Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

জাফলংয়ে কেন ফি দিয়ে ঢুকতে হবে?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২২, ১২:৪৪

জাফলংয়ে কেন ফি দিয়ে ঢুকতে হবে?

আমীন আল রশীদ

ঘটনা ঈদের তৃতীয় দিন, ৫ মে বৃহস্পতিবারের। সিলেটের বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে টিকিট কাটা নিয়ে বচসার জেরে পর্যটকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা হয়, যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

যেখানে দেখা যায়, ‘স্বেচ্ছাসেবক’ লেখা নীল ইউনিফর্ম পরা তিনজন যুবক হাতে লাঠি নিয়ে একদল পর্যটককে পেটাচ্ছেন। কয়েকজন নারী তাদের থামাতে গেলে তারাও লাঞ্ছিত হন। ঘটনার পরপরই পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাফলং পর্যটন কেন্দ্রে আগতদের এক সপ্তাহের জন্য বিনা টিকিটে প্রবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। স্থানীয় প্রশাসনের বরাতে গণমাধ্যমের খবর বলছে, কয়েকজন পর্যটক টিকিট ছাড়া জাফলং এলাকায় ঢুকতে চাইলে টিকিট কাউন্টারে থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তারা পর্যটকদের ওপর হামলা চালায়।

প্রশ্ন হলো জাফলংয়ে প্রবেশের জন্য টিকিট লাগবে কেন? জাফলং একটি  প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত উন্মুক্ত স্থান এবং এটি দেশের মানুষের সম্পদ। অর্থাৎ এটি কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন পর্যটনকেন্দ্র নয়; কিন্তু তা সত্ত্বেও জাফলংয়ে প্রবেশের জন্য বছর কয়েক আগে টিকিট চালু করে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন। জাফলংয়ের জিরো পয়েন্ট এলাকায় যাওয়ার জন্য এই প্রবেশ ফি চালু করা হয়। এজন্য বসানো হয় একাধিক টিকিট কাউন্টার। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান কিছু কর্মী। তারা প্রত্যেক দর্শনার্থীর কাছ থেকে ১০ টাকা করে ফি নেন।

প্রশ্ন হলো, স্থানীয় প্রশাসন কেন জাফলংয়ের মতো এ রকম একটি উন্মুক্ত জায়গায় প্রবেশের জন্য ফি নির্ধারণ করল? এই টাকা কি সরকারি কোষাগারে জমা হয় না-কি স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র ও মাস্তানদের পুনর্বাসনের জন্য খরচ হয়? এটি প্রশাসনিক পদ্ধতিকে চাঁদাবাজি কি-না, সে প্রশ্নও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যদি এ রকম একটি জায়গায় ঘুরতে গিয়ে মানুষকে টিকিট কাটতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কক্সবাজার, পাহাড় এমনকি নদীতে বেড়াতে গেলেও টিকিট কাটতে হবে এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ও মাস্তানদের একটি অংশ প্রশাসনের সহায়তায় ব্যবসা খুলে বসবে।

আগে পর্যটকরা জাফলং জিরো পয়েন্টে যেতেন বল্লাঘাট এলাকা দিয়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন গুচ্ছগ্রাম এলাকা দিয়ে পর্যটক প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যটকদের ওঠানামার সুবিধার জন্য বানানো হয়েছে সিঁড়ি। আর গুচ্ছগ্রামে বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই বসানো হয়েছে টিকিট কাউন্টার। কাউন্টারের পাশে টানানো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘জাফলং পর্যটন এলাকার উন্নয়ন ও পর্যটন সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলা পর্যটন কমিটি ও উপজেলা পর্যটন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যটক প্রবেশে পর্যটক প্রতি ১০ টাকা হারে ফি নির্ধারণ করা হলো।’ বাস্তবতা হলো, দেশের পর্যটনশিল্প বিকাশে সরকারের নানা পদক্ষেপ রয়েছে। বাজেট রয়েছে। সেই বাজেট থেকেই পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের সুবিধার্থে নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। তাহলে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিতে হবে কেন?

অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশে পর্যটন খাত বিকশিত না হওয়ার পেছনে যেসব বড় কারণ রয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে এই চাঁদাবাজি। পর্যটনকেন্দ্রে সামান্য একটি টং দোকান দিতে গেলেও পুলিশ ও মাস্তানদের চাঁদা দিতে হয়। ফলে সেই চাঁদার টাকা তুলতে হয় পর্যটকদের কাছ থেকে ১০ টাকার জিনিস ২০ টাকায় বিক্রি করে। যে কারণে দেখা যায়, দেশের প্রতিটি পর্যটন এলাকায় জিনিসপত্র, বিশেষ করে খাবারের দাম দ্বিগুণ বা তিনগুণ। অনেক সময় খাবারের এই দাম গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হয়। অথচ চাঁদাবাজি না থাকলে দোকানদাররা অনেক কম দামে পর্যটকদের পণ্য ও সেবা দিতে পারতেন। 

তবে কিছু ক্ষেত্রে ফি থাকা মন্দ না, যদি পর্যটকদের জন্য সত্যিই কিছু বাড়তি সেবা নিশ্চিত করা যায়। যেমন- আমাদের দেশের পর্যটন এলাকাগুলোর খুব সাধারণ সমস্যা হলো টয়লেট না থাকা। পুরুষরা এখানে-ওখানে শৌচকর্ম সারতে পারলেও, নারীদের জন্য এটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সুতরাং প্রতিটি পর্যটন এলাকায় যদি নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে এবং সেগুলো সার্বক্ষণিকভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কিছু লোক নিয়োগ করা হয়, তাহলে ওই সেবার বিনিময়ে পর্যটকদের কাছ থেকে নামমাত্র ফি নেওয়া যেতেই পারে; কিন্তু ফি দেওয়ার বিনিময়ে পর্যটকরা আসলে কী সেবা পাচ্ছেন এবং ওই ফি দিয়ে আসলে পর্যটকদের সেবার মান বাড়ানো হচ্ছে না-কি স্থানীয় মাস্তানদের আয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে সেটিই বড় প্রশ্ন।

মনে রাখা দরকার, যেখানেই টাকা পয়সা, সেখানেই অপরাধের শঙ্কা। অর্থাৎ জাফলংয়ে যারা ঘুরতে যান তাদের মধ্যে এ রকম অনেকেই থাকবেন যারা ১০টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে চাইবেন না বা তার কাছে এই টাকা দেওয়াটা যৌক্তিক বা ন্যায্য মনে হবে না, তখন তিনি এটা নিয়ে ঝগড়া করবেন এবং যা হবার তা-ই হবে।

কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন পার্ক বা পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ করতে গিয়ে টিকিট না কাটার ঘটনা ঘটে না; কিন্তু জাফলং যেহেতু কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা নয়, বরং এটি একটি প্রাকৃতিকভাবে উন্মুক্ত একটি জায়গা, যেটির মালিক সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের জনগণ। অতএব, এখানে প্রবেশের জন্য প্রবেশমূল্য নেওয়াটাই অযৌক্তিক।

পর্যটকদের সেবা দেওয়ার বিনিময়ে যে এই ফি নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাও যৌক্তিক নয়। কারণ পর্যটনকেন্দ্রে মানুষের জন্য কিছু সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনেরই। তাছাড়া দেশে পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং তার অধীনে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের বাজেট আছে। সেই বাজেট কোথায় খরচ করা হয়?

জাফলংয়েও যে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক যান এবং তাদের কাছ থেকে যে ফি নেওয়া হয়, সেই টাকার পরিমাণ কত এবং এই টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় করা হয়, স্থানীয় প্রশাসনের উচিত তার পরিষ্কার হিসাব প্রকাশ করা। কেননা ঈদসহ এ রকম উৎসব ও ছুটির দিনে জাফলংয়ে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। এই বিপুল মানুষের কাছ থেকে যে টাকা আদায় করা হয়, তার কত শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়, কত টাকা পর্যটনকেন্দ্রের উন্নয়নে ব্যয় হয়, সেই খাতগুলো কী কী এবং স্বেচ্ছাসেবক নামে যাদেরকে এখানে ফি আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে কত টাকা দেওয়া হয়, কিসের ভিত্তিতে এবং কোন মানদণ্ডে তাদেরকে কত টাকা দেওয়া হয়, এই টাকার কোনো ভাগ স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের পকেটেও যায় কি-না তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

সিলেটের একটি সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়েছে, জাফলংয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে আদায় করা এই ফি উপজেলা পর্যটন কমিটি নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। যেখানে এখন পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এই টাকা যদি সত্যিই পর্যটনকেন্দ্রের উন্নয়নে ব্যয় হয় তাহলে সেটি মন্দ নয়; কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাফলংয়ের মতো একটি উন্মুক্ত প্রাকৃতিক স্থানে উন্নয়নের কী আছে? এখানে তো নিশ্চয়ই কোনো বড় অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে না বা সেটি করা যাবেও না। তাহলে এই টাকা দিয়ে সরকার কী করবে?

তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, পর্যটকদের সাথে বচসার জেরে যেভাবে তাদের মারধর করা হলো, তাতে মনে হয়েছে হামলাকারীরা প্রশাসনের লাঠিয়াল। এটি শুধু স্থানীয় প্রশাসনের ভাবমূর্তিই নষ্ট করেনি বরং জাফলংয়ের মতো একটি অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানে সাধারণ মানুষদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করবে। মানুষের মনে এই ঘটনা বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে এবং ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫