Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ক্ষমতার স্বাদ, শোক ও শিক্ষা

Icon

হামীম কামরুল হক

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:৪১

ক্ষমতার স্বাদ, শোক ও শিক্ষা

হামীম কামরুল হক

রাজনীতিবিদরা সবাই ক্ষমতার স্বাদ পেতে চান, না পেলে শোক করেন। কিন্তু স্বাদ বা শোক কোনোটাই ক্ষমতাসীন সময়ে তাদেরকে ক্ষমতাহীন সময়ের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘুরে ফিরে আমাদের এ-ই দেখতে হয়েছে। কেউ কারো ভূমিকা বদল করেন না। দেশের মঙ্গলের দিকে তাকানোর চেয়ে ক্ষমতার দাপট দেখানোটাই তাদের কাজ হয়ে ওঠে।

আমেরিকা নামের দেশটার রাজনীতির অনেক দোষ আছে। তাদের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনমহল জানেন ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে সম্পর্ক দা-কুমড়ো না হলেও কোনো অংশে কম নয়, কিন্তু তাদের প্রেসিডেন্ট কখনো নিজের সরকারি দপ্তরকে নিজের দলীয় দপ্তর করে তোলেন না। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নিজের দলের কীর্তি কীর্তন এবং বিরোধীদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেন না, আর বিরোধীরাও সরকারপক্ষকে দেশের স্বার্থে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে থাকে। ক্ষমতায় থাকা বা না-থাকাতে দেশের জন্য কাজ করা বা মানুষের অধিকার সংরক্ষিত করার চেষ্টা তাদের থেমে থাকে না। গণতন্ত্রের এই ন্যূনতম দিকটা তারা খেয়াল রাখেন বলেই হয়তো দেশে সার্বিকভাবে একটি ঐক্যভাব বিরাজ করে।

কিন্তু আমাদের দেশে ‘জাতীয় ঐক্য’ একটা মুখের কথা হয়ে আছে। ব্রিটিশদের নীতি ছিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’- বিভক্ত করো এবং শাসন করো- আমাদের দেশে এখন ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানীরা নেই- কিন্তু আমরা নিজেরাই নিজেদের বিভক্ত করে রেখেছি, তার জন্য সূত্রধরের ভূমিকায় আছেন রাজনীতিবিদরা। আর সেই সুযোগে বার বার ‘ঘুঘু’রা এসে আমাদের নাগরিক অধিকারের সমস্ত ধান ও ধন সাবাড় করে দিচ্ছে।

অনেকেই বলেন বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। যেকোনো রকম আধিপত্যবাদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে বাংলাদেশকে। কিন্তু বাংলাদেশের আধিপত্যবাদের দালালরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একভাগ ‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসা’ করছে অন্যভাগের লোকজনেরা ধর্ম-ব্যবসা করছে। একভাগ অন্যভাগকে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদের দোষ ঘাড়ে চাপাতে সব রকমের প্রচারপ্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যভাগ তাদের বিপক্ষকে ফ্যাসিবাদী, গণতন্ত্রের শত্রু ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করে চলেছে। কিন্তু কোনো ভাগের মুখে বাংলাদেশের মানুষের নিত্যদিনের সমস্যাগুলো নিয়ে জোরালো কোনো কিছু শোনা যায় না। দেশের সমস্যার কথাগুলো রঙ চড়িয়ে বলার চেয়ে সমস্যাগুলো একে একে কী কী ভাবে সমাধান করা যেতে পারে, তা নিয়ে কোনো পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাবনার কথা শোনা যায় না। আর এক শ্রেণির প্রচার মাধ্যমের কাজ হচ্ছে, এই বিভেদকে উসকে দিয়ে ব্যবসা করা। সংবাদমাধ্যম কতটা দেউলিয়ার হতে পারে- সেটা আমরা দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে নানান সময় খেয়াল করেছি। তারা জনগণের পক্ষে বা সত্যের পক্ষে কোনো দিকেই অবস্থা গ্রহণ করে না। যেদিকে থাকলে তাদের অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত হয় সেদিকেই তাদের অবস্থান। সর্বত্র তাদের সুবিধা বাদী চরিত্রই প্রকট হয়ে উঠেছে।

সেজন্য বলতে ইচ্ছা করে, বাংলাদেশে রক্ষা করার চেয়ে বাংলাদেশেই আমাদের রক্ষা করুক। বাংলাদেশে রক্ষা করার কথা যখন বলা হয়, তখন আমরা বর্তমানের বাংলাদেশকে রক্ষা করার কথাই বলি, কিন্তু বাংলাদেশ যখন আমাদের রক্ষা করে তখন বাংলাদেশ তিনকালে এক হয়ে উঠতে থাকে। তার শক্তি আসে ইতিহাস থেকে, বর্তমান থেকে এবং তার শক্তি সঞ্চিত হয় ভবিষ্যতের জন্য। 

এদেশের রাজনীতি আর কোনো সু-কীর্তি তৈরি করে না, তার বদলে রাজনীতি ও ক্ষমতা হয়ে ওঠে কু-কীর্তির ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষের সরলতা নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে খেলা চলে রাজনীতির মাঠে। অন্যদিকে এদেশে যা কিছু উন্নয়ন হচ্ছে তা তো হচ্ছে সময়ের দাবীতে। সময়ের দাবীতেই আজ হোক কাল হোক নিশ্চিত করতেই হবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, সুপেয় জলের ব্যবস্থা, দিতে হবে খাদ্যের নিরাপত্তা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় আনতে হবে গতি। কোনো ব্যক্তিকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের জীবনে যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, তা কোনো কারণে এসেছে- তা কি রাজনীতিবিদগণের কোনো ভূমিকার কারণে এসেছে? নাকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে এসেছে? বোধ করি, বেশিরভাগই একমত হবেন যে, আমাদের জীবনের যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য তা কমবেশি যাই হোক তার পেছনে এখন রাজনীতিবিদদের সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই।

বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারই এর জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তাহলে রাজনীতিবিদদের দরকার কী? কী দরকার বার বার নির্বাচন করে দেশে সেই একই থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়ের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন বিরোধী দলের? এতে কথা দাঁড়ায় এই যে, রাজনীতি একটা মৃত ব্যবস্থা। এর আর কোনো প্রাণ নেই। বর্তমানে যা আছে তা হলো রাজনীতির মৃতদেহ। এই দেহের ভার আর কতদিন জনগণ তাদের নিজেদের কষ্টার্জিত টাকায় পুষবে? তাহলে বিকল্প কী?- এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত কারো নেই। কথায় বলে, ‘রাজা গেছে পাটে/ মানুষ মানুষ কাটে’। একসময় রাজাই ছিল সবকিছুর মূল। তাকে ছাড়া কোনো রাজ্যভাবা যেত না। সেই রাজতন্ত্রের সময় ভাবা কঠিন ছিল, যে দেশ চালাতে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে পারে, সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা আসতে পারে।

আজ যেমন করে ভাবা কঠিন- এইভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচনের ভিত্তিতে কিছু লোককে সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষমতায় বসানোর বিকল্প আর কোনো কিছু থাকতে পারে। কিন্তু নিশ্চয় এর বদল ঘটবে একদিন। ইউরোপের দেশগুলো তাদের রাজনৈতিক পদ্ধতির মূল ব্যবস্থাকে যে কটি কারণে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে, তার ভেতরে একটি প্রধান কীর্তি হলো ‘প্রশাসনিক স্বচ্ছতা’। বোধ করি এই একটি কারণেই সেখানে এমন এক ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে, যাতে রাজনীতিবিদদের খুব বেশি ভূমিকা পালন করতে হয় না। তারা সেই রকম ভূমিকাই পালন করেন, যেভাবে একটি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান গাড়ির চালক। অর্থাৎ একজন পরিচালকের ভূমিকা ছাড়া তাদের ওইসব ক্ষমতা, দাপট দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। নেই স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণের কোনো বালাই। জার্মানির নতুন যুগের রাষ্ট্রনায়ক হেলমুট কোহলের কন্যা একটি সামান্য চাকরি করতেন।

ইউরোপের দেশে দেশে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেখানে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে তাদের সন্তানদের, পরিবার পরিজনের স্বার্থসিদ্ধি করেন না। আর আমাদের এখানে যা চলে তা সামন্ততন্ত্রেরই চোলাইকৃত রূপ। দেশে যিনি ক্ষমতায় আসেন দেশ যেন হয়ে ওঠে তাদের নিজস্ব জমিদারী। আর সেখানে চলতে থাকে সামন্ততান্ত্রিক সময়ের পঁচাগলা অনাধুনিক রীতিনীতি। ফলে সামন্ত্রতন্ত্রের চর্চা করে মুখে গণতন্ত্রে বুলি আর যাই হোক ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। আর সেই কাজটি যখন ক্ষমতাহীন হয়ে গেলে পারা যায় না, তখন থাকেন কেবল ক্ষমতার জন্য শোক। জনগণের আরো কল্যাণের জন্য সেখানে নতুন কোনো চিন্তা স্বপ্ন কারো ঘুমে বা জাগরণে দেখা দেয় না, তার বদলে দেখা দেয় ক্ষমতা হারানোর কারণে হাপিত্যেশ। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার সময় রাজনীতির ধারা বদলে দেওয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ কোনো দলেকেই নিতে দেখা যায় না। 

দিন বদলের ও পরিবর্তনের রাজনীতির কথা বলা হয়েছিল, পরিবর্তন হলো কোথায়? এখন ক্ষমতাহীনরা নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলছেন, বলছেন আগের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার কথা। বর্তমানের ক্ষমতাসীনরা পরিবর্তনের কথা বলে যতটা না তারা বদল ঘটিয়েছেন, তারচেয়ে বেশি দেশের বদল ঘটিয়েছেন দেশের শ্রমজীবী মানুষেরা। দেশে ও দেশের বাইরে তাদের রাখা নানান ভূমিকার কারণে দেশের আগ্রগতি ঘটেছে। এই মানুষেরাই একসময় মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, এই মানুষেরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলেন, তারা সবই করেছেন তাদের অস্তিত্বের জন্য। তাদের অস্তিত্ব মানেই বাংলাদেশর অস্তিত্ব। তারাই আছে বাংলাদেশের জন্য। আর সুবিধা গ্রহণের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ওৎ পেতে আছেন দলকানা রাজনীতিবদরা।

রাজনীতিবিদদের এই ভূমিকার কথা একবার নিদারুণভাবে বলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান: Somebodz for Awami League , somebodz for BNP, but nobodz for Bangladesh. একটি দলের দায়িত্বশীল নেতা হয়েও তিনি যে এই কথা বলেছিলেন, তাতে যেন জনগণের মনের কথায়ই ব্যক্ত হয়েছিল। কেউ আছেন এই দলের জন্য, কেউ ওই দলের জন্য, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য কেউ নেই- এর মানে আদতে ক্ষমতার রাজনীতি যারা করেন তারা কেউ-ই বাংলাদেশের জন্য নেই। বাংলাদেশের জন্য সব সময় আছে এদেশের জনগণ- যারা তৃণের মতো ক্ষুদ্র কিন্তু তাদের প্রাণ অবিনাশী। কত ভালো হতে পারত যদি এই জনগণ সঠিক নেতৃত্ব পেত- তাহলে বাংলাদেশ অতি অল্প সময়ে হয়ে উঠতে পারত বিশ্বের তেমন দৃষ্টান্ত, যেমন দৃষ্টান্ত এদেশ স্বাধীনতার সময়ে হয়ে উঠেছিল।

আমরা সবসসময় মনে করি, জনগণের ভেতরে কোনো বিভেদ-বিভক্তি নেই। বিভক্ত করার তাল সব সময় রাজনীতিবিদরা ঠোকেন, কারণ ওই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। তাদের মুখে, ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ কথা শোনা যায়। জনগণ কখনো জানে না কারা এই ‘আমরা’ কারা ওই ‘ওরা’। হায়! একটি দেশ, ভাষাও একটি, ধর্ম লোকজনের যা-ই হোক, দেশ তো সকল ধর্মেরই- তবে সেখানে এত বিভেদ কেন? বলা বাহুল্য বাঙালির ধর্ম মানে সব ধর্মের সমন্বয়, যে ধর্মের রীতিনীতি বাঙালি জন্ম-বিবাহ-মৃত্যুসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে দেখা যায়। সমাজটা এখনো বাঙালিদেরই হয়ে আছে, অথচ রাষ্ট্র আজো বাঙালিদের হলো না, এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য- সেখানে আজো আধিপত্যবাদের কূটচালে বদল ঘটে অনেক কিছুর, কিন্তু বাঙালি জানে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবেই, নতুন ধারার রাজনীতিই হবে বাংলাদেশের নিয়তি। 


লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫