Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

আমরা কেন স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র হতে পারিনি?

Icon

রইস উদ্দিন আরিফ

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২২, ১৩:১২

আমরা কেন স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র হতে পারিনি?

রইস উদ্দিন আরিফ

এক.

তিনশ’ বছর আগে থেকে শুরু হওয়া আজকের আধুনিক যুগে, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রকৃত রূপ হলো ‘স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র’। স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র কীরকম? প্রথম কথা হচ্ছে কোনো দেশ ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেই তা এমনি এমনি রাষ্ট্র হয়ে যায় না; গঠন করতে হয়। আর এটা করতে সেই দেশের অভ্যন্তরের সব জাতি, জাতিসত্তা ও ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘সভা’ বা কাউন্সিল গঠন করতে হয়। এই ‘সভা’কেই বলা হয় ‘সংবিধান সভা’ বা ‘সংবিধান কাউন্সিল’। 

সেই সংবিধান কাউন্সিল দেশের সব জাতি, জাতিসত্তা ও ধর্মীয় জাতি-গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকের সমান স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে একটি সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করে। সংবিধান সভা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সেটি হলো, রাষ্ট্রের সব জাতি, জাতিসত্তা ও ধর্মীয় সম্প্রদায় বা জাতি গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্গত প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে সমান স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করে। আর এই রাষ্ট্রই হচ্ছে আধুনিক নাগরিকরাষ্ট্র।

তবে এক্ষেত্রে একটি জরুরি বিষয় অতিমনোযোগ ও গুরুত্ব সহকারে মনে রাখতে হবে সেটি হলো, নাগরিকরাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের বিভিন্ন জাতি, জাতিসত্তা ও ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট জাতি যদি ‘বড়’, ‘প্রভাবশালী’ এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির অজুহাতে রাষ্ট্রে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় বা করে তাহলে সে স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র তো নয়-ই, এমনকি তা স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রও হয় না। যেমন একটি জাতির (বাঙালি জাতির) প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হলেও স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র নয়। তেমনি ভারতে একটি ধর্মীয় জাতির (হিন্দু জাতির) প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার কারণে তা কোনো নাগরিকরাষ্ট্র নয়, এমনকি জাতিরাষ্ট্রও নয়। 

আধুনিক নাগরিকরাষ্ট্র কোনো বাঙালির, মুসলমানের, হিন্দু বা বৌদ্ধের; চাকমা-মারমা অথবা গারো-হাজং কিংবা সাঁওতালের রাষ্ট্র নয়। নাগরিকরাষ্ট্র শুধু নাগরিকদের। নাগরিক কারা? কি পরিচয়ে তারা নাগরিক? আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকরা হচ্ছে শুধু মানুষ পরিচয়ে নাগরিক। আধুনিক রাষ্ট্রের, অর্থাৎ বাংলাদেশকে যদি আমরা আধুনিক রাষ্ট্র মনে করি তাহলে এই রাষ্ট্রের যারা নাগরিক তারা কেউই বাঙালি-চাকমা-মারমা ইত্যাদি জাতির পরিচয়ে নাগরিক নয় আবার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান তথা কোনো ধর্মের পরিচয়েও নাগরিক নয়। তারা সবাই মানুষ পরিচয়ে নাগরিক। 

নাগরিকতার আবেদন কোনো প্রকারের জাতীয়তা বা জাতিবাদিতার আবেদন নয়। নাগরিকতার আবেদন হলো বৈশ্বিকতার আবেদন। বিশ্বের যে কোনো একটি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক শুধু সেই রাষ্ট্রেরই নাগরিক নয়, সে জাতিসংঘেরও নাগরিক। কোনো জাতির বৈশ্বিক চরিত্র নেই, থাকতে পারে না। তেমনি কোনো ধর্মেরও বৈশ্বিকতা নেই, থাকতে পারে না। আধুনিক যুগে বৈশ্বিকতা ধারণ করে শুধুই মানুষ পরিচয়ে নাগরিকরা। 

দুই. 

এতক্ষণের আলোচনার আলোকে শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়, গোটা উপমহাদেশের কয়েকশ বছরের সমাজ রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে আমরা ৩টি প্রশ্ন তুলতে চাই:

১। আজ থেকে প্রায় ৭৬ বছর আগে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হয়ে ভারত একটি আধুনিক নাগরিকরাষ্ট্র হতে পারেনি কেন? 

২। ১৯৪৭ সালে উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়ার মুহূর্তেই দেশ দুই ভাগ হয়ে হিন্দুস্তান হিসেবে ভারত, আর মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তান নামের দুই আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পর দুই রাষ্ট্রের একটিও নাগরিকরাষ্ট্র হতে পারেনি কেন? 

৩। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে, জাতিনিপীড়ক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন করে যে স্বাধীন বাংলাদেশ হলো, সেই বাংলাদেশও পঞ্চাশ বছরেও স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র হতে পারলো না কেন? 

তিনটি প্রশ্নই মূলত একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হলেও উপমহাদেশীয় সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির যুগসন্ধিক্ষণের প্রেক্ষাপটে এটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্যই বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা। 

উনিশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত বিশ্বের ঔপনিবেশিক দেশগুলোর জনগণের (এমনকি জার সাম্রাজ্যবাদ-কবলিত রাশিয়ার জনগণেরও) উপনিবেশ বিরোধী ও জার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সাধারণ আকাঙ্ক্ষা ও কর্তব্য ছিল দেশসমূহের স্বাধীনতা এবং দেশের অভ্যন্তরের সব জাতি, উপজাতি ও জাতিসত্তাগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি আধুনিক নাগরিকরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। 

কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামকালে আমরা উপমহাদেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষেরা স্বাধীনতার অর্থ খানিকটা বুঝেছিলাম, জাতির মুক্তির অর্থও হয়তো বুঝেছিলাম, কিন্তু নাগরিক রাষ্ট্রের অর্থ বুঝি নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বা পরেও বুঝি নাই, এমনকি এখনো বুঝি না। নাগরিকরাষ্ট্রের অর্থ না বোঝার পরিণতি হয়েছে ভয়ংকর। এই ভয়ংকর পরিণতির মধ্যে, ব্রিটিশের কবল থেকে ভূ-ভারত স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তেই দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে, ভারত (হিন্দুস্তান) ও পাকিস্তান নামে দুই দেশ হয়েছে। এবং তার কিছুকাল পর স্বাধীন পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। আর এই বিভাজনগুলো হয়েছে শুধু সংকীর্ণ জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, নাগরিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নয়। তার মধ্যে প্রথম (৪৭-এর) বিভাজনটি হয়েছে সংকীর্ণ ও উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায়, হিন্দু ও মুসলমানের দ্বন্দ্ব এবং নজিরবিহীন বর্বরোচিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমানের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে। আর পাকিস্তান নাগরিক রাষ্ট্র না হওয়ায়, তার জাতিনিপীড়ক ও কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের কারণে পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে হয়েছে লাখ-লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে। 

আধুনিক যুগে এসে (১৯৪৭ সালে) উপমহাদেশের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি কতটা ‘মধ্যযুগীয়’ হতে পারে তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হলে সোজাসুজিই বলতে হয়-হিন্দু মনে করেছে, মুসলমানদের সাথে একত্রে থাকলে সে প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ ‘রামরাজত্বে’র আদলে হিন্দু-ভারত প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। অন্যদিকে, দুইশ’ বছর বর্ণহিন্দুদের নিপীড়নে নিষ্পেষিত মুসলমান মনে করেছে, বর্ণহিন্দুদের ইচ্ছা অনুযায়ী তৈরি এক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থাকলে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে (পাঠক এই মুহূর্তের জন্য আমাকে ক্ষমা করুন, ৭৫ বছর পর আজ আমার আশ্চর্য লাগে, এত বছর আগে সে, এই রূঢ় বাস্তবতাটি কিভাবে বুঝেছিল?) 

তাহলে নানা মহলের নানান যুক্তি-তর্ক ও বাহাস অতিক্রম করে এখন খুব পরিষ্কার করেই বুঝা যাচ্ছে, গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল বাবুরা এবং সেই সাথে জিন্নাহ-লিয়াকত-নাজিমউদ্দীন সাহেবরাও দেশভাগের বিষয়ে খুবই ‘বিচক্ষণ’ ছিলেন। হ্যাঁ, দেশভাগের কাজে তারা বিচক্ষণ ও সিদ্ধহস্তই ছিলেন বটে এবং একইসাথে তারা প্রতিক্রিয়াশীলও ছিলেন। কারণ, ব্রিটিশমুক্ত অখণ্ড ভারতে সব জাতি, সব জাতিসত্তা ও সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলন ঘটিয়ে একটি স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র গঠনে এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের সমান স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদায় তারা বিশ্বাস করতেন না। চিন্তার ক্ষেত্রে তারা ছিলেন বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ও উপনিবেশবাদী। তবে ইতিহাসের নির্মোহ পর্যালোচনার স্বার্থে একটি কথা এখন মনে হয় বলা যায়- সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক ও উপনিবেশবাদী হওয়ার ‘পাপের’ পাল্লাটা জিন্নাহর জন্য যতকিঞ্চিৎ প্রযোজ্য হলেও, গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেলের জন্য শুধু ভারীই নয়, বরং বলা যায় খুব বেশি ভারী। 

এই দেখুন, নাগরিকরাষ্ট্রের আলাপের মধ্যে কীভাবে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আলাপ ঢুকে পড়েছে। তা তো ঢুকে পড়বেই। নাগরিকরাষ্ট্রের আলাপ হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণের পরিচয় বাদে শুধু মানুষ পরিচয়ে নাগরিকদের মুক্তির রাজনীতির আলাপ। আর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের আলাপ হলো হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষ ও বিভেদের রাজনীতির আলাপ। আজ একুশ শতকেও উপমহাদেশের তিনটি দেশের রাজনীতির প্রধান প্রবণতা হলো সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী। এরকম কোনো দেশে স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্র বুঝাবুঝির রাজনীতি থাকে কি করে? 

মোদ্দাকথা হলো, উপমহাদেশের মানুষের, সত্যিকার জাতিমুক্তি ও নাগরিকরাষ্ট্রের অর্থ না বোঝার অনেক কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, আমাদের মহান মহান নেতাদের শেখানো যে রাজনীতির মাধ্যমে আমরা দুইশ’ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম-লড়াই করেছি এবং যে রাজনীতি এখনো আমাদের মাথার ওপর চেপে বসে আছে, সেই রাজনীতিই আমাদেরকে স্বাধীন নাগরিকরাষ্ট্রের অর্থ বুঝতে দেয়নি।

-লেখক ও গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫