-623054b5854d7.jpg)
হামীম কামরুল হক
আমরা অনেক কিছুই শুরু করি, শেষ করি না। ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলাম, এর পূর্ণতা আমরা দিতে পেরেছি কি? মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, আজ অব্দি তা শেষ হলো না। যাত্রা শুরু হয়েছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের, এখনও পর্যন্ত সংসদ অকার্যকর। যে দল ক্ষমতায় থাকে না তারা সংসদে যায় না। ফলে আমাদের অনেক কিছুর শুভ সূচনা হয়, কিন্তু শুভ সমাপ্তি হয় না। ব্যক্তিজীবনেও আমাদের বেশিরভাগ লোকের অবস্থা কমবেশি একই -শুরু করি অনেক কিছু, শেষ করি না একটিও। ফলে জাতির চরিত্র আর ভিন্ন হবে কি?
শরৎচন্দ্রকে এক ব্যক্তি কোনো এক তরুণ লেখকের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিল, ‘ছেলেটি বেশ লিখছে।’ শরৎবাবু বলেছিলেন, ‘লিখছে তো ভালো, শেষ করতে জানে তো?’ এই কথাটার গূঢ় অর্থ কি এই যে, শুরুটা ঠিক হলেই তবে শেষটা শুভ হবে। তার মানে এই না- বাঙালির ওই সব ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডের শুরুটা কোনো ক্ষেত্রেই ঠিক ছিল না। তাহলে শেষ করতে এত সময় লাগছে কেন? বা শেষ না করে আমরা কোনো কিছু ফেলে রাখি কেন? এর রহস্য সহজে বোধ হয় ভেদ করার নয়।
এজন্যে বোধহয় বাঙালি চরিত্রের দিকে একবার তাকানো দরকার। বাঙালির মৌলচরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কথা তো এখনো অক্ষয় হয়ে আছে। চরিত্রপূজা বইয়ে ‘বিদ্যসাগর-চরিতে’ তিনি বলেছিলেন বাঙালি নিয়ে এই অমর অজর কথাগুলি, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান; পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স; এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’
তাঁর এইসব কথায় আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে খেয়াল করার দরকার। শেষ না করা, কাজ না করা, বিশ্বাস না করা বাঙালি মূলত আত্মত্যাগের চেতনাহীন, যোগ্যতালাভের ইচ্ছাহীন। এ তো গেল নিজের দিকে তার অবস্থা। আর পরের বা অন্যের বিচার বিবেচনার ক্ষেত্রে বাঙালির চর্চার ভেতরে পরচর্চা, পরের অনুকরণ, পরের অনুগ্রহই প্রধান। আর রাজনীতিকে তিনি ধোকাবাজি, ফাঁকিবাজি ও বাকওয়াজির সম্মেলন বলে শনাক্ত করেছেন।
লক্ষণীয় বাঙালি চরিত্রের প্রধান দিক মূলত ‘শুরু করে শেষ না করা’; আরম্ভ ও শেষের মিলন না হওয়া; মাঝপথে এসে কাজ ছেড়ে দেওয়া। এর থেকেই আদতে বাদবাকি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্ম। বাঙালির জীবনচর্চায় আর কোনো ধারাবাহিকতা থাকুক না থাকুক এই ‘শুরু করে শেষ না করা’র ব্যাপারে আমরা বাঙালিরা পূর্বাপর সংগতি সম্পন্ন। রুশ মনোবিজ্ঞানী ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ দেশমাতৃকার কল্যাণে যারা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজেদের উৎসর্গ করতে চায় সেইসব তরুণের উদ্দেশ্যে একটি চিঠিতে তিনটি বিষয়ের কথা বলেছিলেন। প্রথমটি হলো ‘পূর্বাপর সংগতি’ বা ‘কনসিসটেন্সি’, দ্বিতীয়টি হলো ‘বিনয়’ বা ‘মডেস্টি’ এবং তৃতীয়টি হলো ‘কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা’ বা ‘প্যাশন’। পূর্বাপর সংগতির জন্য তাঁর কথা ছিল- কোনো কাজের মূলে পৌঁছাতে হবে এবং কাজটি কী করে আয়ত্ত করতে হবে তার সূত্র সন্ধান করা। বিনয়ের মূল সূত্র হলো ‘আমি জানি না, আমি রীতিমতো অজ্ঞ’- এই কথাটি বলবার সাহস থাকা এবং কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা বা প্যাশনের মূল কথা : কোনো কাজের জন্য কেউ তার সারাজীবন দিয়ে দিতে পারবে কিনা- তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সাইন্স রিকওয়াইয়ারস ইয়োর হোল লাইফ।’ বিজ্ঞানসাধনায় এসম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার দরকার আছে। তিনি লেখেন, ‘সাইন্স ডিম্যান্ডস অব ম্যান দ্য অ্যাটমোস্ট এফোর্ট অ্যান্ড সুপ্রিম প্যাশন।’
এই যে নিবিড় কর্মোদ্যোগ এবং কাজের প্রতি তুঙ্গস্পর্শী প্রেম বা অনুরাগ- এই দুইটি বিষয় যেন বাঙালি চরিত্রের সঙ্গে যায় না। কর্মোদ্যোগ তো অনেকই নেওয়া হয়, কিন্তু তাতে ওই ভালোবাসা তো বেশি দিন কেউ ধরে রাখতে পারে না। ফলে আমাদের সবকিছুই ওই ‘শুরু হয়, শেষ হয় না’।
বাঙালি সবচেয়ে বেশি যে কাজটি পারে তা হলো বাঙালির নিন্দা। এর প্রথমটা হলো সময়জ্ঞানের অভাব, পরেই আছে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। যে ব্যক্তি কোথাও সময়মতো হাজির হয় না, সেই অন্যের সময়জ্ঞান নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সময়জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞানই হলো সমস্ত কাজের গোঁড়ার কথা- কোন সময়ে কী করতে হবে, কতদূর সেটি করতে হবে, সবচেয়ে বড় কথা কাজটি সময় মতো শেষ করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে ফের বলা যায়, বাঙালি নিয়ে তিনি আশা ছাড়েননি। দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে আলাপকালে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে আছে ফলপ্রসূ কল্পনার বীজ, তাই বাঙালির রয়েছে অনন্ত সম্ভবনা। এই জেনারেশনের কাছ থেকে হয়তো খুব বেশি কিছু পাওয়া যাবে না, কিন্তু পরবর্তীকালকে দাবিয়ে রাখবে কে?’ দাবিয়ে যে কেউ রাখতে পারবে না, কথাটি সাতই মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখবার পারবা না।’ সেই তাকেই বলতে হয়েছে, দেশ স্বাধীন করার পর, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’
অনেকেই বলেন, মাত্র নয় মাসে স্বাধীন হওয়া এবং সদ্যস্বাধীন হওয়া দেশে অত দ্রুত কোনো কিছুই করা সম্ভব ছিল না। দেশে দেখা দিয়েছিল চরম অরাজকতা এবং এর ফলে একটির পর একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এরই জের ধরে বাংলাদেশের দু’জন রাষ্ট্রপতিকে নিহত হতে হয়। কারোরই আরম্ভ করার কোনো কাজই শেষ হয়নি। ফলে বাংলাদেশে কোনো কিছুতেই সম্পন্নতা আসেনি- বিশেষ করে রাজনীতিতে।
আমরা ভাষা আন্দোলনের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। ভাষা আন্দোলন প্রথমে ছিল ভাষা রক্ষার আন্দোলন, কিন্তু আজ অব্দি বাংলাভাষার কোনো কিছুকে আমরা সুনির্দিষ্ট একটি কাঠামোর ভেতরে নিয়ে আসতে পারিনি। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড করা হয়েছিল, তাদের কার্যক্রমও ছিল বেশ ইতিবাচক, পরে সেটিকে বাংলা একাডেমির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা বোধ করি তুলনারহিত। এটাও আমাদের কাজ শুরু করে শেষ না করার একটা দৃষ্টান্ত। জাতির উন্নয়নের জন্য সবার আগে দরকার ছিল ভাষার উন্নয়ন। ভাষার উন্নয়ন ঘটার ভেতর দিয়েই ঘটে জাতি ও তার কর্মোদ্যোগের উত্থান। ইউরোপ যখন ল্যাটিন ভাষার আধিপত্য থেকে বের হয়ে মাতৃভাষায় যার যার দেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা শুরু করে তখন থেকেই ইউরোপীয় সভ্যতার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এশিয়ার ভেতরে জাপানকে আমরা মাতৃভাষায় সেই কাজটি করার কারণে সবকিছুর শীর্ষে বিরাজ করতে দেখছি। কিন্তু যতোগুলো অনুন্নত দেশ আছে, তার প্রধান কারণ যে মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে থাকা। কেবল পিছিয়ে থাকাই নয়, ভাষা যে কষ্ট করে আয়ত্ত করতে হয়, এর যে একটা রীতিপদ্ধতি আছে, সেটিও আমরা মেনে নিতে আগ্রহী নই।
ভাষা নষ্ট হলে যে জাতি নষ্ট হয়ে যায়, সংস্কৃতি শেষ হয়ে যায়, তার ছাপ এখন সর্বত্র। বাংলা ভাষার ওপর যে সীমাহীন নিপীড়ন চলছে, তা সর্বোচ্চভাবে ঘটছে আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতে। সংবাদপত্র, রেডিও ও টিভির ভাষা একে তো ভুলে ভরা, তারওপর আছে বিকৃত উচ্চারণ এবং ইংরেজি-হিন্দি দিয়ে খিঁচুড়ি পাকানো। ‘সময় থাকতে শুদ্ধ হোন, জেগে আছে জনগণ’ বলার চেয়ে অর্ধেক ইংরেজি অর্ধেক বাংলায় কথাটা বলা হচ্ছে, আর এই দিয়ে বলা হচ্ছে বিজ্ঞাপিত পণ্যের শুদ্ধতার কথা। হায়, অশুদ্ধভাবে শুদ্ধতার বড়াই করে চলছে এভাবে প্রায় সবাই। ‘বন্ধু ছাড়া জীবন? অসম্ভব!’ -এই কথাটিকে কেন কী কারণে আধামাধা ইংরেজিতে বলতে হবে? ভাষা নষ্ট হওয়ার সহজ ও নিত্য দৃষ্টান্ত যারা বাংলাভাষা স্কুল কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ান। তাদের বেশির ভাগই এই ভাষাটি শুদ্ধভাবে লিখতে পড়তে এবং বলতে পারেন না। আর কেউ তাদের ভুল ধরিয়ে দিলে, তারা ভুলটাকে সঠিক করার বদলে রবীন্দ্রনাথের থেকে দৃষ্টান্ত দেন, যে রবীন্দ্রনাথই তো এভাবে লিখেছিলেন, আমার করতে দোষ কী, আর আপনিইবা বলবার কে?
একটা হারমোনিয়াম যেভাবে ইচ্ছা বাজিয়ে প্যাঁ-পোঁ করে, যেভাবে ইচ্ছা চেঁচিয়ে, চিৎকার করে কেউ যদি বলতে চায় ‘আজ থেকে এটাই গান’- লোকজন তাকে উন্মাদ বলেই মনে করবে। নাচতে হলে নাচ শিখতে হয়, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নেচে যদি কেউ বলে ‘আজকে থেকে এটাই নাচ’- তা বলা মাত্র সবাই মেনে নেবে না। কিন্তু বাংলাভাষা আপনি যেভাবে ইচ্ছা লেখেন, ‘বক্তৃতা রাখেন’ (সঠিক হলো: ‘বক্তৃতা দেন’), ‘যেয়ে’ (হবে ‘গিয়ে’), ‘পরবর্তীতে’ (‘পরবর্তীকালে’ বা ‘পরে’) এবং ‘এইসব মেয়েরা’ ‘অনেক বাচ্চাদের ওপর গবেষণায় প্রমাণিত’’ (এখানে ‘অনেক বাচ্চাদের’টা খেয়াল করুন) ‘এইসব বুদ্ধিজীবীদের’- এমন নিত্য ভুল বাংলায় আমরা কথা বলছি, সংবাদ লিখছি, পড়ছি এবং বিজ্ঞাপন করছি।
এইসব নৈরাজ্য হলো ওই ‘শুরু করে শেষ না করা’র ফল। ভাষা রক্ষার আন্দোলনই এখনো শেষ হয়নি। তবে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা বাঁচানোর আন্দোলনের চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে। কিন্তু তাও মনে হয় শুরু করতে হবে; আর ‘মুক্তিযুদ্ধে’র শুরু হয়ে শেষ না হওয়ার কথা এখানে নাইবা বললাম।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার।