
তানিয়া সুলতানা
মানুষের মনের ভেতরের অবস্থা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। দেখা যায় না বলেই অনেকের কাছে মন থেকে যায় অবহেলিত। অথচ সত্যিকারের ভাল থাকা মানে শরীর ও মন দুটিরই ভাল থাকা।
সব মানুষের মন নিয়েই এমন সংকট রয়েছে। কিন্তু কোনো নারীর মন নিয়ে ভাবতে গেলে তা আরও গভীরভাবে দেখা যায়। এই গভীরতার কারণেই শিল্প-সাহিত্যে নানাভাবে চিত্রিত হয় নারীর মন। কারও কাছে নারী দেবীসম, কারও কাছে লোভী বা স্বার্থপর। কেউ মনে করে নারী অতি আবেগী ও বাস্তবতা বিরোধী। এখানে নারীর মনের নানা সংকটকে একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করা যাক।
একটা মেয়ে যখন শিশু অবস্থায় পরিবারে বেড়ে ওঠে, তখনই তার মধ্যে বিষণ্নতার বীজ বোনা শুরু হয়। দেখা যায়, সে কী পোশাক পরবে, কী খেলনা নিয়ে খেলবে, কোথায়-কার সাথে বেড়াতে যাবে সব বিষয়ে তাকে নানা বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পরিবার থেকে এগুলো করা হয় সাধারণত দুটি কারণে। একটি হলো- ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশুর ‘নিরাপত্তা’ নিয়ে বাড়তি শঙ্কা। অন্যটি হলো- শিশুটিকে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজের চোখে আদর্শ নারী বানিয়ে তোলার প্রক্রিয়া।
এই দুটি কারণে দেখা যায় মেয়ে শিশুর ইচ্ছে, পছন্দ বা শখ পূরণের সুযোগ থাকে না। একটি মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই তাই করতে হয় যা তার জন্য নিরাপদ ও মানানসই। ফলে ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়ে তার মনের ভেতরের স্বঃতস্ফুর্র্ত ইচ্ছাগুলোর প্রকাশ করতে পারে না। বরং সে পরিবার ও সমাজের নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এইসব পরিবারের মেয়েরা দেখা যায় অনেকটা নীরবে, বাইরের জগতের কিছুই বুঝে ওঠার আগে বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে ‘পূর্ণ নারী’ হয়ে ওঠে।
তবে সামাজিক উন্নয়নের ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শিশুর প্রতি অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। তাছাড়া এখন মধ্যবিত্ত ও অগ্রসর পরিবারগুলোতে দেখা যাচ্ছে একটি-দুটির বেশি সন্তান থাকে না। ফলে শিশু বয়সে এইসব সামাজিক বিষয়কে আর গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মেয়ে শিশুও ৮-১০ বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত ছেলেদের মতো যা-খুশি-তা পেয়ে বড় হচ্ছে। এই সব পরিবারকে তাত্ত্বিকভাবে ‘অগ্রসর’ পরিবার বলা যায়।
কিন্তু এসব পরিবারের মেয়েদের জীবনেও বড় বিপত্তি শুরু হয় মেয়েটা বয়সন্ধিতে আসার পর। শিশুকাল থেকে যে মেয়েটিকে স্লিভলেস বা ওয়েস্টার্ন পোশাক পরানো হয়েছে বড্ড আদর করে, তাকেই ৯-১০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ পরিবার থেকে জোর করা হয় ফুলস্লিভ ফ্রক-কামিজ পরার জন্য। হঠাৎ বলা শুরু হয় তুমি এখন বড় হয়েছো, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, আর এটা-ওটা করা যাবে না।
কোনো কোনো মা-বাবা মেয়েকে খানিকটা স্বাধীনতা দিতে চাইলে আশপাশের প্রতিবেশী কিংবা পরিবারের বয়স্করা বলতে শুরু করে নানা কথা। সেইসাথে স্কুলে বা মহল্লায় বখাটে ছেলেদের নানা রকম উত্যক্ততার মুখেও মেয়েটির ওপর নানা বিধিনিষেধ নেমে আসে। কিন্তু ওই ছেলেকে মেয়েদের উত্যক্ত না করার শিক্ষা পরিবার বা সমাজ খুব একটা দিতে চায় না।
অর্থাৎ পরিবারের পাশাপাশি সমাজও নারীকে বিভিন্নভাবে বিষণ্ন করে তোলে। যেমন, একটু দেরিতে বিয়ে হওয়া, শারীরিক গঠন ও গায়ের রং নিয়ে তাচ্ছিল্য করা। এগুলোর কারণেও নারীর মনে এক ধরণের হীনমন্যতা তৈরি হতে পারে। আত্মবিশ্বাস কমে যায়।
যেসব মেয়ে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে, তারা অনেকে বড় বড় ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পেলেও নিজের ইচ্ছাগুলো পুরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। এরপর ধাপে ধাপে তার জীবনটা আরও জটিল হয়ে পড়ে বিয়ের পর। বিয়ে হলে মেয়েটিকে বলা হয়, নারীত্বের ‘মহান’ দায়িত্ব পালনের জন্য। তখন সেই দায়িত্বের প্রয়োজনেই তাকে ভূমিকা পালন করতে হয় স্ত্রীর, মায়ের। এসবের মাঝেই মৃত্যু হয় তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা উচ্ছল-চঞ্চল প্রাণখানি।
উপরে আমরা মেয়েদের বেড়ে ওঠার দুটি অবস্থা বলেছি। আরো এক ধরণের ব্যাপার আছে মেয়েদের ক্ষেত্রে। অনেক পরিবারে দেখা যায়, বিয়ের আগঅবধি মেয়েরা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ কর। বিয়ের পর নানা সামাজিক দায়িত্বের বোঝা মেয়ের কাঁধে চড়বে, সেটা বুঝতে পেরেও স্নেহ ও মমতার তীব্রতায় ওই মেয়ের পিতা-মাতা তাদের কিছুই বলেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন মা তার ছেলের বৌকে যত কঠোরতার মধ্যে চলতে বাধ্য করেন, কন্যার বিষয়ে ততটাই উদার থাকেন। স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা এই মেয়েটাও দেখা যায় বিয়ের পর অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। বিয়ের পর ওইসব মেয়ে যেমন শ্বশুরবাড়ির মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খায়, তেমনি তাদের পিতামাতাও সন্তানের কষ্ট দেখে বা শুনে দুঃখ পান। তিলে তিলে আদর -ভালবাসায় লালন করা সন্তান অন্যের ঘরে ভাল নেই, এমনটা ভেবে তারাও হতাশ হন।
সবক্ষেত্রেই বিয়ের দিন থেকে মেয়ের শুরু হয় এক দ্বন্দ্বমুখর টানাপড়েনের জীবন। যেখানে মা-বাবা পরিবারকে ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টায় অংশগ্রহণ করতে হয় তাকে। সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা পরিবার এবং সেই মানুষদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া যে কত কষ্টের, তা বিয়ের পরেই একটা মেয়ে বুঝতে পারে।
বিয়ের পর একটা পুরুষের জীবনে যেটুকু পরিবর্তন আসে, তার চেয়ে অনেক বেশি বদলে যায় নারীর জীবন। এ অবস্থায়ও নারীর দুঃখ কিংবা অনুভুতিগুলো উপেক্ষিত হয় বরাবর। বিয়ের কয়েক বছর পর কখনো ভালবাসার অভাব, কখনো আবার ব্যস্ততা বা দিনযাপনের অভ্যাসের কারণে স্ত্রীর প্রতি অনেক স্বামীরই মনোযোগ কমে আসে। স্বামীর অবহেলা, ভুল বোঝাবুঝি বা পারিবারিক অশান্তিতে অধিকাংশ বিবাহিতা নারীকেই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে দগ্ধ হতে হয়।
স্ত্রীকে সংসার জীবনে দুঃখ-কষ্ট আর অভাব অনটনে নিজেকে বদলাতে হয় বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে। আবার বিবাহিত জীবনে সুখী হলেও নিজের মনের গহীনে তরুণী বয়সের উচ্ছল জীবনের জন্য একটা হাহাকার পুষে রাখেন সব নারীই। দায়িত্বহীন আনন্দময় জীবন, নিজের মতো করে সব চাওয়া-পাবার স্বাধীনতা, মন খারাপের কোনো কারণ না থাকা, কোনোরকম হীনমন্যতায় না ভোগা, সদা হাস্যময়ী, প্রাণচঞ্চল, মিষ্টি স্বভাবের সেই তরুণী চাইলেই আর হওয়া সম্ভব না। এখন তাকে পরিবারে সবকিছু মানিয়ে চলার পরীক্ষায় ব্যস্ত থাকতে হয়। যেখানে অধিকারের চেয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বড়। একা থাকার মতো সাহস আর সামর্থ্য কোনটাই তখন আর থাকে না। নিজের সুখের কথা মনে আনতেও তার বড্ড ভয় হয়। শুধুই তাকে একটা সান্ত্বনামূলক বাক্য শোনানো হয়- ‘মেনে নাও, মানিয়ে নাও।’
কিন্তু সংসার টিকিয়ে রাখতে সব কিছু মেনে নেওয়াটাই কি দাম্পত্য জীবনের মূলমন্ত্র? সীমাহীন মনঃকষ্ট নিয়ে বাস করলেও প্রতিনিয়ত নিসঙ্গতা সঙ্গী করেই স্বামীর সংসারে মুখে হাসি ধরে রেখে সব মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে হয় তাদের। এভাবে মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়েই পার হয়ে যায় সংসার জীবন। নারীর বেদনা যতই তীব্র হোক, তাকে সংসারের সব কাজ ঠিক মতো করতে হয়।
পরিবারে নারীর মনের দুঃখ-কষ্ট, বিষণ্নতাকে খুব স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। অথচ মন এমন এক গভীর ক্ষেত্র যেখানে চিন্তা, অনুভূতি, অবেগ, ইচ্ছা ও কল্পনার প্রকাশ পায়। এই বিষণ্নতার ফলে এমনকি আচার আচরণেও পরিবর্তন হয়। মনের কষ্ট সহজে অন্যের মনযোগ পায় না বলে মানসিক সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে শারীরিক সমস্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়, যেমনটা ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের হৈমন্তীর জীবনে।
এতটা সময় সমস্যার নানা ধাপ ও দিক ব্যাখ্যা করা হলো। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো সমাজের অর্ধেক সংখ্যক মানুষের এই মনস্তাত্বিক সংকটের মুক্তি কোথায়? এক বাক্যে এই প্রশ্নের জবাব নেই। রাতারাতি এর সমাধানও নেই।
শতবর্ষ আগে বেগম রোকেয়া তার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি পুরুষকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ‘নারীকেন্দ্রিক’ বিপরীত এক ব্যবস্থার। সেটাতো স্বপ্নই। বাস্তবে নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের বিশ্ব যেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি, তেমনি নারীর জগতও পুরুষকে বাদ দিয়ে অসম্ভব।
এজন্যই নারীর বিষণ্ন মনের নানা সংকটের উত্তরণে পাশে থাকতে হবে পুরুষকেও। সবাই জানে কষ্টের কথা প্রকাশ করলে মন হাল্কা হয়, কষ্ট কমে। সমাজের সব নারী আর সব পুরুষ যদি দুটি আলাদা সত্ত্বা হয়, তাহলে তাদের শুনতে হবে একে অপরের কথা। উভয়ে মিলে একসঙ্গেই চেষ্টা করে যেতে হবে নিয়মের নামে নানা অনিয়ম বদলে দেওয়ার।
লেখক : উদ্যোক্তা