাও রওয়ানা হই। আমাদের পেছনে বিশাল লাইন প্রায় ঘণ্টা যাবৎ বন্ধ থাকা ব্যস্ত রাস্তার গাড়ী।
ঢাকা মাত্র ২ ঘণ্টার পথ। গাড়ী চলছে আমরা ক্লান্ত কারো মুখে কথা নাই। বেশি দ্রুত চালাতে গেলে কুদ্দুস ভাই ও হাসান ভাই যৌথভাবে চালককে নিবৃত্ত করে। ময়নামতি পার হয়েছি। সামনেই দাউদকান্দি ব্রীজ অনেক বড়, দেখার মত সুন্দর। আর কিছু দুর পরে মেঘনা ব্রীজ যোগাযোগসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে দেশের উন্নতি দেখতে বেশ ভাল লাগে। এদিকে দ্রুত প্রস্তুতির পথে দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু। শুনেছি আগামী ২৩ শে জুন ৯টায় সেতুটি উদ্বোধন করা হবে। এদিন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ক্ষমতা গ্রহনের দু’বছর পূর্ণ হবে। ইতোমধ্যে আমরা ডেমরা পার হচ্ছি। এখান থেকে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে পৌছতে ১৫/২০ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য, পুরো দক্ষিনাঞ্চলের সাথে ঢাকা মহানগরীর এই একমাত্র সংযোগ সড়কটি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো এক ঘন্টা আর তা নাহলে মহনগরীর নতুন রাস্তা তৈরি, সংযোগ সড়ক নির্মান এবং মহানগরীর বাইরে দিয়ে রাস্তা না করলে রাজপথে থেমে যাবে।
সবকিছু মিলিয়ে আমাদের টার্গেট রাত ১০টার আগে বাসায় পৌছাবো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগে হাসান ভাইকে তার মগবাজারের বাসায় নামিয়ে আমি হাতিরপুল নেমে গেলাম। ড. হারুন আর কুদ্দুস ভাই এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। রাস্তার পাশেই আমার বাসা। দ্রুত বাসায় গেলাম। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম আজ সকালে সরাসরি সম্প্রচারিত অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটি টি.ভি. পর্দায় ঘোষকের ছবি ভেসে উঠলো- সুধীবৃন্দ, এতক্ষন ঐতিহাসিক অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হলো। আমি নিজেও একজন টি.ভি. ঘোষক। কাজেই আমিও বলতে চাই- প্রিয় পাঠকবৃন্দ এতক্ষন খাগড়াছড়ি অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানের যোগদানের অনুষ্ঠান বর্ণনা করা হলো।
লেখক: জনপ্রিয় উপস্থাপক, নির্মাতা, নির্দেশক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব