Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেট সংঘর্ষের রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পাঠ

Icon

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২২, ১৪:২১

ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেট সংঘর্ষের রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পাঠ

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

কয়েক দিন ধরে টানা ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সাথে নিউমার্কেটের মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে দু’জন মারা গেছেন। হতাহত হয়েছেন অনেকে। নিউমার্কেট, গাউসিয়া ও চাঁদনীচক মার্কেট, নীলক্ষেত ও এলিফ্যান্ট রোড সংলগ্ন মার্কেটগুলো ঢাকার অন্যতম প্রধান মার্কেট। ফলে বলাই বাহুল্য যে, এই প্রায় লাগাতার কয়েক দফা সংঘর্ষে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই অঞ্চলটি এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে দেশের প্রধানতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ অবস্থিত।

এছাড়াও এখানে অবস্থিত দেশের আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ যেমন- ইডেন মহিলা কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুল, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল, উদয়ন বিদ্যালয় ইত্যাদি। ফলে এই অঞ্চলে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে, তার সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে এই সামগ্রিক অঞ্চলের শিক্ষায়তনে। তাই এ লেখার উদ্দেশ্য হলো, কারা ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেটের মধ্যকার এই সংঘর্ষগুলোর জন্য দায়ী তা খুঁজে দেখা। অবশ্য প্রত্যেকে নিজ নিজ পক্ষের সাফাই গাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই সাথে আমি চাই এই সংঘর্ষগুলোর পরিণতি কতদূর গড়িয়েছে বা গড়াতে পারে তা ব্যাখ্যা করা।

ঢাকা কলেজ বনাম নিউমার্কেট এবং নীলক্ষেত বনাম ঢাকা কলেজ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষ আমি বেশ কয়েক দফা সরাসরি দেখেছি, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। প্রতিবারই ঘটনার সূত্রপাত হয় জিনিস কেনাকাটার পর দাম পরিশোধ নিয়ে। হকার বা বিক্রেতারা দাবি করেন ওমুক ছাত্র বা ছাত্ররা দাম পরিশোধ করেনি বা কম দাম দিয়েছে। আর ছাত্ররা দাবি করেন ওমুক হকার বা বিক্রেতা ন্যায্য দামের চেয়ে বেশি দাম চেয়েছে বা যা দাম প্রথমে চেয়েছিল পরে তা থেকে বাড়িয়ে বলেছে। এই ঘটনাগুলো প্রথমে মৌখিক তর্কাতর্কি দিয়ে শুরু হয়, পরে তা হাতাহাতি এবং অবশেষে দলীয় সংঘর্ষের রূপ নেয়। যেমন- শোনা যাচ্ছে যে ১৮ এপ্রিলে ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র না-কি কোনো এক ফাস্টফুড শপে রাতের খাবার খেয়ে দাম দিচ্ছিল না।

অন্যদিকে ছাত্ররা দাবি করেছেন, তাদের কোনো এক ছাত্রকে দোকানিরা আক্রমণ করেন। পরে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা বেশ কিছু দোকান ভাঙচুর করেছেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো যে, আমাদের মধ্যে সামাজিক সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যে তলানীতে ঠেকেছে তার প্রমাণ এই ঘটনাগুলো। তবে এই কথাগুলো বলে ক্ষান্ত দিলে চলবে না। কেন এই ঘটনাগুলো ঘটে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। 

এসব ঘটনার কারণ একাধারে আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক। প্রথম প্রশ্ন হলো কারা ঢাকা কলেজের ছাত্র? অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এদের একটা অংশ দরিদ্র কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, বিশেষত যারা ঢাকা কলেজের হলগুলোতে থাকেন। তাদের অনেকে টিউশনি করে নিজের খরচ চালান। কারণ তাদের মা-বাবার পক্ষে তাদের ছাত্রজীবনের ব্যয়ভার গ্রহণের আর্থিক সক্ষমতা নেই। যারা টিউশনি করে বা অন্য কোনো উপায়ে নিজ খরচ চালাতে পারেন না, তারা অনেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হন। কারণ এই বাহুবলি অবস্থানে থাকলে তাদের খাওয়া-পরাটা কিছুটা হলেও চালিয়ে নেওয়া যায়। দোকানে খাওয়ার বিল, চায়ের বিল বাকি রাখা যায়। কেউ কেউ দলীয় চাঁদাবাজিতে হাত পাকান ইত্যাদি ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে এই দলবাজী একটি চেইন, যার প্রভাব ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন পুরো এলাকাতেই পড়ে। কারণ সিন্ডিকেটগুলো দলীয় পর্যায়ে গড়ে উঠেছে। ফলে যদি কোনো ঘটনা ঘটে তবে তার সুযোগ নেয় দলীয় নেতারাও, যারা বহিরাগত এবং যে কোনো গুণ্ডামি ইংরেজিতে যাকে বলে ভেন্ডালিজম (vandalism) তার সুযোগ তারা হাতছাড়া করে না। তারাও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়; কিন্তু শুধু সাধারণ ছাত্রদেরই নাম পড়ে।

আর এই সংঘর্ষগুলো সাধারণ ছাত্রদের মধ্যেও জিঘাংসা চরিতার্থ করার মনোবৃত্তি তৈরি করে। আমার ছাত্রজীবনে এ রকম একটি ঘটনার সময় আমার এক নিরীহ টাইপের বন্ধু বলেছিল, ‘চল দোস্ত, আমরাও নাইমা পড়ি!’ আমি যে বিস্তৃত বিদ্যায়তনের কথা বললাম, সেখানে এই জিঘাংসার মনোবৃত্তি ক্রমাগতভাবেই তৈরি হচ্ছে। দলীয় রাজনীতি ছাত্রদের ক্যাডার বানাচ্ছে, আর বহিরাগতরা তো আছেনই তাদের জিঘাংসা বাস্তবায়নের শিক্ষা হাতে-কলমে দিতে। যে গ্রামের ছেলেটি কোনো দিন বড়দের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি, সে নির্দ্বিধায় তার বন্ধুকে অন্য দল করে বলে পিটিয়ে আধমারা করছে। এই মারামারিতে আমি কয়েকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীদের মধ্যকার মারামারি এবং চুলোচুলিও দেখেছি। এর রহস্য কোথায়? কে এই দুর্বৃত্তায়ন করছে? করছে তার পরিবেশ, তার আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা। গ্রামের ছেলেটি যখন শহরে আসে, সে দেখে তার মাসিক খরচের সামান্য টাকাটাও সে জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে। অথচ তারই এক বন্ধু তার বান্ধবীর পিছনে ওই টাকার বহুগুণ খরচ করছে।

তার মনে তখন সমাজের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা জন্ম নেয়। সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কোনো অপরাধকে সে আর অপরাধ মনে করে না। আমার মার্ক্সবাদের প্রতি দুর্বলতা পুরনো। আমার বন্ধুরাও তা জানে। একবার ছাত্রাবস্থায় আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, ‘দোস্ত, আজ নীলক্ষেত থেকে দুইটা বই মারিং করলাম। অবশ্য এইডা আমাগো জন্য জায়েজ। কারণ আমরা তো প্রলেতারিয়েত।’ হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ একজন গরীব ছাত্রের সামান্য মাসিক খরচটা কেউ জোগাড় করে দিচ্ছে না। এ কোন দেশে আমরা বাস করছি?

অন্যদিকে পারস্পরিক অশ্রদ্ধাও আমাদের মধ্যে বেড়েছে। ঢাকা কলেজে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রটি অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা পার করে পড়তে এসেছে, সে তো সামান্য সম্মান অন্যদের কাছ থেকে আশা করে; কিন্তু নিউমার্কেট বা নীলক্ষেতের অনেক দোকানির ব্যবহার যথেষ্ট খারাপ। আমার নিজেরও সেই অভিজ্ঞতা আছে। পুরানো-ছেঁড়া বই বা কিছু একটা গছিয়ে দিলে পরে ফেরত দিতে গেলে ঝামেলা করত। কখনো অতিরিক্ত দাম চাইতো। আমার মনে হয় এই বিষয়টা জরুরি ভিত্তিতে সরকারের নজরদারিতে আনা উচিত। দোকানি ও ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা ব্যবহার বিধি বা কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করা আবশ্যক। তা না হলে এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। আর ছাত্র-ছাত্রীরা নিতে থাকবে জিঘাংসার তালিম।


লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫