
মফিজুর রহমান রুন্নু
মানুষের বেঁচে থাকা, তার সমাজচেতনা, বিশ্বাস, ভাবনা, মূল্যবোধ ইত্যাদিসহ তার সামগ্রিক জীবনচেতনা প্রতিফলিত হয় সংস্কৃতির মধ্যে। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই ব্যক্তি মানুষ অন্য সকল মানুষের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। এভাবে ব্যক্তির ভাবনা সমগ্রের ভাবনা হয়ে ওঠে। একটি জাতি গঠনে যা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সংস্কৃতি শুধু বেঁচে থাকা নয়, বরং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে শেখায়।
সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে শুধু নিজের জন্য নয়, গোটা সমাজের জন্য যা কিছু প্রতিবন্ধক সেগুলোকে যথাযথ উপলব্ধি করতে হয়। আর তা করতে প্রয়োজন হয় নিজের মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম অনুভূতি জাগিয়ে তোলা। সংস্কৃতির পরিমণ্ডল ছাড়া এই সূক্ষ্ম অনুভূতি জন্ম নেয় না। কেউ কেউ এজন্য তো সংস্কৃতিকে এক ‘উচ্চস্তরের ধর্মও’ বলতে পছন্দ করেন। সংস্কৃতির এই ধর্ম সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের জীবনকে আরও সুন্দর, নির্বিঘ্ন, পরিশীলিত ও সমাজসচেতন করে তোলে। এ কারণে মানুষের সংস্কৃতি সবসময় বিকাশমান, সৃজনশীল ও কল্যাণময়। মানবসমাজে সংস্কৃতির আবির্ভাব হয়েছিল বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের প্রাণশক্তি হিসেবে। এ কারণে সংস্কৃতি শুধুমাত্র বিনোদন বা মনোরঞ্জনের বিষয় নয়, বরং তার প্রধান ভূমিকাই হলো মানুষের জীবন সংগ্রামের সহায়ক হওয়া। কৃষক যখন ক্ষেতে কাজ করে, মাঝি যখন নৌকা বায়, শ্রমিক যখন ছাদ পেটায় বা চাষী বৌ-মেয়েরা যখন ঢেঁকিতে পাড় দেয় তখন তারা প্রাণ খুলে গান করে-তা কি অন্য কারো মনোরঞ্জনের জন্য? নিশ্চয় না। এসব গান তাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের সাথে মিশে থাকে।
সংস্কৃতি সমাজবদ্ধ মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, অনুভূতি ও আবেগকে ধারণ করে। তাই সংস্কৃতির ভূমিকা মানবিক। যে সংস্কৃতি মানুষের গোষ্ঠীজীবনকে উন্নত, কল্যাণকর ও বিকশিত করতে ভূমিকা রাখে তাকে আমরা সুস্থ সংস্কৃতি বলতে পারি। মানুষের সামাজিক সংকট ও এগিয়ে চলার পথে যাবতীয় বাধা-বিঘ্ন থেকে উত্তরণে সুস্থ সংস্কৃতি মানুষকে নতুন দিশা দিতে পারে। মানুষের আবেগকে ধারণ করে বলেই তা নানা মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সংকটে-সমস্যায় মানুষের প্রতিবাদ, বিদ্রোহ ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয় এবং সমাজকে বদলে দিতে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সুস্থ সংস্কৃতি হল সেই সংস্কৃতি যা যাবতীয় অসংগতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সংস্কৃতির ঐতিহাসিক দায়িত্ব হলো সুস্থ, সংগতিপূর্ণ ও প্রগতিশীল এক সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামের সাথে একাত্ম হওয়া। যারা সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে কাজ করেন তাদের এই বাস্তবতার বাইরে থাকার কোনো উপায় নেই। লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক তথা সাংস্কৃতিক জগতের মানুষদের জন্য যাবতীয় সামাজিক অসংগতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং সামগ্রিক প্রগতির পক্ষে থাকা একটা নৈতিক দায়। প্রতিটি সমাজেই সুস্থ অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে এক চলমান সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন হয়।
বাঙালির জীবনে যখনই ক্রান্তিকাল দেখা দিয়েছে তখনই সে তার প্রতিবাদ, সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রগুলোকে বেছে নিয়েছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর থেকে বাংলায় যে স্বদেশচেতনা জাগ্রত হতে থাকে নানা দেশাত্মবোধক গানের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে (১৯০৫-১৯১১) বাংলাভাষায় গান ও কবিতা রচনার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এক নতুন ধারার সূচনা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে পঞ্চকবির ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। শুধু বঙ্গভঙ্গ নয়, ব্রিটিশের শোষণ-শাসনের প্রতিবাদে রচিত হয় নানা কালজয়ী গান, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। তবে সামগ্রিকভাবে সাধারণত নিপীড়িত মানুষের দুর্দশা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে ধারণ করে সংস্কৃতিকে এক সংগঠিত আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। এর পিছনে ভূমিকা রাখেন মূলত কমিউনিস্টরা। তাদের উদ্যোগেই সংগীতের এক নতুনধারার সূচনা হয়, যাকে বলা হয় ‘গণসংগীত’। প্রগতি লেখক সংঘ, ইয়ুথ কালচারাল ইনস্টিটিউট, গণনাট্য সংঘ, ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ ইত্যাদি সংগঠন গড়ে ওঠে মূলত কমিউনিস্টদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রচেষ্টায়। গান, কবিতা, চিত্রকলা ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনভাবে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়।
১৯৪৬-এর বাংলায় কয়েক বছরব্যাপী কৃষকের যে তেভাগা আন্দোলন চলে তার উত্তাল আবহাওয়ায় রচিত হয় অনেক বিখ্যাত গণসংগীত, কবিতা, গল্প ও নাটক। ৩০ থেকে ৪০-এর দশকের এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামনে চলে আসেন- ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তুলসী লাহিড়ী, রাধারমণ মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, অমল দাশগুপ্ত, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, রণেশ দাশগুপ্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিনয় ঘোষ, অচ্যুত গোস্বামী, সোমেন চন্দ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, সোমনাথ হোড়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক, কবি, সুরকার, গায়ক ও অভিনেতা।
আমরা দেখেছি বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে শক্তি জুগিয়েছে প্রতিবাদী গণ-সংস্কৃতি। ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষ যখন সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তখনও আমরা গান, কবিতা, নাটক, কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র ইত্যাদির সৃজনশীল ব্যবহার দেখেছি। স্বাধীনদেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র জনগণের প্রতিবাদ-দ্রোহ ও আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে স্ব স্ব ভূমিকা রেখেছে।
আমাদের দেশে সর্বপ্রথম বিভিন্ন সামাজিক অসংগতি, পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার ইত্যাদির আবর্ত থেকে বেরিয়ে এক আধুনিক সমাজগঠনে সংস্কৃতিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করি ২০-এর দশকে। ১৯২৬ সালে ঢাকাতে আবুল হুসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আব্দুল কাদির প্রমুখ ‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মুখপত্রের নাম ছিল ‘শিখা’। এজন্য তারা ‘শিখা গোষ্ঠী’ নামেও পরিচিত ছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সংগঠক ও লেখকরা এ দেশের মুসলমানদের ধর্মের আচারসর্বস্বতা ও গোঁড়ামী থেকে মুক্ত করে এক মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তির ধারায় শামিল করতে চেয়েছিলেন।
গণমুখী ও প্রগতিশীল ধারার সাহিতচর্চার লক্ষ্যে ১৯৩৬ সালে ১০ এপ্রিল ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’ গঠিত হয়। এই সংঘের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে অনেকেরই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগ ছিল। ১৯৩৯ সালে ঢাকায় গঠিত হয় ‘প্রগতি লেখক ও শিল্লী সংঘ’। এ সংঘের উদ্যোক্তারাও ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত এবং বাম চিন্তাধারার অনুসারী। এই সংঘে যুক্ত ছিলেন- সত্যেন সেন, রেবতী বর্মণ, রণেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী, জোর্তিময় সেনগুপ্ত, সোমেন চন্দ, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সানাউল হক, মুনীর চৌধুরী, আব্দুল্লাহ আল মুতী, শেখ লুৎফর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আব্দুল কাদির, আব্দুল গণি হাজারী, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ।
‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর বেশ কয়েকজন সদস্যও এই সংঘের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সদস্যরা চেয়েছিলেন তাদের সাহিত্য ও শিল্পের মাধ্যমে এদেশে প্রগতিপন্থী, দেশপ্রেমিক ও সমাজসচেতন মানুষ গড়ে তুলতে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের আগেই ‘পূর্বপাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’, ‘পূর্বপাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই গঠিত ‘তমদ্দুন মজলিশ’ এর সঙ্গে যুক্ত লেখক, কবি ও বুদ্ধিজীবীরা চেষ্টা করেছেন আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে যাতে তা নতুন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উপযোগী হয়ে ওঠে এবং তা যেন হয় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি থেকে স্পষ্টভাবেই পৃথক। এসব সংগঠনের উদ্যোক্তরা বাংলার ‘মুসলিম সংস্কৃতি’কে ‘হিন্দু সংস্কৃতি’ থেকে আলাদা করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আসকার ইবনে শাইখ, বদরুদ্দীন উমর, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। এসব সংগঠন সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রগতিধারার বিরোধিতা করে এবং ইতোপূর্বে ঢাকাকেন্দ্রিক ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর মুক্তচিন্তা চর্চার ধারাটিরও পক্ষাবলম্বনের বিপক্ষে দাঁড়ায়।
তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর ১৯৫২ সালে প্রগতিশীল চিন্তা ও সাহিত্যচর্চার লক্ষ্যে ঢাকায় গঠন করা হয় ‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার লেখক-শিল্পীরা এই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। সাহিত্য সংসদের সভাপতি হন কাজী মোতাহার হোসেন। অন্যান্যদের মধ্যে যুক্ত ছিলেন- সরদার জয়েনউদ্দিন, মনজুর মোর্শেদ, কামরুল হাসান, আব্দুল গণি হাজারী, শামসুর রাহমান, মোস্তফা নূরউল ইসলাম প্রমুখ।
১৯৬১ সালে কমিউনিস্ট কর্মীদের উদ্যোগে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘ছায়ানট’। তবে ছায়ানট ক্রমে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যক্ষ ভূমিকা থেকে সরে এসে রবীন্দ্রচর্চাভিত্তিক এক উদারনৈতিক মধ্যবিত্ত চেতনার চর্চার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রগতিশীল ধারায় ১৯৬৩ সালে ‘সৃজনী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠী’ গড়ে ওঠে। সৃজনী যে অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা এর সঙ্গে যুক্ত কমিউনিস্ট কর্মী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিগণ রক্ষা করতে সক্ষম হননি। কমিউনিস্ট পার্টি দুই ধারায় বিভক্ত হওয়ার পর সৃজনী ‘মস্কোপন্থী’ ধারার সাথে যুক্ত থাকে। এখন এই সংগঠনটি শুধুমাত্র গতানুগতিক সাহিত্যসভার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।
এরপর ‘পিকিংপন্থী’ ধারার উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে গড়ে ওঠে ‘ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী’। সভাপতি হন ব্যারিস্টার পারভেজ আর সাধারণ সম্পাদক হন কামাল লোহানী। খান আতাউর রহমান, আব্দুল লতিফ, মহসিন শস্ত্রপাণি, ইন্দুসাহা, অজিত রায় প্রমুখ এই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। গোপন পার্টির পক্ষ থেকে এই সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন কমরেড আব্দুল হক। ‘ক্রান্তি’র আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল : ‘দেশ বলতে বোঝায় মানুষ, সংগ্রামী মানুষ। ওরাই সভ্যতার নিয়ন্তা, ইতিহাসের স্রষ্টা...। আমাদের দেশের শিল্পে, সংগীতে কবিতায়, নাটকে আমরা রূপায়িত করার প্রয়াস পাব এই জনমানস বিশ্ববিক্ষণকে।’ কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতায় শেষ পর্যন্ত ‘ক্রান্তি’র তৎপরতা সীমিত হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৬৮ সালে নতুন উদ্যম ও উৎসাহে গড়ে ওঠে ‘উন্মেষ’। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন জহিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক কবি ইন্দু সাহা। সংগঠনের কর্মীদের প্রায় সকলেই কমিউনিস্ট পার্টি বা বিপ্লবী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ থেকে ’৭৪ পর্যন্ত ‘উন্মেষ’র কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ১৯৭৪ সালে সংগঠনটি পুনর্গঠিত হয়। এসময় মহসিন শস্ত্রপাণি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সম্পাদক হন কবি সমুদ্র গুপ্ত। সংগঠনটিতে যুক্ত ছিলেন- মুনীর সিরাজ, মতিন বৈরাগী, কাজী মনজুর, ছড়াকার আবু সালেহ্ প্রমুখ। উন্মেষ পুনর্গঠনের সময়ে গৃহীত ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়- ‘লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের অবশ্যই জনগণের সাথে একাত্ম হতে হবে; জীবন ও সমাজবদলের প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই কেবল নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।’ বর্তমানে উন্মেষ’র তেমন কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান হয় না।
১৯৬৮ সালে উন্মেষ প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পর সত্যেন সেন এর উদ্যোগে গঠিত হয় ‘উদীচী’। উদ্যোক্তা ও এর সকল কর্মী কমিউনিস্টদের ‘মস্কোপন্থী’ (সিপিবি) ধারার সাথে যুক্ত ছিলেন। মতাদর্শগত দুর্বলতার কারণে সংগঠনটি বর্তমানে বুর্জোয়া উদারনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি অনুগত থেকে অন্যতম একটি বুর্জোয়া দলের সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭১ সালের শুরুতে আহমদ ছফা’র উদ্যোগে জন্ম হয় ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ এর। ১৯৭৬ সালে এরপর সংগঠনটি ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ নামে পুনর্গঠিত হয়। সভাপতি ছিলেন ড. আহমদ শরীফ ও সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার কবির। বদরুদ্দীন উমর, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আনু মুহাম্মদ প্রমুখ এর সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তিতে সংগঠনটি একটি গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকাশ্য ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করে। দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এরপর অনেকেই ‘লেখক শিবির’ থেকে সরে আসেন।
প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ২৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৭৮ সালের ১৬ জানুয়ারি গঠন করা হয় ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট’। সংগঠনের বাইরে থাকা কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, লেখক ও শিল্পীও এই ফ্রন্টে যোগ দেন। পরবর্তিতে আরো কয়েকটি সংগঠন যোগ দিলে ফ্রন্টের শরিক সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭টিতে। সংগঠনগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ লেখক শিবির, উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ, দুর্জয় সংস্কৃতি সংসদ, সমষ্টি, নাট্য ফৌজ, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ছড়া সংসদ, উচ্চারণ সাহিত্য চক্র, সুকান্ত একাডেমী, গণ-সংস্কৃতি পরিষদ, দেশকাল, ভাষা সমিতি, ঢাকা শিশু নাট্যম, অস্বীকার, বহুবচন নাট্য গোষ্ঠী, শিরোনাম গোষ্ঠী, উদয়ন সংঘ, চলচ্চিত্র কর্মী শিবির, আরণ্যক, ঋষিজ শিল্প গোষ্ঠী, সাহিত্য ক্লাব, চলচিত্রকার সংসদ, কিংশুক সাহিত্য গোষ্ঠী, ধ্রুবতারা সংস্কৃতি সংসদ, পল্লব সাহিত্য চক্র, নয়া সমাজ ও অগ্নিবীণা সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ। ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট’ এর উদ্যোক্তারা ছিলেন মূলত কমিউনিস্টদের ‘পিকিংপন্থী’ ধারার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। এই ফ্রন্টের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালের ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় সম্মেলনের সফল আয়োজন করা হয়।
এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই সম্মেলনে সারাদেশ থেকে অনেক প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী যোগ দেন। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের শেষাংশে ‘বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদী প্রভাব থেকে মুক্ত করে একটি নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমুহের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান’ জানানো হয়। তবে এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট সম্মেলনের পর আর কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম চালাতে পারেনি।
আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক শক্তির সহযোগী হিসেবে গড়ে ওঠে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’। প্রথমদিকে কিছু প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি এই জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পরবর্তিতে ক্রমশ আওয়ামী পন্থীরা এর নেতৃত্ব দখল করে ফেললে জোটের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এই জোট একটি বুর্জোয়া দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য হয়ে গতানুগতিক কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। জোটভূক্ত কয়েকটি সংগঠন ও জোটের বাইরের আরো কিছু প্রগতিশীল সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯৯ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বশেষ গড়ে ওঠে ‘গণ-সংস্কৃতি ফ্রন্ট’। সৃজন, ধ্রুবতারা, সমাজচেতনা, বিবর্তন সাস্কৃতিক কেন্দ্র, গণ-সংস্কৃতি পরিষদ, প্রগতি সংস্কৃতি সংসদ, উন্মেষ সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ, বাঙলাদেশ লেখক শিবিরসহ মোট ২৪টি সংগঠন এ ফ্রন্টে যোগ দেয়। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ফ্রন্ট অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হলেও কাঙ্খিত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। নানা আদর্শগত বিরোধ ও দুর্বলতার কারণে বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলোও এ ফ্রন্টকে আশানুরূপ সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়। নানা জাতীয় ইস্যু বিশেষ করে ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পাদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র প্রায় সকল আন্দোলনে ‘গণ-সংস্কৃতি ফ্রন্ট’ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। কিন্তু ক্রমশ ফ্রন্ট তার কার্যক্রমে যেভাবে গতি হারিয়ে ফেলছে তাতে এর ভবিষ্যৎ খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন-সংগ্রামে মূল ভূমিকা পালন করে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি বা সংগঠন। সাংস্কৃতিক সংগঠন তার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারে। সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক শক্তির অনৈক্য ও দুর্বলতার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকেও প্রভাবিত করে। আমরা দেখেছি বিভাগপূর্ব ভারতে যে সচেতন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে কমিউনিস্টরা।
পরবর্তিতে পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পিছনে তাদের ভূমিকাটাই ছিল মূখ্য। বিপ্লবী রাজনীতির সামাজিক দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম ও প্রগতিচিন্তা উদ্বুদ্ধ করেছিল সংস্কৃতি কর্মীদের। কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতির লক্ষ্যহীনতা, ব্যর্থতা, বিভক্তি, নেতৃত্ব শূন্যতা ও আপসকামীতা এদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে দুর্বল করে ফেলে। তবে বিপরীতভাবে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তির বিকাশের জন্য এক লাগাতার সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিকল্পও আজ আমাদের সামনে নেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ