
রাজেকুজ্জামান রতন
যে কৃষক ফসল ফলিয়ে নিজে বাঁচে আর বাঁচিয়ে রাখে আমাদের, সেই কৃষক যখন ফসল বাঁচাতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন কি বেদনা গ্রাস করে না আমাদের? পানির অপর নাম জীবন, সেই পানির জন্য আত্মহত্যা করতে দেখলাম আমরা।
সবাই বলে মানুষের জীবন তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়; কিন্তু সেই জীবন কখন আর কীভাবে সে আত্মহনন করতে পারে? যখন সামনে আর কোন পথ খোলা থাকে না, অপমান আর ক্ষোভে বিচার বিবেচনা হারিয়ে ফেলে তখন সে নিজেই নিজের জীবনের সমাপ্তি টেনে দেয়।
স্বাধীনতার মাস, মার্চ। ১৯৭১ সালে এই মাসের ২ তারিখে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়েছিল ছাত্ররা, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয়েছিল, ৭ মার্চ লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছিল, আমরা তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব। আর ৫০ বছর পর ভাত খাবার জন্য ধান চাষের জমিতে পানি দিতে না পেরে সেই মার্চ মাসে আত্মহত্যা করলেন দুই আদিবাসী ভাই। রাজশাহীর বাগমারায় রবি মারান্ডি ও অভিনাথ মারান্ডি আত্মহত্যা করেছেন। দু’জনেই কৃষক, আদিবাসী এবং সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর।
এখন বোরো ধান পুষ্ট হওয়ার সময়, পানি না পেলে ধান চিটা হয়ে যাবে। তিন মাসের পরিশ্রম, টাকা পয়সা খরচ সব শেষ হয়ে যাবে পানি না দিতে পারলে। কিন্তু দিনের পর দিন এই দুই ভাই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে গভীর নলকূপ থেকে সেচের পানির জন্য ধরনা দিলেও পাচ্ছিলেন না। তারা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, পানি না দিলে এমনিতেই তো না খেয়ে মরে যেতে হবে। তার চেয়ে তারা আত্মহত্যা করবেন। বহু বঞ্চনা আর প্রতারণার পরও আদিবাসীরা তাদের সম্ভ্রমবোধটুকু এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। তারা যা বলেন, তা করার চেষ্টা করেন; কিন্তু বিএমডিএর কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভাবতে পারেননি এই দু’জন সত্যিই আত্মহত্যা করবেন। দুই ভাই একসাথে গভীর নলকূপের সামনে কীটনাশক পান করেন ২৩ মার্চ সন্ধ্যায়। রাতেই অভিনাথের মৃত্যু হয়। আর রবি মারা যান রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে ২৫ মার্চ রাতে। এরা দু’জন সম্পর্কে চাচাতো ভাই। তাদের পরিবারের দাবি, ১০/১২ দিন অপেক্ষার পরও ধানের জমিতে পানি নিতে না পারার ক্ষোভ থেকে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
তবে অতীতের অনেক ঘটনার মতো এক্ষেত্রেও জমিতে পানি না পেয়ে তাদের বিষপানের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা দুই কৃষকের বিষপানের কথা শুনেছেন। পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো অনিয়ম থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াা দায়িত্বহীন উদাসীনতার সেই পুরাতন কথা! কে নেবে ব্যবস্থা আর কে করবে বিচার?
বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে যে কৃষি, তার উন্নতি নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের বিবরণ প্রতিনিয়তই শুনছে দেশের মানুষ; কিন্তু অন্যান্য দেশের সাথে তুলনামূলক বিচারে তা কতটুকু? নেদারল্যান্ডস কৃষি খাতে বছরে মাথাপিছু ৩১৪ ডলার, ভারত ৩৪ ডলার ও মিয়ানমার ২৬ ডলার বিনিয়োগ করে। সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১৬ ডলার বিনিয়োগ করা হয়। যে কারণে বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি ধানের উৎপাদন ৪ হাজার ৭৩৫ কেজি। আর চীনে তা ৭ হাজার কেজির বেশি। অন্যদিকে দেশে কৃষিজমি কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সমস্যা বাড়ছে। তাই খাদ্যনিরাপত্তাকে টেকসই করতে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একরপ্রতি ধানসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের উৎপাদন বাড়াতে হবে। ভাত কম খান বললেই চলবে না, ভাতের উৎপাদনের পাশাপাশি পুষ্টিকর ও বহুমুখী খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে।
উৎপাদন বাড়ানোর উপায় কি? দেশের ৭৮ লাখ হেকটর আবাদি জমির মধ্যে ৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা যায়। এক হেক্টর মানে সাড়ে সাত বিঘা। বিঘায় গড়ে ২০ মণ ধান উৎপাদন ধরলে হেক্টরে ৫ টনের বেশি উৎপাদন হয়। তাহলে বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭৫ লাখ টন ধান উৎপাদন সম্ভব। আমন মৌসুমে দেড় কোটি টন আর আউস মৌসুমে ৫০ লাখ ধান উৎপাদন সহজেই সম্ভব। তাহলে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টন ধান উৎপাদন করতে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ধান থেকে ৬৬ শতাংশ চাল উৎপাদন হিসেবে ৩ কোটি ১০ লাখ টন চাল তো উৎপাদিত হতেই পারে। ছোট শিশু থেকে মৃত্যুপথ যাত্রী ১৭ কোটি মানুষের সবাইকে এই হিসেবে ধরলে বছরে চাল লাগার কথা ২ কোটি ৪৮ লাখ টন। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে খাদ্য ঘাটতি কেন?
উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা বলেন, ডিজেলসহ সব উপকরণের দাম বাড়ায় ১ একর জমিতে বোরো আবাদ করতে গত বছরের চেয়ে অতিরিক্ত ২-৩ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। তেলের দাম বাড়ায় একরপ্রতি সেচ খরচ ৪০০ টাকা, ট্রাক্টর দিয়ে চাষে ৩০০ টাকা ও মাড়াইয়ে ৩০০ টাকার খরচ বেশি পড়েছে। সারসহ অন্য উপকরণের দামও চড়া। তাই প্রতি একরে অতিরিক্ত খরচসহ মোট খরচ পড়ে ৪২ থেকে ৪৩ হাজার টাকা। অথচ প্রতি মণ ধানের দাম ৮০০ টাকা ধরে একরে ৫০ মণ ফলন হলেও ৪০ হাজার টাকার বেশি উঠবে না। তাহলে চাষ করে লাভ কী? পেটের দায়ে এবং উপায় নেই বলে কৃষক যদি চাষাবাদ করে তাকে কি স্থায়ী উন্নয়নের কৃষি অর্থনীতি বলা যাবে?
কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে বলে যে বাহবা নিচ্ছেন সরকার তার সুফল সাধারণ কৃষক কতটুকু পান? অভিনাথ মারান্ডির জমির পরিমাণ দেড় বিঘা। ফলন হলে সর্বোচ্চ ৩০/৩৫ মণ ধান পেতেন। বর্গাদারকে দিয়ে, চাষের খরচ মিটিয়ে অভিনাথ নিজে আর কত পেতেন? ৫/৬ মণ ধান। দাম কত হতে পারে? ৬ হাজার টাকা। একজন ধনী ব্যক্তির একবেলার হোটেলের খাবার খরচের চেয়েও কম। অথচ এর জন্য জীবন দিল অভিনাথ এবং রবি মারান্ডি।
তেভাগার জন্য জীবন দিয়েছিল সাঁওতালসহ আদিবাসীরা। তা ছিল সংগ্রামের আর মর্যাদার মৃত্যু। তখন কণ্ঠে ছিল গান, আর দেব না, আর দেব না রক্তে বোনা ধান। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ধান চাষ করতে পানির জন্য জীবন দিল যে আদিবাসীরা তারা কি দেখিয়ে দিল না ৫০ বছরের বৈষম্যের চিত্র? চোখ বন্ধ করলে কি দেখতে পাই না, পানির জন্য কাতর মিনতি করেও অভিনাথ আর রবি মারান্ডি পানি পাচ্ছেন না ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতার কাছে। এই আত্মহননের দায় কি নেবে না কেউ?
লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাসদ