
আমজাদ হোসেন
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বলা যায় নদী দিয়েই গঠিত পৃথিবীর এই বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চল। এর সর্বত্র হাজার নদী উপনদী শাখানদী বিস্তৃত। মূলত বাংলাদেশ নদীকেন্দ্রিক দেশ। নদী ছাড়া আর তার বিপুল জলভাণ্ডার বাদ দিলে এই ভূভাগের যেন কোনো অস্তিত্বই থাকে না। হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ। এই নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ পানির অভাবে মরুকরণের পথে অগ্রসর হয়েছে।
ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ, তিস্তার উজানে বাঁধ, আরো বহুসংখ্যক ড্যাম-ব্যারেজ নির্মাণ করে এক তরফাভাবে আন্তর্জাতিক নদীর (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই নদীগুলো এসেছে ভারত থেকে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এ ব্যাপারে এখনো কোনো ভূমিকা পালন করেননি। যাহোক বাংলাদেশে এখন চলছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বাড়ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। কারণ গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ। এর অবস্থান হলো রাজমহল ও ভগবানগোলার প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়। ফারাক্কা কলকাতা থেকে ১৬০ মাইল আর রাজশাহীর সীমান্ত থেকে ১১ মাইল দূরে।
এরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
তিনি ঘটিয়েছিলেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল। ৫০ মাইলের এক ঐতিহাসিক লংমার্চ। রাজশাহী থেকে কানসাট ৫০ মাইল দূরে। আর এই মিছিলে শত শত মাইল দূর থেকে মওলানা ভাসানীর ডাকে ছুটে আসা হাজার হাজার মানুষ। ফারাক্কা বাঁধ আন্দোলনের একটি সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট রয়েছে। বাংলাদেশের ৫৪ টি নদীর মধ্যে ৫৩ টি নদীর পানি একতরফাভাবে ব্যবহারের চক্রান্ত করছে ভারত। আর এর প্রত্যেকটি নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে একতরফা পানি ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ হলো ভাটির দেশ। এই সুযোগ ভারত পুরোপুরি গ্রহণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক নদী থেকে কোনো দেশ একচেটিয়াভাবে পানি দখল ও ব্যবহার করতে পারে না। এতে প্রত্যেকের হিস্যা আছে। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা পানি সে দিতে বাধ্য। ভারত হেলসিংকি রুলস অব ১৯৬৬, ইউ এন ওয়াটার কনভেনশন অব ১৯৯৭ ও বায়োডাইভারসিটি (১৯৯২) আইন লংঘন করে চলেছে। অর্থাৎ কোনো আন্তর্জাতিক আইনই সে মানতে চাইছে না।
ভারত সরকার একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন নদী যেমন চম্বল, প্রভাতি, কালসিন্ধু ও বেতওয়া নদী সহ মোট ৩২ টি নদীকে তারা সংযুক্ত করবে। তারা একে বলছে ‘নদী স্থানান্তর প্রকল্প’। এর ফল মারাত্মক হতে বাধ্য। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্যও। ‘নর্মদা নদী বাঁচাও’ আন্দোলনের কথা অনেকেরই জানা আছে। এই আন্দোলনে যুক্ত রয়েছেন প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়, মেধা পাটেকর, রামস্বামী আয়ার, এল সি জৈন, লালুপ্রসাদ যাদব (বিহার) প্রমুখ। উক্ত মহাপরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন আসাম, মণিপুর ও পশ্চিমবঙ্গের নেতৃবৃন্দ (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য)। তারা তীব্র বিরোধিতা করেছেন এই মহাপ্রকল্পের। এর ফলে ভারতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সর্বাধিকভাবে। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুর ও আসাম প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশতো হবেই-এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখানে উল্লেখ্য যে, গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিনটি নদীকে এই অঞ্চলের প্রধান নদী বলা যায়। এই তিনটি নদীতে যে পানিসম্পদ রয়েছে তা থেকে বাংলাদেশ ব্যবহার করে মাত্র ৭ ভাগ। বাকি ৯৩ ভাগ ব্যবহার করে ভারত, চীন, ভুটান ও নেপাল। ভারত চাইছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার (উপরিভাগ) পানি অন্যত্র সরিয়ে নিতে। বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি ছাড়া ভারত এ কাজ করতে পারে না। ফারাক্কা সমস্যার উদ্ভব সেই ১৯৫০ সনে। ভারত যখন গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। ১৯৫১ সনে পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে।
প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয় যে, গঙ্গার উপর বাঁধ (ফারাক্কা) নির্মাণ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের নদীগুলো শুকিয়ে যাবে। জনমানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেচ ব্যবস্থা, ফসল ও মৎস্য সম্পদের চরম ক্ষতিসাধিত হবে। একতরফাভাবে ভারত এটা করতে পারে না। ১৯৫২ সনের মার্চে ভারত জানায় যে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা তারা (ভারত) করছে না। শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে ও সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখছে। ভারত যদি কখনও বাঁধ নির্মাণ করে তাহলে পাকিস্তান সরকারকে তারা জানাবে। ১৯৬০ সনে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। আলোচনাকালেই ভারত বাঁধ নির্মাণ শুরু করে দেয়। ওই সময় থেকে বিভিন্ন বৈঠকে ভারত-পাকিস্তান দুই পক্ষের আলোচনা হয়েছে। এক বৈঠকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একটি স্থায়ী নদী কমিশন গঠন, নদীর পানি নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে তার নিস্পত্তি করা, পাকিস্তানকে মাসিক ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা চাওয়া হয়। ভারত এতে কর্ণপাত করেনি কোনো কারণ ছাড়াই।
১৯৭১ সনের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বর্তমান বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। আশা করা হয়েছিল ভারত এবার বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জোরদার করবে এবং পানি সমস্যার যৌক্তিক সমাধানে আসবে। ১৯৭৪ সনের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে পরস্পর গ্রহণযোগ্য বন্টন নীতি অবলম্বন করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে উভয় দেশের প্রতিনিধি দল।
কিন্তু দেখা গেল, ১৯৭৬ সনের শুষ্ক মৌসুমে ফিডার ক্যানেল দিয়ে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে। এর ফলে দেখা গেল ১৯৭৫ সনে ফিডার ক্যানেল চালু করার পর যেখানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মার পানি প্রবাহ ছিল ৬৫ হাজার কিউসেক। সেখানে ১৯৭৬ সনের ওই সময়ে পানি প্রবাহ নেমে আসে ২৩ হাজার ২০০ কিউসেকে। কী ভয়াবহ অবস্থা! তখন বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের কাছে সম্মানজনক পানি বন্টন করার চুক্তি করতে আহ্বান জানায়। ১৯৭৬ সনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে (৩১তম অধিবেশনে) বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ইতোমধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে লংমার্চ সংঘটিত হওয়ায় ফারাক্কা ইস্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রাধান্য পায়। সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এক বিবৃতি অনুমোদিত হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, উভয় দেশ যেন একটি সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছানোর জন্য পরস্পর মিলিত হয়।
১৯৭৭ সনের ৫ নভেম্বর ঢাকায় ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫ বছর মেয়াদী এই চুক্তি শেষ হয় ১৯৮২ সনের মে মাসে। ভারত আর এই চুক্তি নবায়ন করতে চায় না। অবশ্য ওই বছরের অক্টোবর মাসে ভারত দুই বছরমেয়াদি একটি পানি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি হলো এই যে, ১৯৭৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কমপক্ষে তার প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ পানি পাওয়ার গ্যারান্টিযুক্ত যে ক্লজ ছিল তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে বাংলাদেশ পানি কম পেতে থাকে। আর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ভারত যথারীতি গড়িমসি শুরু করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতিসংঘের ৪৮তম অধিবেশনে ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের বিপর্যয়ের বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গত ৩৬ বছরে বাংলাদেশের অনেক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষতি সাধিত হয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের তলা দিয়ে গ্রীষ্মকালে গরুর গাড়ি চলে। পানির অভাবে বড় বড় চরের সৃষ্টি হয়েছে। অথচ আগে ওখানে ছিল বিপুল জলরাশি। বাংলাদেশ লবণাক্ততার শিকার হচ্ছে, পানির অভাবে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশ মরুকরণের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার পথে। নদীপথ হ্রাস পেয়েছে। ২৪ হাজার কিলোমিটারের স্থলে এখন মাত্র ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার নদীপথে এসে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা এখন শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত লবণাক্ততার শিকার হচ্ছে আমাদের দেশের নদীগুলো। প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মাছ ও বনজ সম্পদ সবই এখন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।
১৯৭২ সনে ভারত বাংলাদেশ এক চুক্তি হয়। চুক্তির মর্ম এরকম যে, পানি সমস্যা দেখা দিলে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়ে সমস্যার সমাধান করা হবে। কিন্তু ভারত তা করতে সব সময়েই অনীহা প্রদর্শন করেছে। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর পানি বন্টনের জন্য পাঁচ বছরমেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭৭ সনের নভেম্বর মাসে।
১৯৮২ সনে ২ বছর ও ১৯৮৫ সনে ৩ বছর মেয়াদী দু’টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও তা মূলত কোনো কাজে আসেনি। ১৯৯৬ সনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ বছর মেয়াদী এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ভারত সে চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর করছে না। বাংলাদেশকে পানি দেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে আজও ভারত খেলা করে যাচ্ছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দোষ দেয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ইতোমধ্যে ভারত তিস্তার উজানে গজল ডোবায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। ভারত খোয়াই, গোমতী, মহানন্দা, মহুরী প্রভৃতি নদীর উজানে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ-ড্যাম নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে।
ওপরে ভারত কর্তৃক পানি ঘোলা করার কাহিনী অতি সংক্ষেপে বর্ণিত হলো। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এগিয়ে এলেন ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে। তিনি তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞাবলে বুঝেছিলেন যে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রবাহ তাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর এর ফল হবে বিষময়। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংকটের মুখে পড়বে। লবণাক্ততা বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক শ্রমিক-এককথায় বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশ মরুকরণের পথে এগিয়ে যাবে; যাচ্ছেও। তাই মওলানা ভাসানী সোচ্চার হলেন। বুঝলেন, আন্দোলনে নামতে হবে। তিনি আন্দোলনে নামলেন। সেই আন্দোলনের নাম ফারাক্কা লংমার্চের ঐতিহাসিক আন্দোলন।
এবার সেই ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক।
১৯৭৬ সনের ২৪ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী বলেন যে, অভিন্ন নদীর পানি কোনো দেশ এককভাবে পেতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সুতরাং এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা যাবে না। ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের পানি প্রবাহ রুদ্ধ করতে চায়। তিনি তাঁর বক্তব্যে সরকারের প্রতি বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপনের আহ্বান জানান। এর প্রায় ৩ সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ২০ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, আমরা সময় মতো পানি না পেলে আমাদের কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সেচ বন্ধ হয়ে যাবে। এদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন মরণ সমস্যা হচ্ছে। ভারতের অবস্থান আমাদের উজানে হওয়ায় তারা এ সুযোগ গ্রহণ করেছে। ভারত যদি একতরফাভাবে কোনো আন্তর্জাতিক নদী নিয়ন্ত্রণ করে শুষ্ক মৌসুমে সে পানি নিয়ন্ত্রণ পূর্বক বাংলাদেশকে চরম ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দিয়ে ভয়াবহ বন্যায় দেশ ভাসিয়ে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ভারত শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গতভাবে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করুক এটাই আমরা চাই। না হলে ভারতের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করা হবে।
১৭ এপ্রিল মওলানা ভাসানী এই মর্মে ঘোষণা করেন যে, আগামী ১৬ মে (১৯৭৬) রাজশাহী থেকে লাখ লাখ মানুষ অহিংস শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে ফারাক্কা বাঁধের দিকে অগ্রসর হবে। এটাই ভাসানীর ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ।
২৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয় এই বৈঠকে। এই বৈঠকে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এই ফারাক্কা মিছিল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সভায় ফারাক্কা লংমার্চের (১৬ মে) সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আশা প্রকাশ করা হয় যে, দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোক এই মিছিলে শামিল হবে। পরে এই কমিটির সংখ্যা ৭২ জনে উন্নীত করা হয়। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র প্রত্যেকের প্রতি আহ্বান জানানো হয় এই লংমার্চ সফল করার জন্য। ন্যাপ, কৃষক সমিতি, শ্রমিক ফেডারেশন ও ছাত্রদল এই মিছিলে যোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
অসুস্থ অবস্থায় মওলানা ভাসানী ১১ মে রাজশাহী পৌঁছান ডাক্তারের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেই। তখন তিনি খুব অসুস্থ। তিনি রাজশাহীর বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে যান এবং জনমত সৃষ্টি করেন। এর আগে সীমান্তে ভারতীয় হামলার ঘটনা ঘটে। তিনি তাঁরও প্রতিবাদ করেন।
জননেতা মওলানা ভাসানীর ডাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোক রাজশাহীতে উপস্থিত হন। এখানে উপস্থিত হন শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, আইনজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ।
১৬ মে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে সমবেত হন লাখ লাখ মানুষ। এই জনতার বিশাল সমাবেশে মওলানা ভাসানী বলেন যে, ফারাক্কা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান ও পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলতেই থাকবে। সমাবেশের পর ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফারাক্কা মিছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছে। এখানে মওলানা ভাসানী ভারতীয় পণ্য বর্জন করার হুমকি দেন। তিনি বলেন, ন্যায়সঙ্গত সমাধান না হলে আমরা ভারতীয় পণ্য বর্জন করবো। ভাসানীর নেতৃত্বে সেই বিশাল গণমিছিল ভারত সীমান্তবর্তী কানসাটে পৌঁছায় ১৭ মে। এখানে প্রদত্ত ভাষণে দীপ্ত কণ্ঠে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আহ্বান জানিয়ে বলেন; আপনি বাংলাদেশে এসে দেখে যান ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের কী দুরাবস্থা হয়েছে। তিনি বলেন, আপনি ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ না করে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করেন। তিনি বলেন, ভারত শান্তিপূর্ণভাবে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান না করলে আগামী মাস (জুন) থেকে সেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করবো এবং ১৬ আগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন শুরু করবো। মওলানা ভাসানীর এই লংমার্চের ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অনুকূলে জনমত সৃষ্টি হয়। ফারাক্কা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে।
১৬ মে। ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল-লংমার্চ হয়েছিল এই দিনে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সনে মৃত্যুবরণ করেন। সেটা ৩৬ বছর আগের কথা। আজও ফারাক্কা সমস্যার সমাধান হয়নি। ভারত তিস্তা চুক্তি করতে গড়িমসি করছে। ভারতের কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ একে অপরের প্রতি দোষারোপ করে যাচ্ছে। এ খেলা সকলের কাছে স্পষ্ট।
ফারাক্কা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান হওয়া জরুরি। তা হতে হবে আন্তর্জাতিক আইনসমূহের আওতায়। যতদিন এই সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। ততদিন বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে যাবে। আর এই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন এবং থাকবেন মহানায়ক মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এদেশের মানুষ তাঁকে বহু বহুকাল ধরে স্মরণ করবেন।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা