Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দুঃখে ভরা চা শ্রমিকদের জীবনগাঁথা (দ্বিতীয় পর্ব)

স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করেও নেই ঝুঁকিভাতা

Icon

শানু মোস্তাফিজ

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:২৯

স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করেও নেই ঝুঁকিভাতা

শানু মোস্তাফিজ

রাষ্ট্রের কাছে তাঁরা অদৃশ্য। দু’শো বছর ধরে তাঁরা চরমভাবে বঞ্চিত এবং অবহেলিত। তাঁদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় উন্নত মানের চা বিদেশে রপ্তানি হয়। জিডিপিতে রয়েছে তাঁদের অবদান; কিন্তু কৌশলে তাঁদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। তাঁদের রয়েছে হাজারো সমস্যা। রয়েছে সংকুচিত ও অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান এবং ভূমির সমস্যা। তাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। কঠোর দৈনন্দিন জীবনে নেই আনন্দ-বিনোদন ও নিরাপত্তা। রয়েছে শিক্ষা, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাব। এসব নিয়ে চার পর্বে সাজানো হয়েছে চা শ্রমিকদের এক অজানা জীবনগাঁথা। লিখেছেন- শানু মোস্তাফিজ।

ভারের সাহায্যে ঘাড়ে বত্রিশ লিটার পানি নিয়ে হেঁটে প্রতিদিন মাঝারি আকৃতির টিলায় ওঠার দৃশ্য না দেখলে, অনুমান করা যায় কাজটি কতটা কষ্টকর। যথেষ্ট সুঠাম দেহের অধিকারী না হলে, এ কাজে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে জীবন বিপন্ন হতে পারে। এমনটি যে ঘটে না, সেটা নিশ্চিত করে বলাও যায় না। কে খবর রাখে এসব চা শ্রমিকদের? যে কাজের কথা বলা হচ্ছে, সেটা যারা করেন বাগানে তাদের পানিওয়ালা বলে। প্রচণ্ড গরম ও রোদে কাজ করার সময় চা শ্রমিকদের পিপাসা লাগে। সঙ্গে নিয়ে আসা স্বল্প পরিমাণ পানি তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না বলে, পানিওয়ালাদের আশায় বসে থাকেন। এতে শ্রমিকদের পাতা তোলার কাজে সময় ব্যয় হয় এবং তারা বেশি পাতা তুলতে পারেন। ব্রিটিশরা চা বাগানে এ নিয়ম চালু করেছিল। তখন থেকে বেশিরভাগ বাগানে এ নিয়ম চলছে। 

কিছু বাগান সমতলে হলেও অনেক বাগান টিলায় অবস্থিত। শ্রমিকরা বলেন, ‘শুকনা মৌসুমে এভাবে ভাঁড়ে পানি নিয়ে টিলায় উঠতে ভয় করলেও, বর্ষা মৌসুমে সে ভয় বেড়ে যায় বহুগুণ। কেননা বৃষ্টির সময় রাস্তা ভিজে কাদা হয়। এতে পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। অথচ এ সময় কাজের চাপ বেশি থাকে। পাতা তোলার এটাই মূল মৌসুম (জুন-নভেম্বর)।’ এভাবে ভার বহন করতে তাদের ঘাড়ে ব্যথা হয়। অনেকে আঘাত পান। কারো ঘাড়ে ঘাঁ হয়। পায়েও সমস্যা হয়। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এভাবে ভার বহন করতে হয়। এ কাজের ঝুঁকি ও পরিশ্রম তারা স্বীকার করে নিয়েছেন। ঝুঁকি ভাতার বিষয়টি তারা জানেন না। তবে যে কেউ স্বীকার করবেন, এক্ষেত্রে ঝুঁকি ভাতা থাকা প্রয়োজন।

তারা যে পথ দিয়ে পানি নিয়ে যান, সেই পথ পাকা করে দেওয়া তেমন ব্যয়বহুল নয়। বরং এটাই ডিজিটাল যুগের পক্ষে উপযোগী ও মানবিক কাজ। এ ছাড়া শ্রমিকরা যেখানে কাজ করেন, সেখানে পাইপের সাহায্যে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়; কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ এই সহজ কাজগুলো কেন করেন না, তা বোধগম্য নয়। হয় তো অনুযোগহীন এই মানুষগুলোকে এভাবে চালালেও, অভিযোগ করার কেউ নেই বলে তারা এ রকম করছেন। 

অনেক সময় কারখানায় চা প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় চলন্ত মেশিনের রুলার বা অন্য কোনো যন্ত্রে শ্রমিকদের হাত ঢুকে যায়। এতে তাদের আঙ্গুল কেটে মেশিনের ভেতর চলে যায়। এ ধরনের সমস্যায় কোম্পানি শ্রমিকদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করায়। তবে নিয়ম অনুযায়ী কারখানায় কাজ করার সময় শ্রমিকের হাত বা শরীরের অন্য কোনো স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সে অনুযায়ী শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি এ বিষয়ে ট্রেড ইউনিয়নেরও সহযোগিতা পান না বলে জানা যায়।

বাগান থেকে চা পাতা নিয়ে এসে ধুপঘরে (যেখানে পাতা শুকানো হয় সেটাকে ধুপঘর বলে) প্রায় বিশ ঘণ্টা ১৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় শুকানো হয়। এ সময় যে ধরনের কাজ করতে হয়, সেটাই টানিংয়ের কাজ। শ্রমিকরা বলেন, ‘কাজটি তেমন পরিশ্রমের না হলেও, এতে অনেকটা ঝুঁকি রয়েছে। তবে আমরা কোনো ঝুঁকিভাতা পাই না।’

চা বাগানের আগাছা দমন এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য যারা ওষুধ ছিঁটানোর কাজ করেন তাদের মেশিনওয়ালা বলে। একটি পাত্রে কয়েকজন শ্রমিক ইথিয়ন, ওমাইড, থায়োডিনসহ আরও কিছু ওষুধ পানিতে গুলিয়ে বিশ লিটারের ড্রামে ভরে নেন। এসব ওষুধ ছিটানোর সময় কিছু নিয়ম-কানুন থাকলেও কোম্পানি তাদের তা মানার বিষয়ে সচেতন করেন না। শ্রমিকরা বলেন, ‘ওষুধ ছিটানোর সময় হাতের দস্তানা, মুখাবরণ, শরীর আচ্ছাদন কিংবা চশমা ব্যবহার করা প্রয়োজন; কিন্তু আমরা এ সবের কিছুই পাই না। শুরুর দিকে বছরে একবার এক জোড়া দস্তানা দেওয়া হলেও, পরে আর কখনো তা পাইনি। ওষুধের ড্রাম বহন করার সময় ঘাড়ে অনেক ব্যথা হয়। এমনকি ঘাড় ছিঁলেও যায়। ওষুধ ছিটানোর পর চোখ জ্বালা করে। বমি বমি লাগে এবং খাবারে অরুচি হয়, মাথা ঘোরে ইত্যাদি। বিষয়গুলো আমরা আমলে নেই না এবং কাউকে কখনো এ নিয়ে অনুযোগ করিনি। এখন শুনছি, এগুলো থেকে সমস্যা হতে পারে।’ এ জন্য অনেকের অকালে চোখ নষ্ট হয়। অনেকেই চর্ম রোগে ভোগেন। 

চা বাগান ও বাগানের নার্সারির পরিচর্যা যারা করেন তাদের সাফাইকারী বলা হয়। কোদাল দিয়ে মাটি কাটা, জঙ্গল পরিষ্কার করা বেশ শক্ত কাজ। চারা গাছের গোড়াও পরিষ্কার করতে হয় তাদের। কলম কাটাসহ আরও নানা কাজ করেন তারা। ওই সময় ভয়ংকর কিছু পোকা তাদের আক্রমণ করে, কামড় দেয়। মশাল জ্বালিয়ে মারতে গেলে অনেক সময় তারাও উল্টো আক্রমণ করে। চোখ-মুখে কামড় দেয়। এতে মুখ ফুলে যায়, প্রচণ্ড ব্যথা হয়। পোকার কামড়ে কেউ মারাও যান। কখনো কাজ করতে গিয়ে হাতও কেটে যায়। এমনও দেখা গেছে, এসব সমস্যায় পড়ে কেউ কাজ বাদ দিয়েছেন। হতাশ কণ্ঠে শ্রমিকরা বলেন, ‘বড় কষ্টের জীবন চা শ্রমিকদের। এসব সমস্যায় আমরা ঠিকমতো চিকিৎসাও পাই না। এভাবেই চলছে যুগ যুগ ধরে।’

বাগানে শ্রমিকরা এভাবে অনেক কষ্ট ও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। যেখানে ঠিকভাবে তিন বেলা খেতে পারেন না এবং ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, আর সেখানে ঝুঁকিভাতার কথা তারা ভাবতেও পারেন না। প্রান্তজনের এসব মানুষ আর কতদিন অধিকার বঞ্চিত হয়ে বাঁচবেন? এমন প্রশ্ন ছুটে বেড়ায় চা বাগানের পাতায় পাতায়। তারাও বাঁচতে চান অন্যদের মতো। নাগরিক অধিকার পেতে চান; কিন্তু কীভাবে? এ প্রশ্ন তাদের প্রত্যেকের এবং সচেতন নাগরিকদেরও। 


লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫