Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

জেনারেল ওসমানী: যে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা

Icon

আনোয়ার পারভেজ হালিম

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০:৪০

জেনারেল ওসমানী: যে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা

- মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী

মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, যিনি জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী নামে অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিলেটে সমাহিত করা হয়। তার স্মরণে...

মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, সংক্ষেপে এমএজি ওসমানী- আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি, তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে ছিল না ব্যাপক কোনো আয়োজন। তাঁর শুভাকাঙ্খীদের উদ্যোগে একেবারে সাধারণভাবে নীরবে-নিভৃতে পালিত হয়েছে দিনটি, যেন জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো দায় নেই তাঁকে স্মরণ করার! আমরা তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার কথা বেশ জোরেশোরেই বলি। কিন্তু এ প্রজন্মের ক’জন তরুণ বলতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির নাম, তাঁর ব্যক্তিত্ব কিংবা যুদ্ধে কী ছিল তার ভূমিকা? খুব কম সংখ্যকই এর জবাব দিতে পারবে। এ ব্যর্থতা তরুণদের নয়, যেখানে পর্বে পর্বে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে, সেখানে জনযুদ্ধের এই সমরনায়ককে নিয়ে অনুসন্ধানের ঘাটতি থাকাটাই যেন স্বাভাবিক! মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সাহিত্য রচয়িতাদের কাছেও ওসমানী পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাননি। তাঁকে নিয়ে যতটুকু লেখালেখি হয়েছে, সেই প্রয়াস অনেক জটিলতা ও প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে এবং সেসব প্রশ্নের উত্তর আজও অমীমাংসিত। 

জেনারেল ওসমানী ছিলেন অসম সাহসী এবং প্রচণ্ড স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী- মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। একাত্তরে ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান। কিন্তু নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে, ১৬ ডিসেম্বর বিকালে পরাজিত পাকিস্তান বাহিনী রেসকোর্সের ময়দানে যখন আত্মসমর্পণ করলো, সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সেখানে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। কেন তিনি অনুপস্থিত ছিলেন, তা নিয়ে পরবর্তীতে জল কম ঘোলা হয়নি! এ নিয়ে বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থে যেসব ভাষ্য পাওয়া যায়, তা আলোচনার জন্য সহায়ক হলেও মূল প্রশ্নের সুরাহা করতে যথেষ্ট নয়। বরং অনেকের বক্তব্য এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে, তাতে যে কারো ধারণা জন্মাতে পারে, ওসমানী হয়তো ইচ্ছে করেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাননি। অনুপস্থিত থাকার দায় অত্যন্ত কৌশলে তাঁর ওপরে চাপানোর চেষ্টা করা হয়। এভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বকেও খাটো করা হয়েছে, হচ্ছে। ওসমানীর জীবনের সফলতা-ব্যর্থতার মধ্যে এ অধ্যায়টিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। বর্তমান নিবন্ধেও এই বিষয়টিকে মূল ‘ফোকাস’করে পরস্পরবিরোধী সেসব বক্তব্যের বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে। 

ওসমানীর পৈতৃক বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জ থানার দয়াপীরে, বর্তমানে এটি ওসমানীনগর থানা। তার পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন তৎকালীন সুনামগঞ্জ সদর মহকুমার সাব ডিভিশনাল অফিসার। সে সুবাদে ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে ওসমানীর জন্ম। পিতার বদলির চাকরির কারণে বিভিন্ন শহরে কেটেছে ওসমানীর শিক্ষাজীবন। ১৯৩৮ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৩৯ সালে ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। একই সময়ে তিনি ব্রিটিশ রাজকীয় সামরিক বাহিনীতে জেন্টেলম্যান ক্যাডেট নির্বাচিত হন। সিভিল সার্ভিসে না গিয়ে তিনি ওই বছরই সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার লক্ষ্যে দেরাদুনে ব্রিটিশ-ভারতীয় সামরিক একাডেমিতে কোর্স সম্পন্ন করেন।


সামরিক জীবন

ওসমানী ১৯৪০ সালের অক্টোবরে ভারতে ব্রিটিশ রয়েল আর্মিতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন ও ১৯৪২ সালে মেজর পদে উন্নীত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা রণাঙ্গণে তিনি ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ করেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রবেশের পর থেকে সেনা অফিসার হিসেবে শুরু হয় তাঁর ভাগ্য বিপর্যয়। দীর্ঘ নয় বছর পর ১৯৫৬ সালে তাকে কর্নেল পদে প্রমোশন দেয়া হয় এবং এর ১০ বছর পর ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কর্নেল পদে থাকা অবস্থায়ই তিনি অবসরে যান। অর্থাৎ ১৯ বছরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাঁকে মাত্র দু’টো প্রমোশন দেয়া হয়েছে। আর্মি রুলস অনুযায়ী, সেনা কর্মকর্তাদের শারীরিক ফিটনেস এবং অন্যান্য কোর্স সম্পন্ন করা থাকলে প্রতি তিন বছরে অন্তত একটি করে প্রমোশন পাওয়ার কথা। এসব গুণাবলী তাঁর ছিল। তারপরও ওসমানীকে প্রমোশন দেয়া হয়নি। কেবল তা-ই নয়, চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদ জেনারেল স্টাফ অফিসার (জিএসও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে প্রমোশন হলে ওসমানী সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পারতেন। সব ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ওসমানীকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের মতো তাঁকেও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ওসমানীর সহকর্মী পাকিস্তানি দু’জন জেনারেলের বক্তব্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। 

পাকিস্তান আর্মিতে ওসমানী ছিলেন রাও ফরমান আলী খানের সিনিয়র অফিসার। ১৯৭১ সালে ফরমান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান। ১৯৬৬ সালে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরে সামরিক কর্মকাণ্ডের উপ-পরিচালক (ডিডিএমও) পদে কর্মরত ছিলেন কর্নেল ওসমানী। কিছুদিন পর ওই পদে নিয়োগ পান রাও ফরমান আলী খান। ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ গ্রন্থে জেনারেল (অব.) ফরমান আলী জানান, ‘গত আট বছর ধরে ডিডিএমও পদটিতে ছিলেন কর্নেল ওসমানী, একজন পূর্ব পাকিস্তানি। পরবর্তীতে তিনি যদিও মুক্তিবাহিনীর জেনারেল হয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে তাঁকে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হতো না। তিনি বাঙালি ছিলেন এবং সম্ভবত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে বিশ্বাস করতেন না। দায়িত্ব বুঝে নেয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমি রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে গেলাম একথা জেনে যে, তাঁকে কোনও ফাইলপত্র দেখতে দেয়া হয় না, এমনকি চাপরাসিরা পর্যন্ত তাঁকে অবজ্ঞা করে চলে। তাঁর অফিস ঝাড়– দেয়া হয় না, অফিসটি নিষ্ক্রিয়, ক্ষমতাহীন, অকার্যকর এবং সর্বত্রভাবে উপেক্ষিত।’

বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ কতটা ভয়াবহ ছিল, তা বোঝার জন্য রাও ফরমান আলীর এ স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট। পাকিস্তান আর্মির বাঙালি সদস্যদের প্রতি শাসকশ্রেণির বৈষম্যমূলক আচরণের আরেকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লে. জেনারেল গুল হাসান খান। তিনি চাকরিতে কর্নেল ওসমানীর জুনিয়র ছিলেন। ‘মেমোরিজ অব লে. জে. গুল হাসান খান’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘...আমার চেয়ে চাকরিতে সিনিয়র হলেও ষাটের দশকে আমি ডিএমও থাকাকালে ওসমানী আমার ডেপুটি ছিলেন। তাঁকে প্রমোশন দেয়া হয়নি। অন্যরা তাকে ডিঙিয়ে যায়। এতে স্বভাবতই পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের ওপর তাঁর মন ছিল তিক্ততায় ভরা। ...কিছু সময়ের জন্য ওসমানী আমার একজন ভালো বন্ধুতে পরিণত হন। তাঁর কয়েকটি চমৎকার গুণ ছিল। ...১৯৬৬ সালে আমি সেনা হেড কোয়ার্টার থেকে চলে যাবার পর ওসমানী একজন কর্নেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ওসমানী মনে করতেন তাঁর ফিল্ড মার্শাল পদ পাওয়া উচিত ছিল।’

পাকিস্তানি এই দুই জেনারেলের বক্তব্যে এটা প্রমাণিত, চাকরি জীবনে ওসমানীকে পাকিস্তান আর্মিতে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। গুল হাসান ঠিকই বলেছেন, অন্যান্য বাঙালিদের মতো পাকিস্তানিদের ওপরে ওসমানীর মনও ছিল তিক্ততায় ভরা। কারণ চাকরিতে যৌক্তিক প্রাপ্য থেকে তাঁকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এর সমর্থন মেলে আরেকজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল (অব.) কামাল মতিনউদ্দিনের বক্তব্যে। তিনি জানান, ‘তাঁকে (ওসমানী) যখন ব্রিগেডিয়ার র‌্যাংকে পদোন্নতি না দিয়ে একটি কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম হয়। তাঁর মধ্যে এক ধরনের তিক্ততার সৃষ্টি হয়। যারা তাঁকে বঞ্চিত করেছিল, তাদের ওপরে তাঁর রাগ বাড়ে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন।’ কামাল মতিনউদ্দিন আরও বলেছেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ওসমানীই ছিলেন উত্তম ব্যক্তি। তিনি মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন।’ মতিনউদ্দিন ভুল বলেননি, ওসমানী সত্যিই ছিলেন খাঁটি বাঙালি। সেজন্যই অবসর গ্রহণের চার বছর পর ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তির লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদে নিয়োগ দেয়। যুদ্ধ চলাকালে তাঁর নামের আগে যুক্ত হয় ‘জেনারেল’ পদবি। যদিও তাঁর এই জেনারেল পদবির মেয়াদ কার্যকর ছিল বছরখানেক। অর্থাৎ যুদ্ধের নয় মাস এবং স্বাধীন দেশে আরও তিন মাস ছয় দিন। এ বিষয়ে বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ আছে- ‘স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি (ওসমানী) বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং তাঁর এ পদোন্নতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল সেনাবাহিনীতে জেনারেল পদ বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।’


রাজনীতিতে ওসমানী

চাকরির সুবাদে পাকিস্তানিদের অপশাসনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ওসমানী। নিজেও ছিলেন এর ভুক্তভোগী। তিনি যখন অবসরে যান ততদিনে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভাসছে। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা ও এগার দফা, আটষট্টিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণআন্দালনের মধ্য দিয়ে পুরো জাতি তখন একটি গন্তব্যের দিকে পৌঁছাতে ঐক্যবদ্ধ। এ প্রেক্ষাপটে রাজনীতিক না হয়েও বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭০ সালে ওসমানী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পাকিস্তানিদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ এবং অন্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নই হয়তো ওসমানীকে রাজনীতিতে প্রবেশে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদে তিনি মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে ওসমানী পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ প্রবর্তন করা হয়। ওসমানী বুঝতে পেরেছিলেন এটি ক্ষমতাসীনদের একটি ভুল পদক্ষেপ এবং একদলীয় শাসনের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন নেই। তাই বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে ক্ষমতাসীন দলের যে দুই ব্যক্তি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন, তিনি ছিলেন তার একজন। অন্যজন ছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। ওসমানী একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের সদস্যপদও ত্যাগ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি গঠন করেন জাতীয় জনতা পার্টি। এই দলের সভাপতি হিসেবে তিনি দু’বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এবং ১৯৮১ সালে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের আমলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দু’বারই পরাজিত হন। ওসমানী এমপি ও মন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এমন নজির নেই। কিংবা এখনকার মতো বিত্ত-বৈভব তৈরির সিঁড়ি হিসেবে রাজনীতিকে ব্যবহার করেননি। রাজনীতিক হিসেবে সব ক্ষেত্রে হয়তো তাঁর সফলতা ছিল না, কিন্তু তিনি প্রকৃতই দেশের ও জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করতেন। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে ওসমানী সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশি সময় দিয়েছেন। তাঁর সিলেটের বাড়িটি এখন ওসমানী জাদুঘর, আর ঢাকার ধানমন্ডির বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন ওসমানী ট্রাস্ট।

জেনারেল ওসমানীর চরিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল- দেশের চরম সংকটকালে তিনি চুপচাপ বসে থাকতেন না। সংকট উত্তরণে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেন। এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর খোন্দকার মোশতাক আহমদের আমন্ত্রণে ১৯৭৫ সালের ২৯ আগস্ট তিনি রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। যেহেতু ওসমানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, তাই সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারে ওসমানীর যোগদানকে অনেকে ভালোভাবে নেননি। যদিও ততদিনে তিনি রাজনীতিতে শিবির বদল করে ফেলেছেন। হয়তো মোশতাকের উপদেষ্টা পদ গ্রহণ করতে রাজনীতিই তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। এজন্য পরে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হন, যে সমালোচনা এখনো চলছে।

বৃদ্ধ বয়সেও তিনি জাতীয় সংকটকালে বারবার সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। পঁচাত্তরের ৪ নভেম্বর বঙ্গভবনের একটি ঘটনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে দেশে সামরিক ক্যু’র চেষ্টা করা হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হাউজ অ্যারেস্ট করে খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান করার জন্য রাষ্ট্রপতি মোশতাকের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। মোশতাক কিছুতেই খালেদের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছিলেন না। রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ওসমানীও খালেদের প্রমোশনের ব্যাপারে সাধারণ নীতিমালা অনুসরণের পক্ষে ছিলেন। ৪ নভেম্বর সারাদিন বঙ্গভবনে এ নিয়ে দেনদরবার চলতে থাকে। সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক চলাকালে অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি ঘটে। এ নিয়ে লে. কর্নেল এমএ হামিদ লিখেছেন, ‘যখন মন্ত্রিসভায় উত্তপ্ত আলাপ-আলোচনা চলছিল, তখন অকস্মাৎ ঘটে এক নাটকীয় কাণ্ড। আকস্মিকভাবে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাণ্ডা হাতে কর্নেল শাফায়াত জামিল। তার পেছনে অস্ত্র হাতে পাঁচ জন সশস্ত্র অফিসার। ভীত সন্ত্রস্ত মন্ত্রিসভার সদস্যগণ। আসন ছেড়ে ছুটে পালাতে উদ্যত। মেজর ইকবাল (পরবর্তীতে মন্ত্রী) খোন্দকার মোশ্তাকের দিকে স্টেনগান তাক করে বলতে থাকেন, ‘আপনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার দেখেছেন, কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর দেখেননি। এখন দেখবেন।’ ওসমানী অসম সাহসে মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘খোদার ওয়াস্তে গোলাগুলি করবে না। তোমরা এসব পাগলামী বন্ধ করো।’ বেঁচে গেলেন মোশ্তাক। বঙ্গভবন চত্বরে ৩২ নম্বর রোডের রক্তাক্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে ঘটতে থেমে গেল।’

এ অবস্থায় দু’পক্ষের মধ্যে অনেক বাকবিতাণ্ডের পর সমঝোতা হয়। এদিকে, ৩ নভেম্বর রাতেই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে ঘাতকরা। ৪ নভেম্বর এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। মূলত এটা জানার পর ওসমানী রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। হামিদ আরো জানান, ‘গভীর রাত। ওসমানী বারান্দায় (বঙ্গভবনের) এসে দাঁড়ালেন। তাঁর বাসায় যাওয়ার গাড়ি নাই। বললেন, ‘এখন আমি আর ডিফেন্স উপদেষ্টা নই। সুতরাং সরকারি গাড়ি ব্যবহার করবো না।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কর্নেল মালেক এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার, আপনি আমার গাড়িতে আসুন। আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেবো।’ ওসমানী তাঁর (মালেকের) গাড়িতে করেই গভীর রাতে বাসায় ফিরলেন।’


মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের অফিস ছিল কলকাতা নগরীর ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। একই অফিসে বসতেন বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীও। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের হেড কোয়ার্টার ছিল ফোর্ড উইলিয়ামে। সেখানে বসতেন ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল অরোরা। এ দুই বাহিনীর দুই প্রধানের মধ্যে সচরাচর দেখা-সাক্ষাৎ হতো না। বৈঠকও হতো কমই। নয় মাসে ওসমানী ফোর্ড উইলিয়ামে গিয়েছিলেন মাত্র একবার। তবে দুই বাহিনীর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য একজন লিয়াজোঁ অফিসার ছিলেন। কর্নেল পি দাস নামের ওই গোয়েন্দা অফিসারও বসতেন থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে। ফোর্ড উইলিয়ামের যে কোনো সিদ্ধান্ত কর্নেল দাস জানাতেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে। পরে প্রধানমন্ত্রী তা জানাতেন ওসমানীকে। ভারতীয় পক্ষের সিদ্ধান্তগুলো এভাবেই ভায়া হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির কাছে আসতো। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ভারতের অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারতেন না। যখনই তাঁর মনে হতো, এটা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধী, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিরোধিতা করতেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে অনেক। এমনকি বাংলাদেশ বাহিনীর কোনো কোনো সেক্টর কমান্ডার থেকে শুরু করে ভারতীয় বাহিনীর পদস্থ সেনা কর্মকর্তাও আড়ালে ওসমানীর সমালোচনা করতেন। যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। ওসমানীর স্বতন্ত্র মনোভাবের কারণে ভারত সরকারের নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ তাঁর ওপরে অসন্তুষ্ট ছিলেন। পরবর্তীতে যুদ্ধকালীন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এবং বিদেশি লেখকদের লেখায়ও এসব তথ্য উঠে এসেছে। একজন ভারতীয় জেনারেল মনে করতেন- ওসমানী একজন ‘ডিফিক্যাল্ট পারসন টু গেইন উইথ’, অর্থাৎ তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যার সঙ্গে মেলামেশা কঠিন। তিনি এও মনে করেন, ওসমানী ছিলেন ‘উদ্ধত ও অহংকারী’। সুতরাং, প্রধান সেনাপতি হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও যুদ্ধ পরিচালনা ওসমানীর জন্য যে খুব মসৃণ ছিল, তা বলা যায় না।

বলা বাহুল্য, সমর নায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধের কলা-কৌশল নির্ধারণে ওসমানীর কিছু দুর্বলতা ছিল। পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে গেরিলা পদ্ধতিতে, নাকি প্রথাগত (কনভেনশনাল) পদ্ধতিতে- এ নিয়ে দোটানায় ছিলেন তিনি। ওসমানী চাইতেন, যুদ্ধ হবে প্রথাগত মিলিটারি পদ্ধতিতে। কিন্তু শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধ ছিল গেরিলানির্ভর। প্রবাসী সরকার এবং বাংলাদেশ বাহিনীর বেশিরভাগের সমর্থনও ছিল গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে। শুরুতে ভারতও বাংলাদেশি যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তাদের দেশের ভেতরে পাঠাতো। অন্যদিকে ওসমানীর আগ্রহে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো গঠন করা হয়েছিল। ‘ফলে মুক্তিযুদ্ধের নির্দিষ্ট কোনো চরিত্র ছিল না। কখনো গেরিলা আবার কখনো প্রথাগত যুদ্ধে রূপ নিয়েছে।’ এসব নিয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ওসমানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরিয়াস ছিলেন না, উপরন্তু বিলম্ব করতেন। তিনি যুদ্ধের ময়দানে যেতেন না। একারণে একপর্যায়ে সেক্টর পর্যায়ের কেউ কেউ তার পদত্যাগের দাবিও তোলেন। এ নিয়ে ওসমানী ছিলেন ক্ষুদ্ধ। মত দ্বৈততার কারণে তিনি পদত্যাগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এসব পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতেন তাজউদ্দিন আহমেদ। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ৩৭ বছরের চাকরি জীবনে ওসমানী বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন দাফতরিক কাজে। স্বভাবতই যুদ্ধের ময়দানে অপারেশনাল কমান্ড, বিশেষ করে গেরিলাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। হয়তো সে কারণেই প্রধান সেনাপতি গেরিলা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। তাছাড়া যুদ্ধ পরিচালনার সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যেমন জড়িত ছিল, তেমনি ভারতেরও ছিল ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাভাবনা। এসব বিবেচনায় নিলে যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে সৃষ্ট টানাপড়েনের জন্য ওসমানীকে এককভাবে দায়ী করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ছিলেন কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রব (এমএ রব)। তাঁর দায়িত্ব ছিল মূলত যুদ্ধের নীতি ও কলাকৌশল নির্ধারণে প্রধান সেনাপতিকে পরামর্শ দেয়া। তিনি এই দায়িত্ব কতটা পালন করেছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিভিন্ন দলিলাদি থেকে জানা যায়, কর্নেল রব সদর দফতরে নিয়মিত অফিস করতেন না। তিনি বেশির ভাগ সময় থাকতেন আগরতলায়। তাঁর অবর্তমানে চিফ অব স্টাফের কাজগুলো করতে হতো বাংলাদেশ বাহিনীর উপ-প্রধান একে খন্দকারকে। খন্দকারের ভাষায়, ‘রব সাহেব যুদ্ধের শুরু থেকেই আগরতলায় অবস্থান করছিলেন। চিফ অব স্টাফ হিসেবে তাঁকে আমি কখনো থিয়েটার রোডে দায়িত্ব পালন করতে দেখিনি। সদর দফতরে না থাকায় প্রধান সেনাপতিকে তিনি যুদ্ধের বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেয়ার সুযোগ পাননি। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফের সব দায়িত্ব যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত আমাকেই পালন করতে হয়।’

কলকাতার পুরো সময়টা এভাবেই ঘরে-বাইরে প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে সমরনায়কের যুদ্ধজীবন। এরই মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধের পরিকল্পনা করা হয়। নভেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ নেতৃত্ব গঠনের প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে। কিন্তু জেনারেল ওসমানী সরাসরি যৌথ নেতৃত্ব গঠনের বিরোধিতা করে বসেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বাহিনীর উপ-প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের ভাষ্যে জানা যায়, ‘যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের বিষয়টি প্রথমেই ওঠে রাজনৈতিক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছে। তিনি এই বিষয়টির দায়িত্ব দেন কর্নেল ওসমানীকে। তিনি এই যৌথ নেতৃত্ব গঠনের ঘোরতর বিরোধিতা করেছিলেন। ওসমানী ভারত-বাংলাদেশ একটি যৌথ সামরিক নেতৃত্ব হোক, এটা চাননি। তাঁর মনোভাব ছিল, আমাদের সামরিক তৎপরতা আমরা করবো, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর যৌথ নেতৃত্ব হবে না। শেষে যুদ্ধ পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে রাজনৈতিক পর্যায়ে এই যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সময় কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করেন। এর আগে তিনি কয়েকবার পদত্যাগ করেছেন মৌখিকভাবে। যুদ্ধের এই চূড়ান্ত ও সংকটজনক পর্যায়ে মৌখিকভাবে পদত্যাগের কথা বলার পর ওসমানী সাহেবকে তাজউদ্দিন আহমেদ লিখিতভাবে পদত্যাগ করতে বলেন। তখন তিনি আর লিখিত পদত্যাগপত্র দেননি। এরপর থেকে বলা যায়, তিনি নিষ্ক্রিয় থাকতেন এবং কোনো বিষয়ে কোনো উৎসাহ দেখাতেন না।’

জেনারেল ওসমানী একটা পর্যায়ে এসে ‘নিষ্ক্রিয় থাকতেন এবং কোনো বিষয়ে কোনো উৎসাহ দেখাতেন না’, এ কে খন্দকার হয়তো ঠিকই বলেছেন। তবে তিনি কি স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতেন? নাকি তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল? এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের ভাষ্য পাওয়া যায়। যুদ্ধের একটা পর্যায়ে ওসমানীকে ঘিরে কড়া নজরদারি করা হতো, সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল, তাঁকে যুদ্ধের ময়দানেও যেতে দেয়া হতো না। ওসমানীর জন্য এই পরিস্থিতি ছিল বিব্রতকর এবং অপমানজনক। তারপরও ভারতের এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের জোরালো প্রতিবাদ করতেন তিনি, তেমন দৃষ্টান্তও আছে। মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী লক্ষ্ণৌতে গিয়েছিলেন চিকিৎসাধীন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে দেখতে। কলকাতায় ফেরার পথে বিমানে আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরছিলেন। আবদুস সামাদ আজাদ তাদের দু’জনের দেখা হওয়ার বিষয়টি জাফরুল্লাহকে গোপন রাখতে বলেন। এতে জাফরুল্লাহ’র সন্দেহ হয়। তিনি সামাদ আজাদের কাছে জানতে চান- ‘দিল্লিতে কী করলেন? কোনো চুক্তি হয়েছে কি?’ এরপর বিমানে বসে তাদের দু’জনের মধ্যে যে আলোচনা হয় সামাদ আজাদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে কলকাতায় ফিরে এসে ওসমানীকে সব বলে দেন জাফরুল্লাহ। শুনে ক্ষুব্ধ হন ওসমানী। এরপর যা ঘটেছিল, জাফরুল্লাহ’র ভাষায়- ‘‘ওসমানী সাহেব সোজা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবের ঘরে ঢুকে উচ্চস্বরে কথা বললেন, ‘You sold the country. I will not be a party to it.’ তাজউদ্দিন সাহেব ওসমানীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, নিচু স্বরে কী বললেন আমি শুনতে পেলাম না। আমি দরজার বাইরে ছিলাম।’’

কলকাতায় ফিরে জেনারেল ওসমানীকে কী বলেছিলেন জাফরুল্লাহ, তা তিনি পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দেননি। তবে ধারণা করা হয়, তাজউদ্দিনের ওপরে ওসমানীর সেদিনের ক্ষোভের কারণ ছিল দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত সাত দফা চুক্তি, যা ছিল গোপনীয়। যুদ্ধ চলাকালে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ২/৪ জন অবগত থাকলেও ভারতে আশ্রিত বেশির ভাগ বাংলাদেশির কাছে এই চুক্তির বিষয়টি ছিল অজানা। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক, সামরিক, বাণিজ্যিক, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে একটি সাত দফা গোপন সমঝোতা চুক্তি সম্পাদন করে (তথ্যসূত্র: জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫- অলি আহাদ)

এই সাত দফা চুক্তির কারণেই সম্ভবত জেনারেল ওসমানী সেদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘দেশ বিক্রি’র অভিযোগ করেছিলেন এবং ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বর্ণনায় তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়, ‘‘কয়েকদিন পর উভয়ের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় ভারতীয় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আইন-শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকজন বাঙালি প্রশাসনিক ও পুলিশ অফিসাররা বাংলাদেশের সব বড় শহরে নির্দিষ্ট মেয়াদে অবস্থান নেবেন। ওসমানী সাহেব বললেন, ‘এটা হতে পারে না, আমাদের বহু বাঙালি অফিসার আছেন। কেউ কেউ পাকিস্তানে আটকা পড়েছেন। তারা নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।’ ওসমানী সাহেবের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের মতপার্থক্যের কথা জেনে ভারতীয়রা আরও সতর্ক হলেন। ওসমানী সাহেবকে তারা কড়া নজরে রাখলেন। কাগজে-কলমে যৌথ কমান্ডের কথা থাকলেও বস্তুত তাঁরা ওসমানী সাহেবকে একাকী করে দিলেন। ভারতীয়রা সব কমান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেন। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটলো।’’

এ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করে। তারা পরিকল্পিতভাবে চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় পাকিস্তান বাহিনী একের পর এক পরাজিত হয়ে পিছু হটতে থাকে। বাংলাদেশের অনেক এলাকা যৌথবাহিনীর দখলে চলে আসে। ওইসব এলাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। যুদ্ধ খুব দ্রুতগতিতে পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল। ওসমানী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে যাবেন। ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্তের তত্ত্বাবধানে একটি এম-৮ হেলিকপ্টারে চড়ে ১৩ ডিসেম্বর বিকালে তারা কুমিল্লায় পৌঁছান, উঠেছিলেন ওয়াপদার গেস্ট হাউসে। একে খন্দকারের বর্ণনায় এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি জানান, ‘কর্নেল ওসমানী ১৩ ডিসেম্বর সিলেটের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেন। যাত্রার আগে তাঁকে আমি বলেছিলাম, ‘স্যার, আপনার এখন কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। দ্রুতগতিতে যুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। কর্নেল ওসমানী তাঁর পরিকল্পনা পরিবর্তন না করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।’

ওসমানী যে সিলেটের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন সেটা এ কে খন্দকারের জানা ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান। ওসমানীর অবস্থান সম্পর্কে তিনি অবগত থাকা মানে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রবাসী সরকারেরও বিষয়টি অজানা থাকার কথা নয়। তাছাড়া, জাফরুল্লাহ’র বক্তব্যে ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি, ওসমানী কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, তা কড়া নজরদারি হতো। সুতরাং যুদ্ধজয়ের আগ মুহূর্তে ‘ওসমানী কোথায় ছিলেন’, ‘তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি’- এ ধরনের বক্তব্য সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। যারা এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছিলেন, তাদের একজন ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুস। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি ও স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল খালেকের এক বর্ণনায় এমন তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে আবদুল খালেক ছিলেন সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘বিজয় যখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট, তখন আত্মসমর্পণ উৎসবে আমাদের যোগদান সম্পর্কে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, তাতে স্থির করা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর কর্নেল ওসমানী, রুহুল কুদ্দুস ও আমি হেলিকপ্টারে ভারতীয় কমান্ডারকে নিয়ে ঢাকায় পৗঁছাবো। দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছার জন্য যে সময় দেয়া হয়েছিল, তার ঘণ্টাখানেক আগে আমাদের প্রশাসনে কী যেন একটি হাশ হাশ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আমি তার কিছুই আঁচ করতে পারিনি। রুহুল কুদ্দুস শুধু জানালেন যে, ‘কর্নেল ওসমানীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ কাজেই ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ একে খন্দকারকে খুঁজে বের করা হয়েছে। শুধু তিনি ঢাকায় যাবেন। আমরা দু’জন যাবো না। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে কার কী মতভেদ ঘটেছিল তা আর জানতে পারিনি।’’

১৬ ডিসেম্বর ওসমানী কোথায় ছিলেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্বশীলরা সেটা জানতেন। ওসমানীর সফরসঙ্গী ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত, যিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনস্ত একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ফোর্ড উইলিয়ামে যোগাযোগ হতো। সুতরাং মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুসের উপরোক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। তবে আবদুল খালেক ওসমানীকে নিয়ে হেলিকপ্টারে ঢাকায় পৌঁছার যে সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। পরবর্তীতে তাজউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যের একটি জায়গায় আমরা আবদুল খালেকের এই দাবির সমর্থন খোঁজার চেষ্টা করবো। 

যতদূর জানা যায়, ১৩ ডিসেম্বর বিকাল থেকে ১৬ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত ওসমানীসহ তাঁর সফর সঙ্গীরা ঢাকা থেকে মাত্র ৯৭ কিলোমিটার দূরত্বে কুমিল্লাতেই ছিলেন। এখানে থাকতেই ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত’র কাছে ওসমানী এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা প্রথম জানতে পারেন যে, ঢাকার পতন আসন্ন। সে অনুযায়ী তাঁরা ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাষ্য মতে, ১৬ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত’র কাছে তারা প্রথম জানতে পারেন যে, ওইদিন বিকালে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। এ খবর শোনার পর জেনারেল ওসমানী ছিলেন চুপচাপ, কোনো কথা বলেননি। এরপরের ঘটনা সম্পর্কে জাফরুল্লাহ লিখেছেন, ‘‘জেনারেল ওসমানীর এডিসি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল আমাকে বলল, ‘স্যার কখন রওনা হবেন, তা তো বলছেন না। জাফর ভাই, আপনি যান, জিজ্ঞেস করে সময় জেনে নিন।’... আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করায় ওসমানী সাহেব বললেন, ‘I have not yet received PM’s order to move to Dacca.’ আমি বললাম, আপনাকে অর্ডার দেবে কে? আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। ওসমানী সাহেব বললেন, I decide tactics, my order is final for firing, but I receive orders from the cabinet through PM, Mr. Tajuddin Ahmed.’ কথাগুলো বললেন অত্যন্ত বিষণ্ণ কণ্ঠে। ... ঘণ্টাখানেক পর পুনরায় ওসমানী সাহেবের সামনে দাঁড়ানোর পরপরই অত্যন্ত বেদনার্ত কণ্ঠে যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, ‘আমার ঢাকার পথে অগ্রসর হবার নির্দেশ নেই। আমাকে বলা হয়েছে, পরে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে একযোগে ঢাকা যেতে, দিনক্ষণ তাজউদ্দিন আহমেদ জানাবেন।’ গণতন্ত্রের আচরণে যুদ্ধের সেনাপতি প্রধানমন্ত্রীর অধীন, এটাই স্বাভাবিক বিধান। এরপর ওসমানী সাহেব কামালকে ডেকে সবাইকে তৈরি হতে বললেন। আধাঘণ্টার মধ্যে আমাদের আকাশে নিরুপদ্রব যাত্রা। ভারতীয় হেলিকপ্টারে সিলেটের পথে চলেছি।’’

এখানে প্রবাসী সরকারের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উদ্ধৃতি তুলে ধরছি, যা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ও প্রাসঙ্গিক। ১৯৭১ সালে কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একান্ত সচিব ছিলেন ফারুক আজিজ খান। ১৬ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি কর্নেল দাসের কাছে জানতে পারেন, ফোর্ড উইলিয়াম থেকে খবর এসেছে যে, ওইদিন বিকালেই ঢাকায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে। তিনি এ খবরটি প্রধানমন্ত্রীকে দিলেন এবং তার কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমাদের পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কে প্রতিনিধিত্ব করবে।’ ফারুক আজিজ খানের ভাষায়, ‘প্রধানমন্ত্রী নিচু স্বরে জানতে চাইলেন, ‘কর্নেল ওসমানী কোথায়?’ আমি জানালাম, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ (সিজিএস) লে. কর্নেল আবদুর রবের সঙ্গে কলকাতার বাইরে গেছেন। তাঁরা একটা হেলিকপ্টারে চেপে সিলেটের দিকে গেছেন। আমরা এপর্যন্ত জানতাম। ...‘হাউ আনলাকি হি ইজ।’ প্রধানমন্ত্রী বললেন। ‘সারাটা বছর তিনি নিজের অফিসে কাটালেন। আর আজ এমন দিনে তিনি এখানে নেই।’ একটু বিরতি দিয়ে তিনি বললেন, ‘জেনারেল অরোরার সঙ্গে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার যাবেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে।”

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের এ বক্তব্যে আবদুল খালেকের উল্লিখিত ওসমানীর ঢাকায় যাওয়ার পূর্বগৃহীত কর্মসূচির কিছুটা আভাস রয়েছে। এজন্যই হয়তো তিনি ‘হাউ আনলাকি হি ইজ’ বলে এমন মন্তব্য করেন।

‘জেনারেল ওসমানী কলকাতার বাইরে সিলেটের দিকে গেছেন’, এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি ফারুক আজিজকে বললেন, ‘এ কে খন্দকার ঢাকায় প্রতিনিধিত্ব করতে যাবেন।’ কিন্তু জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছিলেন কি-না, ফারুক আজিজ খান তাঁর বইয়ে সেসব উল্লেখ করেননি। যদিও আমরা জানতে পারি, ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। সেটা বাংলাদেশ সরকার, নাকি ভারতীয়রা করেছিল, তা পরিষ্কার নয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ কে খন্দকারকে ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত কি তাৎক্ষণিক ছিল, নাকি পূর্ব সিদ্ধান্ত? এটি কি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের একক সিদ্ধান্তে হয়েছে, নাকি মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরাও জানতেন? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগামী দিনের গবেষকদের জন্য এসব প্রশ্ন মনোযোগের কারণ হতে পারে। 

১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ওসমানীর উপস্থিত না থাকা নিয়ে ভারতীয় জেনারেল-লেখকদের উপস্থাপিত তথ্যেও ব্যাপক গরমিল রয়েছে, যা বিষয়টিকে আরও জটিল ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতের প্রথম হাইকমিশনার ছিলেন জেএন দীক্ষিত। একাত্তরে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ শাখার পরিচালক হিসেবে দু’দেশের রাজনৈতিক বিষয়াদির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। দীক্ষিত লিখেছেন:

“পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাই কমান্ড কর্তৃক জেনারেল ওসমানীকে উপস্থিত করতে না পারা বা ব্যর্থ হওয়া এবং ওসমানীকে আত্মসমর্পণকারী পক্ষে অন্যতম স্বাক্ষরকারী করানোর ব্যর্থতা ছিল একটি বড় রাজনৈতিক ভুল। জেনারেল ওসমানী ছিলেন যৌথবাহিনীর কমান্ডের একজন শরিক। এই ব্যর্থতার জন্য যে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল সেটা হচ্ছে- ওসমানীকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি উড্ডয়ন করলেও সঠিক সময়ে ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ওই সময়েই ব্যাপক সন্দেহ করা হয়েছিল যে, ওসমানীর হেলিকপ্টারটিকে বিপথগামী করা হয়েছিল। যে কারণে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সকল দৃষ্টি ভারতীয় কমান্ডারদের ওপরে নিবদ্ধ ছিল। এই ঘটনাটি এমন একটি বিচ্যুতি বা বিপথগামিতা বা নীতিভ্রংশ ছিল, যেটা একটু সাবধানতা অবলম্বন করলেই ভারতের পক্ষে পরিহার করা যেত। ঘটনাটি বাংলাদেশি রাজনৈতিক মহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অনুষ্ঠানে ওসমানীর উপস্থিতি পরবর্তীতে তথা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিনগুলোতে ভারত- বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৃষ্ট অনেক ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে সহায়ক হতো।”

একই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন একাত্তর সালে ভারতের তৎকালীন ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল জ্যাকব, যিনি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে ওসমানীর না থাকার বিষয়ে জ্যাকবের বর্ণনাটি এ রকম- “দুর্ভাগ্যবশত কর্নেল ওসমানী এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাঁর জন্য পাঠানো হেলিকপ্টার পথিমধ্যে শত্রুর গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সময়মতো সেটা মেরামত করে তোলা সম্ভব হয়নি।”

দীক্ষিত ও জ্যাকবের বক্তব্যের একটি জায়গায় মিল রয়েছে, তারা বলতে চাইছেন যে, ওসমানী ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আসার জন্য হেলিকপ্টারে করে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে ওই হেলিকপ্টারকে প্রথমজনের ভাষায় বিপথগামী করা হয়েছে, দ্বিতীয়জনের ভাষায় গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে ওসমানীর ঢাকায় আসা হয়নি। তবে বিপথগ্রস্ত হেলিকপ্টারটি কোন জায়গা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল, এই দুই লেখকের কেউই তা উল্লেখ করেননি। বলা বাহুল্য, দীক্ষিত বা জ্যাকব কেউই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। যদিও ওই সময়ের ঘটাবলীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকায় তারা দু’জনই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সোর্স। তথাপি ওসমানীর ঢাকায় আসতে না পারার বিষয়ে তারা যে তথ্য হাজির করেছেন- সেটা অন্য কোনও সোর্স থেকে পাওয়া বলেই আমরা মনে করতে পারি। এ কারণেই ওসমানীর  ঢাকায় যাত্রা প্রসঙ্গে  এই দুই লেখকের দেয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর নয়। কারণ, খোদ ভারতীয় সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কে ভি কৃষ্ণ রাও বলছেন ভিন্ন কথা। অর্থাৎ, জেনারেল ওসমানী সেদিন ঢাকা নয়, সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। একাত্তরে কে ভি কৃষ্ণ রাও ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর ডিভিশন কমান্ডার। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে রাও জানাচ্ছেন, “সিলেট দখল হয়ে যাওয়ার পর জেনারেল ওসমানী আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ...জেনারেল ওসমানী একটি হেলিকপ্টারে করে সিলেটে নামতে চেয়েছিলেন এবং নামার আগে  তাঁর হেলিকপ্টারটি ভূমি থেকে গুলিতে আক্রান্ত হয়।” 

ওসমানীকে বহনকারী হেলিকপ্টারে গুলি করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটি কারা করেছিল তা জানার চেষ্টা হয়নি। ‘শত্রু’র পরিচয় উদঘাটনে পরবর্তীতে বাংলাদেশ বা ভারত কোনো পক্ষই এ নিয়ে তদন্তে আগ্রহী হয়েছে বলেও জানা যায় না। তাছাড়া, ওসমানী ও তার সহযোগীরা যে হেলিকপ্টারে করে সিলেটে যাচ্ছিলেন, সেটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্তের তত্ত্বাবধানে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছিল, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ওসমানীকে ঢাকায় আনার জন্য হেলিকপ্টার পাঠানো ও সেটি মেরামতে বিলম্ব- জ্যাকবের এই দাবির কোনো সত্যতা আছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু, ওই হেলিকপ্টারটি মাটিতে নামার পর পুড়ে যায়। তাহলে সেটি মেরামতের প্রশ্ন আসে কী করে? 

ওসমানীর সেদিনের সফরসঙ্গী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বর্ণনা থেকে বিষয়টির আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- ‘‘ভারতীয় এম-৮ হেলিকপ্টারে সিলেটের পথে চলেছি। ...অতর্কিতে একটি প্লেন এসে চক্কর দিয়ে গেল। হঠাৎ গোলা বিস্ফোরণের আওয়াজ, ভেতরে জেনারেল রবের আর্তনাদ। পাইলট চিৎকার করে বলল, ‘উই হ্যাভ বিন অ্যাটাকড। ...অয়েল ট্যাংক হিট হয়েছে। তেল বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি বড়জোর ১০ মিনিট উড়তে পারবো।’ ...ওসমানী লাফ দিয়ে উঠে অয়েল ট্যাংকারের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ‘জাফরুল্লাহ, গিভ মি ইউর জ্যাকেট’। আমি আমার জ্যাকেট ছুড়ে দিলে, ওসমানী সাহেব সেটা দিয়ে তৈলাধারের ছিদ্র বন্ধের চেষ্টা করতে থাকলেন। ...কার গোলাতে এই দুর্ঘটনা? পাকিস্তানের সব বিমান তো কয়েকদিন আগেই ধ্বংস হয়েছে, কিংবা গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। তাহলে আক্রমণকারী বিমানটি কাদের? গোলা ছুড়ে সেটি কোথায় চলে গেল? ...ওসমানী নিচে একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ল্যান্ড হেয়ার’।...লাফ দিয়ে তিনি নামলেন। ...সঙ্গে নামলাম নিজেও। আমার পেছনে পেছনে অন্যরা লাফিয়ে নামলেন। হেলিকপ্টারটা আমাদের চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনে পুড়ছে।’’ 

প্রসঙ্গত, ওই হেলিকপ্টারটিতে যাত্রী ছিলেন মোট আটজন- জেনারেল ওসমানী, তাঁর এডিসি শেখ কামাল, মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল এমএ রব, সাংবাদিক আল্লামা, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ভারতীয় দুই পাইলট। অজ্ঞাত বিমানের গোলার আঘাতে বিপর্যস্ত হেলিকপ্টারটি মাটিতে নামার পর আগুনে পুড়ে গেলেও এর যাত্রীরা সবাই প্রাণে বেঁচে যান।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী একাত্তরে ছিলেন মুজিব বাহিনীর সংগঠক। ১৬ ডিসেম্বর শেখ কামালসহ জেনারেল ওসমানীকে কুমিল্লায় দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। ওসমানী কেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না, সে সম্পর্কে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের এক আলোচনা সভায় মি. চৌধুরী তাঁর ব্যক্তিগত ধারণার একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন। এ নিয়ে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে এক লেখায় বিষয়টির পুনরুল্লেখ করেন তিনি- ‘যৌথবাহিনী গঠিত হলে উভয় পক্ষের দুই সেনাপতির পদমর্যাদা এক হতে হয়। তাই আগে থেকেই কর্নেল ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। ভারতের পুরো বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যৌথ কমান্ড গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল ওসমানীর সমকক্ষ অর্থাৎ কাউন্টার পার্ট ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর শ্যাম মানেকশ। প্রটোকল অনুসারে শ্যামের সঙ্গে ওসমানী বসতে পারেন। কিন্তু জগজিৎ সিংহ অরোরার উপস্থিতিতে কেবল আমাদের উপপ্রধান একে খন্দকারই বসতে পারেন। ওসমানীর উপস্থিতিটা হতো আমাদের জন্য চরম অবমাননাকর ও সামরিক প্রটোকল বহির্ভূত। তাই উপ-প্রধানের সঙ্গে উপ-প্রধানের সমতা বিধানের জন্যই ওসমানী সাহেব পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না, ছিলেন খন্দকার সাহেব।’

বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক- বেসামরিক, সরকারি ও বেসরকারি কোনো স্বীকৃত উৎসে চৌধুরীর এই বক্তব্যের সমর্থনে লেখা, উদ্ধৃতি, বই ও দলিল আছে বলে দৃশ্যমান কোনো অফিসিয়াল প্রমাণ আজও হাজির করেনি কেউ। তাই তাঁর ভাষ্যটিকেও ‘একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা’ বলে গণ্য করাই শ্রেয়। মুক্তিযুদ্ধের লেখক, গবেষক ও মুজিব বাহিনীর সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ বর্তমান লেখকের সঙ্গে এক আলাপে দাবি করেন, ‘পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানী বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবেনÑ ভারতীয়দের এই সিদ্ধান্ত ছিল।’ আহমেদের এই দাবিও মৌখিক, দালিলিক নয়। 

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানীর না থাকা নিয়ে বেশ কৌতূহলপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ভারতীয় জেনারেল এসএস (সুজন সিং) উবান। তিনি ছিলেন ভারতের স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি)। তার তত্ত্বাবধানে গঠিত হয়েছিল মুজিব বাহিনী। উবান বলেছেন, ‘কেউ একজন নৈতিক ভুলটা করে বাংলাদেশ আর্মির সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার একটা ঐতিহাসিক সুযোগ নষ্ট করেছিল।’ 

এ আলোচনার উপসংহার টানার আগে আমরা আরেকবার জেনারেল ওসমানীর শরণাপন্ন হবো। তাঁর বক্তব্যে আভাস রয়েছে, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্সে পরাজিত বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন। যেহেতু তিনি প্রবাসী সরকারের অধীনস্ত একজন কর্মকর্তা (সেনাপ্রধান), তাই প্রবাসী সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। শেষঅব্দি ওসমানী নির্দেশ পেয়েছিলেন ঠিকই- তাঁকে ঢাকায় যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁকে ঢাকায় যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। স্বভাবতই যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে, তালে হালো- আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতিকে যেতে দেয়া হয়নি কেন? আজও এ প্রশ্নের উত্তর অজানাই রয়ে গেছে। তাজউদ্দিন আহমেদ বেঁচে নেই। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কেউ কেউ এখনও জীবিত। এই প্রশ্নের সঠিক জবাব তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন এবং ইতিহাসের প্রয়োজনে তাঁদের সেটা বলা উচিত।


তথ্য সূত্র:

রাও ফরমান আলী খান- বাংলাদেশের জন্ম। দি ইউনিভার্সিটি লিমিটেড। পৃ. ১২.

লে. জেনারেল গুল হাসান খান- পাকিস্তান যখন ভাঙলো। দি ইউনিভার্সিটি লিমিটেড। পৃ. ৩০.

লে. জে. (অব.) কামাল মতিনউদ্দিন- ট্র্যাজেডি অব এররস্: পূর্ব পাকিস্তান সংকট ১৯৬৮-১৯৭১, পৃ. ১৭৪ 

লে. কর্নেল (অব) এমএ হামিদ- তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা। মোহনা প্রকাশনী। পৃ. ৮৬-৮৭

এ কে খন্দকার- ১৯৭১: ভেতরে-বাইরে। প্রথমা প্রকাশন। পৃ.  ২০৭

এ কে খন্দকার, মাঈদুল ইসলাম ও এস আর মীর্জা- মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন। প্রথমা প্রকাশন। পৃ. ৯৮

জাফরুল্লাহ চৌধুরী- মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি খণ্ড চিত্র, নতুন দিগন্ত, ষোড়শ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা এপ্রিল-জুন ২০১৮, পৃ.  ৫৭ থেকে ৫৯

অলি আহাদ- জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, পৃ. ৪৩৩ 

মহিউদ্দিন আহমদ- আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১। প্রথমা প্রকাশন, পৃ. ১৪৬

ফারুক আজিজ খান- বসন্ত ১৯৭১। প্রথমা প্রকাশন। পৃ. ১৯৩

জে এন দীক্ষিত- লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড: ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশন্স, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৯, পৃ. ১০৯

লে. জেনারেল জেএফআর জ্যাকব- সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: একটি জাতির জন্ম, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, পৃ. ১২১

মেজর জেনারেল (অব.)  সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহীম, মিশ্র কথন, অনন্যা, পৃ. ২১৬

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী- জেনারেল ওসমানী এবং পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

মেজর জেনারেল (অব.) এসএস উবান- ফ্যান্টমস অব চিটাগং: দ্য ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ। ঘাস ফুল নদী। পৃ. ১২০

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫