
রাজেকুজ্জামান রতন
শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত হয় ব্যবহার উপযোগী দ্রব্যসামগ্রী; কিন্তু তা ভোগ করার অধিকার শ্রমিকের কতটুকু? অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের উন্নতি ঘটানোর পেছনেই থাকে শ্রমিকের ঘাম; কিন্তু সবচেয়ে কম পুষ্টি, কম শিক্ষা, কম স্বাস্থ্য সুবিধা, কম বিশ্রাম, কম নিরাপত্তা যেন শ্রমিকদের জন্যই বরাদ্দ।
দাবি ছিল স্পষ্ট আর লড়াই ছিল সরাসরি। ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম আর ৮ ঘণ্টা জীবন বিকাশের জন্য বিনোদন। লড়াই করেছিল শ্রমিকরা; কিন্তু দাবিটা ছিল সব মানুষের। বিশ্রাম বা অবসরের দাবিসহ ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবিতে যে মে দিবসের রক্তাক্ত সংগ্রাম তার ১৩৬ বছর পালন করছে শ্রমিক শ্রেণি। কিন্তু ইতিহাস কি শুধু অতীতের কথা বলে? যে ইতিহাস বর্তমানকে প্রভাবিত করে, পরিচালিত করে ভবিষ্যতের দিকে, সে ইতিহাস জীবন্ত। মে দিবসের ইতিহাস এক গতিময় ও সংগ্রামের ইতিহাস। ফরাসি বিপ্লব ভেঙেছিল দীর্ঘ দিনের সামন্তবাদী সমাজের স্থবিরতা। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার স্লোগান তুলে মানুষের চিন্তাকে উন্নত মানবিক স্তরে উন্নিত করেছিল। শিল্প বিপ্লব উৎপাদন বৃদ্ধির নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে, গ্রাম থেকে লাখ লাখ কৃষক শিল্প কারখানায় এসেছে, সৃষ্টি হয়েছে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের। একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহার উৎপাদনের বহুমুখী বিকাশ ঘটিয়েছে। ফলে সমাজের সমৃদ্ধি, ধনীদের বিলাসিতার পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্ম ঘণ্টা ও দারিদ্র্য বেড়েছে। মালিক মুনাফা বাড়াতে শ্রম ঘণ্টা বাড়ানোর জন্য যে চাপ প্রয়োগ করতো তা শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সর্বত্রই তাই কর্ম ঘণ্টা কমানোর দাবি জোরদার হয়ে উঠছিল। ১৮৩২, ১৮৩৯, ১৮৪৮, ১৮৫৭, ১৮৭৫ সালে বড় বড় শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকরা তাদের দাবিতে যেমন রাজপথে নেমে এসেছিল, মালিকরাও তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সেসব আন্দোলনকে দমন করেছে। ১৮৮৬ সালে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবি তাই ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তির আশায় শ্রমিক শ্রেণির লড়াইয়ের অংশ।
প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বস্তুর ওপর শ্রম প্রয়োগ করেই মানুষ তার প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করে। শ্রমশক্তি প্রয়োগ করা থেকেই শ্রমিক নামের উৎপত্তি। শ্রমিক কাজ করে একইসাথে নিজের ও সমাজের জন্য। ফলে মানুষ শুধু নিজের প্রয়োজন মেটায় না, উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে। সমাজের যা কিছু সমৃদ্ধি তা উদ্বৃত্ত সৃষ্টির ফলেই। এই উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করার ফলেই একদল সম্পদশালী হয় আর বাকিরা নিঃস্ব হয়। উইলিয়াম পেটি, অ্যাডাম স্মিথ, রিকারডো দেখিয়েছেন শ্রমের ফলে মূল্য তৈরি হয়, পরবর্তীতে কার্ল মার্কস দেখালেন কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়। ১৮৪৮ সালে মার্কস- এঙ্গেলস কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো আর পরবর্তীতে মার্কস ক্যাপিটাল লিখে দেখালেন এ যাবত কালের লিখিত ইতিহাস একদিকে যেমন শ্রেণি সংগ্রামের, অন্যদিকে মানুষের বিকাশের ইতিহাস; কিন্তু জীবিকার জন্য দিনের ১২/১৪/১৬ ঘণ্টা যদি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়, তাহলে শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে। আর বিপুলসংখ্যক মানুষকে বঞ্চিত রেখে সমাজের সুষম বিকাশ কি সম্ভব হবে? কতক্ষণ কাজ করলে একজন মানুষ তার জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে শ্রমজীবী মানুষের দাবি উচ্চারিত হয়েছিল ৮ ঘণ্টা কাজ, এটাই হবে কর্ম সময়; কিন্তু মজুরি যদি ন্যায্য না হয় তাহলে জীবনযাপনের জন্য শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হতেই হবে। তাই ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের সাথে ন্যায্য মজুরির দাবি যে কত যৌক্তিক তা ১৩৬ বছর পরেও আজ শ্রমিক শ্রেণি অনুভব করছে। শ্রমিক শ্রেণি এটাও দেখছে যে, যত গণতন্ত্রের কথা বলা হোক না কেন, শোষণমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখে ৮ ঘণ্টা কর্ম সময় এবং ন্যায্য মজুরি আদায় করা সম্ভব নয়।
শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত হয় ব্যবহার উপযোগী দ্রব্যসামগ্রী কিন্তু তা ভোগ করার অধিকার শ্রমিকের কতটুকু? অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের উন্নতি ঘটানোর পেছনেই থাকে শ্রমিকের ঘাম; কিন্তু সবচেয়ে কম পুষ্টি, কম শিক্ষা, কম স্বাস্থ্য সুবিধা, কম বিশ্রাম, কম নিরাপত্তা যেন শ্রমিকদের জন্যই বরাদ্দ। অথচ সারাবিশ্বেই খাদ্য উৎপাদনসহ ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে।
উৎপাদনশীলতা কেবল শ্রমিকের শ্রমশক্তির ওপর নির্ভর করে না। মেশিন, ম্যানেজমেন্ট এবং ম্যানপাওয়ার এই তিন এম যুক্ত আছে উৎপাদনশীলতার সাথে। একটি সহজ উদাহরণ থেকেও বিষয়টা বোঝা যাবে। রিকশাচালক অনেক পরিশ্রমী, কিন্তু তার চেয়ে কম পরিশ্রম করেও সিএনজি চালকের উৎপাদনশীলতা বেশি। শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত বা দক্ষ শ্রমিক যাই বলি না কেন তা অর্জন করতে প্রয়োজন শ্রমিকের আয় এবং অবসর। আয় বাড়লে খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণ বাড়বে এবং অবসর সময় পেলেই শ্রমিক তার দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পাবে। কিন্তু শোষণ থাকলে তা তো সম্ভব নয়। ফলে একদল মানুষ যারা উৎপাদন যন্ত্র যেমন কারখানা ও পুঁজির মালিক দিন দিন ফুলে ফেঁপে ওঠে, আর শ্রম শক্তির মালিক শ্রমিক, সে হারায় তার কর্ম শক্তি। শোষণমূলক সমাজ যেমন বঞ্চিত করে শ্রমজীবীকে তেমনি জন্ম দেয় বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের। মে দিবসের সংগ্রাম ছিল তেমনি এক বিদ্রোহ যা শুধু শ্রমিকদের দাবিতে নয় সমাজের বিকাশের প্রয়োজনে সংঘটিত হয়েছিল। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগাস্ট স্পাইস যে ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন তা আজও আমাদের আলোড়িত করে। তিনি বলেছিলেন, The time will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today.
৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ ও ৪ মে আন্দোলন এবং শ্রমিক নেতাদের ফাঁসির ঘটনায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ভয় না পেয়ে শ্রমিকরা আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল সোশালিস্ট কংগ্রেস ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস ও ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।
শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রম শোষণ যে বন্ধ হয় না বরং নতুন নতুন পদ্ধতিতে শ্রমিককে শোষণ করতে থাকে তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল সম্পদের পাহাড়। ৮ জন অতি ধনীর হাতে বিশ্বের অর্ধেক মানুষের সম্পদের সমান সম্পদ দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, শোষণ কত আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। করোনা মহামারির সংক্রমণ আর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নামে রোবটনির্ভর শিল্প সবই বৈষম্যকে প্রকট করে তুলছে। পুঁজিপতিদের বিপুল বিনিয়োগ, দেশে দেশে তীব্র বেকারত্ব, যাদের কাজ আছে তাদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, আয়ের বিশাল বৈষম্য আজ বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে।
বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। ৬ কোটি ৮০ লাখ শ্রমিকের জীবনমান উন্নত না করে কোনো উন্নয়ন স্থায়ী ও মানবিক হবে না। কাজ, কর্মঘণ্টা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতা অগাস্ট স্পাইস, এঙ্গেলস, ফিশার ও পারসন জীবন দিয়ে যে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তাকে বুকে ধারণ করে বিশ্বের দেশে দেশে আজো শ্রমিকরা লড়ছে। এ লড়াই চলবে শ্রমিকের মর্যাদা, অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে।
লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক বাসদ