Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

প্রকৃতির চিহ্ন

Icon

পাভেল পার্থ

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২২, ১৩:০০

প্রকৃতির চিহ্ন

পাভেল পার্থ

ষড়ঋতুর বাংলাদেশ আজ কত ঋতুর দেশ এটি এক দীর্ঘ তর্কের তল। ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচয় মুছতে থাকলেও এখনো এক এক ঋতু সাজে এক এক উৎসব আর মেলার আয়োজনে। অঞ্চল ও জাতিভেদেও ঋতুভিত্তিক আচার-রীতিগুলো ভিন্ন ভিন্ন।

বারো মাসে তের পার্বণের বাংলাদেশে বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের কৃত্য-আচারগুলো সবক্ষেত্রেই উৎসমুখরতা তৈরি করে। পাশাপাশি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে ঘিরে দেশের নানাপ্রান্তে আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, গাজন, চড়ক কি বৈশাখী মেলা। দেশের আদিবাসী সমাজেও বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্যসমূহ জনউৎসবে রূপ নেয়। অঞ্চল ও জাতিভেদে বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসবের নামগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সমতলের কোচ ও হাজং আদিবাসীরা বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসবকে ‘বিহু’ বলেন। ভাওয়াল ও মধুপুর গড়ের বর্মণ ও কোচ আদিবাসীরা সন্যাসীপূজা, গাজন, চড়কপূজার মাধ্যমে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ উৎসবকে বলেন বিষু। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের আদিবাসীদের অনেকেই এসময় পালন করেন দণ্ডবর্ত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা বর্ষবিদায় ও বরণের এ উৎসবকে বলেন বিজু। মারমারা বলেন সাংগ্রাই। রাখাইনদের ভাষায় সাংগ্রেং। ত্রিপুরারা বলেন বৈসু বা বৈসুক কোথাও বুইসুক। গুর্খা ও অহমিয়ারা বলেন বিহু। তঞ্চংগ্যারা বলেন বিষু। ম্রোরা এ উৎসবের নাম দিয়েছেন চানক্রান। চাক আদিবাসীরা এ উৎসবকে বলেন সাংগ্রাইং। খিয়াং আদিবাসীদের অনেকেই এ উৎসবকে সাংলান বলে থাকেন। প্রতিটি ঋতু বেশ কিছু নির্দেশনা নিয়ে আসে। প্রকৃতির নির্দেশনা। ফুল-পাতা-ফল কী শস্য, পতঙ্গের বিস্তার, মাটির রঙ, পাখির ডাক, জলের তরঙ্গ সব কিছুতেই থাকে সেই নির্দেশনা। গ্রামীণ নিম্নবর্গ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির এসব নির্দেশনা মান্য করেছে, করে তুলেছে জীবনের আরাধ্য। তৈরি করেছে কৃত্য, বিকশিত হয়েছে উৎসব। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের জনকৃত্যগুলোও প্রকৃতির নির্দেশনাকে পাঠ করেই বিকশিত। ফাল্গুনে ভাট, শাল, মহুয়া, মিষ্টিকুমড়া, বিলিম্বি, ভেন্না, আমরুল, নাগেশ্বর, পলাশ, কাঁঠালিচাপা, দোলনচাঁপা, কনকচাঁপা ফুটে। প্রকৃতি জানান দেয় বসন্ত ঋতু এসেছে।

যদিও আজকাল বর্ষবিদায়ের চাইতেও ‘বর্ষবরণ’ হয়ে উঠেছে এক প্রধান উৎসব। তৈরি হয়েছে নানা করপোরেট উপনিবেশিক ব্যঞ্জনা। একতরফা কিছু চিহ্নের ভেতর দিয়ে ঢেকে ফেলা হচ্ছে হাজার বছরের ঐতিহাসিক চিহ্নময়তা। বর্ষবরণ হয়ে উঠেছে কেবলি হালখাতা, পান্তা-ইলিশ, সাদা-লাল কাপড়ের এক বৈচিত্র্যবিমুখ শহুরে জমায়েত। ঋতুর প্রতি কৃতজ্ঞতা কী নতজানু প্রবৃত্তি হারিয়ে গেছে। প্রকৃতির চিহ্নের প্রতি দায় ও দায়িত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছে এক নতুন প্রজন্ম। চলতি আলাপখানি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ ঘিরে প্রকৃতির সেইসব চিহ্নের প্রতি দরদ নিয়ে আগলে ওঠার আহ্বান জানায় বাংলাদেশকে। 

তিতা শাক

প্রকৃতিতে তিতা জাতীয় শাকের উপস্থিতি জানান দেয় চৈত্র মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, বৈশাখ সমাগত। এটি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সন্ধিস্থলের এক অনন্য চিহ্ন। তিতাশাক ছাড়া বাঙালি কী আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় কৃত্য হয় না। গিমা তিতা, নাইল্যা, গিমা, দণ্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা এ রকমের ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানান জাতের তিতাশাক খায়।

কাঁচা আম

গাছে গাছে গুটি আম বেশ পুষ্ট হয়ে ওঠে এ সময়। দেশের নানা প্রান্তে কাঁচা আম বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্যে প্রথম গ্রহণ করা হয়। বাৎসরিক আম খাওয়ার অনুমতি নেয়া হয় প্রকৃতির কাছে। রবিদাসদের ভেতর হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্রস্থলে কর্মের পূজা করা হয়। রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সাথে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। এ সময় ঢোল, খাজরি, ঝাল বাজানো হয়। রবিদাসদের ভেতর এসময় বাইশাখী পূজাও পালিত হয়।

শাল-মহুয়া

শাল-মহুয়াও প্রকৃতিতে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের চিহ্ন নিয়ে আসে। সাঁওতালি ভাষায় মাস বলতে বঙ্গা, চাঁন্দো শব্দ গুলির চল আছে। ফাগুন (ফাল্গুন) মাস থেকেই শুরু হয় সাঁওতালি বর্ষ। বর্ষ বিদায় ও বরণের উৎসব বাহাও পালিত হয় এ মাসেই। এ সময় গাছে গাছে সারজম, ইচৗক, মুরুপ আর মহুয়া ফুল ফোটে। বাহা পরবের ভেতর দিয়েই সাঁওতাল সমাজ এসব ফুলের মধু পান ও ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করে প্রকৃতির কাছে। বাহার আগে এসব ফুলের ব্যবহার সামাজিকভাবে নিষেধ। 

বিজু ফুল

বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ ঘিরে আয়োজিত বিজুই চাকমাদের সবচে বড় পরিসরের সামাজিক উৎসব । ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যা দিন এ তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর শুরু হয় বাংলা চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ। পাহাড়-টিলা-বন ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে এদিনে শিশু, কিশোর ও বালিকারা সংগ্রহ করেন নানান পদের ফুল। ভাতজরা ফুল বা বেইফুল ছাড়া বিজু জমে না। 

কাইনকো

কাইকনো বা নাগেশ্বর ফুলও দেশের কোনো কোনো অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর ভেতর বর্ষবিদায় ও বরণের প্রকৃতির চিহ্ন। বর্ষবরণের উৎসব সাংগ্রাইং এর প্রথমদিনকে বান্দরবানের চাক আদিবাসীরা বলেন পাইংছোয়েত বা ফুল দিন। চাকরা সাংগ্রাইংয়ের সময় কাইনকো বা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহে মুখরিত হয়ে ওঠে। পাইংছোয়েতর দিন গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হয় পেকো (গিলা), গ্যাং (লাটিম), মাইকানিকছা (কানামাছি) নামের নানান চাক খেলা। সাংগ্রাইংয়ের দ্বিতীয় দিন হলো আক্যাই। এদিনে পাড়ার যুবসম্প্রদায় বাইক (ঢোল), লাংহোয়াক (ঝাঁঝ) ও হ্নে (বাঁশী) বাজিয়ে ক্যাং বা বৌদ্ধমন্দিরে যায় আর্শীবাদ গ্রহণের জন্য। সাংগ্রাইংয়ের শেষ দিনকে চাকরা বলেন আপ্যাইং। 

চড়ক গাছ ও গাজনের দল

চৈত্রসংক্রন্তির এক অনবদ্য চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে গুড়ে বেড়ানো গাজন বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরি সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি দেশের নানাপ্রান্তে নানা আয়োজনে চড়ক পূজার চড়ক গাছ এবং নীল কাঠও এক অনন্য চিহ্ন। 

গ্রামীণ মেলা

চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে গ্রাম জনপদের আদি মেলাগুলোও এক ধরনের জনচিহ্ন। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে ঘিরে মূলত চৈত্রসংক্রান্তিতেই গ্রামজনপদে মেলা আয়োজনের আদি চল। গাজীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানাপ্রান্তে যেখানেই চড়কপূজা আয়োজিত হয় সেখানেই এখনো মেলার আয়োজন ঘটে। বিশেষত চাবাগান এলাকাগুলোতে এসব মেলার আয়োজন স্থানিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। অঞ্চলভেদে এসব মেলায় আগে ভিন্ন ভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ফলফলাদি, বীজ, পঞ্জিকা পাওয়া গেলেও এখন দেশের প্রায় সব এলাকার মেলাই একাকার হয়ে গেছে। এ যেন বহুজাতিক বিশ্বায়িত দুনিয়ার বাণিজ্য বাহাদুরি।

আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকৃতির এসব চিহ্ন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ঋতুর অদলবদল এবং ঐতিহাসিক ব্যাকরণ ধরতে পারছি না। তৈরি হচ্ছে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের এক অপরিচিত নয়া ভাষিক তল এবং নানা অধিপতি চিহ্নের বাহাদুরি। দেশের নিম্নবর্গের হাজার বছরের চিহ্নের ওপর এ এক প্রশ্নহীন উপনিবেশিক আঘাত। প্রকৃতির নির্দেশনা ও চিহ্নের প্রতি নতজানু হওয়া ছাড়া কোনোভাবেই বর্ষবিদায় ও বরণের কোনো মৌলিক বিকাশ সম্ভব নয়। এই প্রবণতা পণ্যমুখী এক করপোরেট বাজারের দিকেই মানুষকে চেপে ধরে আর বেসামাল করে তুলে। নতুন বছরে দেশের সব প্রান্তে টিকে থাকা ও লড়াই করে যাওয়া প্রকৃতির সব চিহ্ন সুরক্ষায় আহ্বান আবারো সবার প্রতি। আসুন নতজানু হই, আগলে বাঁচি সব আড়াল ছিন্ন করে।


পাভেল পার্থ
গবেষক ও লেখক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫