-62176f08742b4.jpg)
গ্যাসের দুই চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একই হারে আবাসিকের প্রিপেইড মিটার, শিল্প, সিএনজি, বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত। গ্যাস খাতে সরকারের সাতটি কোম্পানির মধ্যে ছয়টি বিতরণ কোম্পানি এবং একটি সঞ্চালন কোম্পানি। সঞ্চালন কোম্পানি যে দামে গ্যাস সরবরাহ করে, পরিচালন কোম্পানিগুলো তার সঙ্গে তাদের কোম্পানির পরিচালন ব্যয় এবং আরও কিছু আনুষঙ্গিক ব্যয় যোগ করে যে মূল্য নির্ধারণ করে তাই গ্রাহক পরিশোধ করে থাকে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর আগামী ২১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত গণশুনানি করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সর্বশেষ ২০১৯ সনে আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলার জন্য মাসে ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকার স্থলে ৯৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ ছাড়াও যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম প্রতি ঘনমিটার ৩৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৪৩ টাকা; এ ছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত।
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা শুনেই আমার স্ত্রী রেগে অস্থির। তার অভিযোগ, আমি রাত জেগে পত্রিকায় ছাপানোর জন্য কলাম লিখি, এই লিখার জন্য সারাদিন পড়ি, সংসারের কোনো সমস্যার প্রতি আমার কোনো নজর নেই। বিগত তিন মাস ধরে বাসায় গ্যাস নেই। ভাড়াটিয়ারা তাদের সকল রাগ আমার স্ত্রীর ওপর ঝাড়ে। ভাড়াটিয়াদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, তারা কেউ এখন ঘরে রান্না করে খেতে পারছে না। গভীর রাতে গ্যাস আসে, আমার স্ত্রী রাত ৩টায় ঘুম থেকে ওঠে সারাদিনের রান্নাটা করে রাখে, সারাদিন ফ্রিজে রেখে বিদ্যুৎ খরচ করে আবার মাইক্রোওভেনে গরম করে খেতে হয়। এই কষ্ট ভাড়াটিয়ারা করতে সম্মত নয়, তিনটি পরিবার বাসা ছেড়ে দিয়েছে, যাওয়ার সময় ভাড়াও দেয়নি। আমি নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ পাশের গ্যাস অফিসে গিয়ে কোনো প্রতিকার পাইনি। তারা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘শীতকালে গ্যাস পাবেন না’। সঙ্গে সতর্ক করে দিয়ে আরও উল্লেখ করেছেন যে, শীতকালে গ্যাস না থাকলেও বিল কিন্তু দিতে হবে, না দিলে লাইন কেটে দেবে। আমার স্ত্রীর হুকুম, পত্রিকায় লেখা ছেড়ে দিতে হবে, এই সকল লেখায় নীতি নির্ধারকদের কিচ্ছু যায় আসে না।
সারাদেশে বর্তমানে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট; এখন দিনে গড়ে সরবরাহকৃত ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে ২৩০ কোটি ঘনফুটের বেশি আসে দেশের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে এবং প্রতি ইউনিট বা এক হাজার ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদনে খরচ হয় দুই টাকার কিছু বেশি। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় প্রতি ইউনিট ৩৮ টাকা দরে কাতার এবং ওমান থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি হয় ৫১ কোটি ঘটফুট, আর ১৫ কোটি ঘটফুট কেনা হয় আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে যার বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৮৫ টাকা। ওমান এবং কাতারের সঙ্গে যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে গ্যাস আমদানি হচ্ছে তাই গ্যাসের দাম খোলা বাজারের সাথে ওঠানামা করবে না।
খোলা বাজার থেকে কেনা মাত্র ১৫ কোটি ঘনফুটের দাম বাড়ার কারণে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য নয়। সরবরাহকৃত সব গ্যাসের বর্তমান বাজার দর ৮৫ টাকা ধরে হিসাব করে সম্ভবত ইউনিট প্রতি ২১ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে, অথচ বর্তমানে গ্রাহকের কাছে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৯ টাকা ৩৭ পয়সায়।
গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি এই তিনটি সেবাখাতের বদনাম নতুন নয়, পাকিস্তান আমল থেকে শুনে আসছি। সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিচ্ছে; গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির আলাদা আলাদা অফিস আছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে, তারা গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ বিক্রি করে নিজেদের খরচও নির্বাহ করতে পারে না, সরকারকে তাদের ঘাটতির টাকা পূরণ করে দিতে হয়। আমরাও চাই সরকার ভর্তুকি প্রদান হ্রাস করুক, আমরা গ্রাহকেরা প্রকৃত মূল্যে এগুলো ব্যবহার করব। কিন্তু এগুলোর প্রকৃত মূল্য তো কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের চুরির টাকা গ্রাহকেরা কেন দেবে? এশবার একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম, তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘুষ ‘ওজনে মেপে’ নেন। বাসাবাড়িতে প্রতি চুলার জন্য মাসে দিতে হয় ৯৭৫ টাকা; কিন্তু যাদের বাসায় মিটার রয়েছে তারা প্রতি মাসে ৪০০ টাকার মতো গ্যাস ব্যবহার করেন। মোট ব্যবহৃত গ্যাসের ১৬ শতাংশ গ্যাসকে আবাসিকে ব্যবহার দেখানো হয়; কিন্তু ব্যবহৃত হয় মাত্র ৮ শতাংশ, বাকি ৮ শতাংশ চুরি। প্রিপেইড মিটার বসালে চুরি কিছুটা কমতো। শিল্পকারখানায়ও মালিকদের দাবি অনুযায়ী মিটার বসানো হচ্ছে না। কারণ মিটার স্থাপন করে বৈধ পন্থায় ব্যবহৃত হলে গ্যাস ব্যবহারের হিসাব পাওয়া যাবে, চুরি বন্ধ হবে। কোথাও কোথাও মিটার স্থাপন করা হলেও তা খুবই কম, যে গতিতে মিটার স্থাপন করা হচ্ছে সেই গতি অব্যাহত রাখা হলে সব গ্রাহকের মিটার পেতে কমপক্ষে ১০০ বছর লাগবে। মিটার বসিয়েও গ্যাস অফিসের অসৎ লোকগুলো মিটার টেম্পারিং করে, মিটার বাইপাস করে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করে দেয়। পত্রিকায় খবর হয়, মিটার রিডার শত শত কোটি টাকার মালিক। বাসাবাড়িতে বৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় অবৈধ সংযোগ বাড়ছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, তিতাসের বোর্ড ২০১৮ সনে প্রায় ৭ লাখ অবৈধ সংযোগ বৈধ করেছে। যারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তারাই আবার ঘুষ নিয়ে সংযোগ স্থাপন করে দেয়, এই সংযোগ স্থাপনে গোপনীয়তা নেই।
করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত, প্রায়প্রতিটি দেশের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও নিত্যপণ্যের দাম উর্ধ্বগতি, কর্ম হারানো মানুষের ভীড় ক্রমশ বাড়ছে, ধনী ও সম্পদশালী দেশগুলো ভর্তুকি আর প্রণোদনা দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মতো গরীব দেশের অবস্থা ভয়াবহ, সীমাহীন ভর্তুকি আর প্রণোদনা দেয়ার আর্থিক সামর্থ্য গরীব দেশগুলোর নেই।
কয়েক মাস আগে ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে তা উতরানোর আগেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা সুবিবেচনা প্রসূত বলে মনে হয় না। পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না করে দাম বাড়ানোর কথা শুনে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার দুরভিসন্ধিও থাকতে পারে।
দেশে জ্বালানি খাতে গ্যাস আমদানি নির্ভরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের দাম বাড়বেই। শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে হলে বিদেশ থেকে অধিক পরিমাণে গ্যাস আমদানি করতে হবে। আমাদের নিজস্ব গ্যাসের প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ মাত্র দুই টাকা, অথচ সেই গ্যাস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে ৮৫ টাকা দিয়ে। আগে বলা হতো, দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে, কিন্তু বর্তমানে প্রাপ্ত গ্যাস দিয়ে কোনোভাবেই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাস অনুসন্ধানেও নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে প্রচুর আন্দোলন দেখেছি। পারমাণবিক এবং কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষেও বিক্ষোভ হয়েছে। এই অবস্থায়ও পারমানবিক ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়ে সরকার সঠিক কাজ করেছে। এখন আস্তে আস্তে গ্যাসের ব্যবহার কমবে, বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে; কিন্তু যথাযথ সেবা না দিয়ে বছর বছর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ জনগণ সহজভাবে নেয় না। এই সকল খাতের চুরি, ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হলে সরকারের ভর্তুকি দেয়া এবং দাম বৃদ্ধির দরকার হবে না। এই তিনটি সেবা খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে, সংস্থাগুলোতে দলীয় রাজনীতি প্রবল, যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের লোকেরা সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। এই কারণে গ্রাহকদের অভিযোগ আমলে নেয়ার গরজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না।