Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

শ্যাম বেনেগাল নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’

Icon

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২২, ১৩:১২

শ্যাম বেনেগাল নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’

রাহমান চৌধুরী

শ্যাম বেনেগাল বড় মাপের এমন একজন চলচ্চিত্রকার, যিনি হিন্দি ছবির জগতের অনেক ধ্যান ধারণাই পাল্টে দিয়েছিলেন। সেখানকার চলচ্চিত্রের দীর্ঘদিনের উচ্চকিত অভিনয়রীতির জায়গায় নতুন ধরনের বাস্তববাদী অভিনয়ের ধারাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং নির্মাণ করেছেন মূলধারার হিন্দি চলচ্চিত্রে নতুন ভাষা। তার হাত ধরেই সত্তর দশকে চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন শাবানা আজমী, অনন্ত নাগ, গিরিশ কারনাড, নাসির উদ্দীন শাহ, স্মিতা পাতিল, অমরেশ পুরী, পঙ্কজ কাপুর প্রমুখ।  

দুই হাজার পনের সালে ঢাকায় তার সাথে আমার পরিচয় হয় একটি চলচ্চিত্র উৎসবে। একজন গুণগ্রাহী হিসাবে তার সাথে অনেক গল্প হয়। যেদিন ফিরে যান, তাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও ছিল আমার ওপর। বিমানবন্দরে তিনি আমাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে কখনো মুম্বাই গেলে যোগাযোগ করতে বলেন। সে বছরের অক্টোবর মাসেই মুম্বাই গেলে তাকে ফোন করেছিলাম।

ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাসের অধীন ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারকে আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম, শ্যাম বেনেগালের ছবিগুলির একটি প্রদর্শনী করার বিষয়ে। ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার তাতে সম্মতি দিলে এবং শ্যাম বেনেগালের অনুমতি লাভের প্রশ্ন তুললে, আমি সে বিষয়েই চলচ্চিত্র পরিচালক বেনেগালের সাথে কথা বলার জন্য মুম্বাই গিয়ে ফোন করি। তিনি আমাকে সাদরে পরদিন সকালে তার কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন। 

চলচ্চিত্র প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেনের সাথে সেবার মুম্বাই গিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময়ের মিনিট দশেক আগে শ্যাম বেনেগালের অফিসে পৌঁছে দেখলাম তিনি তখনো আসেননি। অফিসে তার পরিচালিত ছবিগুলোর পোস্টার টানানো আছে দেয়ালে। দেখলাম একজন কর্মচারী বা কেউ পূজা দিয়ে অফিসের কাজকর্ম আরম্ভ করছেন। পরিচালক বেনেগাল নিষ্ঠাবান হিন্দু কিনা আমি জানি না। সকালে তার অফিসে এরকম উপাসনার রীতি দেখে সামান্য আশ্চর্য হয়েছিলাম।

তার আসতে দেরি হলো মিনিট পাঁচেক। সাথে সাথেই আমাকে ডেকে পাঠালেন। তার কক্ষের চারিদিকে এমনকি অফিসের মেঝেতেও নানান বই রাখা আছে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, তিনি পরের যে ছবিটি করবেন, তার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করছেন। জানালেন ছবিটি তিনি করবেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ আর স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে। সম্ভবত সরকারী অনুদান নিয়েই কাজটি করবেন। তিনি জানালেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের ইতিহাসটা জটিল আর সে কারণেই অনেক পড়াশোনা করতে হচ্ছে।

মূলত তার ওই ছবিটি নিয়েই কথা হয়েছিল সেদিন অনেক বেশি। তিনি তখনো সুনির্দিষ্ট করতে পারেননি, সেই ছবিতে কোন দিকটি গুরুত্ব পাবে। তিনি পড়াশোনা করার ভিতর দিয়েই তা ঠিক করবেন। ছবিতে অনেক বেশি চরিত্রের উপস্থিতি থাকবে, ঠিক যেমন ছিল আগের নেতাজী ছবিটিতে; কিন্তু তার এবারের ছবিটি হবে আরো বিশাল পরিধিতে। আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম তার ছবি সম্পর্কে এসব জেনে। কারণ ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে একটি বড় মাপের ছবি হবে ভারতের পরিচালকের হাত দিয়ে এটা অবশ্যই আনন্দের খবর ছিল। তখন তার বয়স বিরাশির বেশি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, ছবিটা করতে পরিচালকের সব মিলিয়ে অনেক সময় লাগবে আর সম্ভবত সেটাই হবে বেনেগালের শেষ ছবি। হয়তো সেটাই হবে তার এ শতকের সবচেয়ে আলোচিত কাজ। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এবং ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক ডামাডোলের পরিপ্রেক্ষিতে মনে মনে আমি তার ছবিটি দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম।

যখন কয়েক বছর আমি জানতে পারলাম, তিনি দুই দেশের সরকারের যৌথ প্রযোজনায় শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর একটি কাহিনীচিত্র করবেন, খুব চমকে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে তিনি যে ছবিটা করতে চান তাহলে তার কী হবে? যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার, সেই বয়সে এসে দুটি ইতিহাস নির্ভর ছবি করা কি সম্ভব হবে তার পক্ষে?

মনে মনে ভেবেছিলাম, তিনি কি হিসাব মেলাতে ভুল করছেন? সত্যিই কি তার পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন নিয়ে ভালো ছবি করা সম্ভব? পরিচালক হিসেবে তার মেধা নিয়ে শঙ্কা ছিল না, শঙ্কিত ছিলাম পারিপার্শ্বিকতা আর বাস্তবতা নিয়ে। মুম্বাইয়ের অফিসে তার সাথে আলোচনার দিন এটা বুঝেছিলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে তার জানাশোনার পরিধি খুব কম। তেমন ধারণা নেই বললেই চলে। ধারণা থাকাটা তার জন্য জরুরি ছিল না, যদি ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’ নামের ছবি করার দায়িত্ব না নিতেন। ছবিটি করার ক্ষেত্রেও ধারণা না থাকাটা খুব দোষণীয় নয়, যদি তিনি পড়াশোনা আর গবেষণা করার জন্য যথেষ্ট সময় পেতেন। কারণ তিনি এমন একজন ইতিহাসের চরিত্র নিয়ে কাজ করছেন, যার স্মৃতি এখনো বহু মানুষের কাছে উজ্জ্বল।  

ইতিহাসের চরিত্র নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে সেই চরিত্রটিকে তীক্ষ্ণভাবে বুঝতে হয়, খুব গভীরভাবে তার সময়কালকে জানতে হয়। সেখানেই শেষ নয়, যে মানুষগুলো সেই চরিত্রের আশপাশে ছায়া হয়েছিল, ছবি নির্মাণ করতে গেলে সেই মানুষগুলোকে পর্যন্ত আদ্যপান্ত জানতে হয়। গল্প-উপন্যাস লিখতে গেলে যতটা জানতে হয়, ছবি নির্মাণ করতে গেলে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি জানতে হয়। তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে জানাটাও জরুরি হয়ে ওঠে। কারণ চলচ্চিত্রে সেই সব চরিত্রকে জীবন্ত আর বাস্তব হয়ে উঠতে হবে। সেই পার্শ্ব চরিত্রগুলো চলচ্চিত্রে সঠিকভাবে ফুটে না উঠলে, মূল চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা কঠিন। বঙ্গবন্ধুর চরিত্র কি কখনো সঠিকভাবে চিত্রায়ন করা যাবে যদি ভাসানী, তাজউদ্দীন, মোশতাক-সেই সাথে আরো সব নেতা, ছাত্র নেতাদের সম্পর্কে গভীরভাবে ধারণা না থাকে?

এগুলো হচ্ছে বিষয়বস্তুর প্রশ্ন। ইতিহাসের চরিত্রগুলোর দার্শনিক দিক। শিল্পের প্রশ্নে দরকার হবে চরিত্রগুলোর অবয়ব ঠিক রাখতে পারা। চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তোলার মতো বিশ্বাসযোগ্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের উপস্থিতি। চলচ্চিত্রে এইসব কিছু মিলিয়ে ফেলা এত সহজ নয়। নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর অবয়ব নিয়ে তত প্রশ্ন উঠবে না; কিন্তু চলচ্চিত্র হচ্ছে ন্যাচারালস্টিক বা স্বভাববাদী শিল্প। সেখানে ফাঁকফোকর রাখার সুযোগ কম। 

ঠিক সে-কারণেই শেখ মুজিবের মতো ইতিহাসের বিশাল মাপের ব্যক্তিকে নিয়ে ছবি করতে গেলে দরকার দীর্ঘদিন ধরে অধ্যায়ন, গবেষণা আর অনুসন্ধান চালানো। এ ক্ষেত্রে ‘দেখলাম আর জয় করলাম’, বিষয়টা মোটেই তা নয়। দরকার বিরাট বাজেট। পরিচালককে সহযোগিতা করার জন্য বড় বড় মাথা। বড় বড় সেসব মাথার মধ্যে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে বড় বড় ইতিহাসবিদ, যারা গল্প বা বিষয়বস্তু দাঁড় করতে সাহায্য করবেন। যাদের দখলে থাকবে নানারকম তথ্য আর নখদর্পণে থাকবে ইতিহাসবোধ, সমাজবিজ্ঞানের দ্বান্দ্বিক ধারণা। কারো সখ হলো আর গল্প লিখতে বসে গেলেন, বিষয়টা আদৌ তেমন নয়।

কারণ বিষয়বস্তুর মূল কথা হলো ইতিহাস। ঠিক একইভাবে অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের শুধু অবয়ব নয়, নিজ নিজ চরিত্র চিত্রনের জন্য থাকতে হবে ইতিহাসের ওপর দখল। চরিত্রটি কোন সমাজের কোন ইতিহাসের মধ্যে বিচরণ করছে না জানলে, চরিত্রের অন্তঃস্থল ফুটিয়ে তোলা সম্ভবই নয়। স্তানিস্লাভস্কি বা যে কোনো বিজ্ঞানমনস্ক পদ্ধতির অভিনয়ের ক্ষেত্রে এটা চরম সত্যি। সেখানেও ‘আসলাম, দেখলাম, আর জয় করলাম’ হবে না, অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের দীর্ঘদিন ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। 

সবকিছুর পর যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা থেকে যায়, তা হলো একটা বিশেষ দল বা দলের সরকার এই ছবিটি করার জন্য টাকা দেবে। সেই সরকার বা দল কি নিরপেক্ষভাবে শেখ মুজিবের জীবনী নিয়ে ছবি করতে দেবে, নাকি নিজদের দলের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালককে প্রভাবিত করবে? ভারত সরকারের ভূমিকাটাই বা সেখানে কী হবে? ভারত সরকার কেন শেখ মুজিবের ছবি নির্মাণের জন্য টাকা ঢালছে, সেটাও বিরাট প্রশ্ন। সবাই মিলে আসলে মুজিবকে কোন চোখে বা কেমন চোখে দেখতে চাইছে সেটাই প্রধান বিবেচ্য।

সকল অভিনেতা অভিনেত্রী কি সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি লালন করতে পারবে? পরিচালক শ্যাম বেনেগালই বা মুজিবকে কোন চোখ দিয়ে দেখবেন, এগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় যে-কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে। পরিচালক কি স্বল্প সময়ে প্রকৃত মুজিবকে চিনে উঠতে পারবেন বা তার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কি প্রযোজকদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা মিলবে? সবরকম বিবেচনা থেকেই যখন দেখলাম শ্যাম বেনেগালই ছবিটি করতে যাচ্ছেন, তখন প্রথমেই মনে হয়েছিল, আমার প্রিয় এই চলচ্চিত্র পরিচালকটি শেষজীবনে নিন্দা লাভের একটি পথ ধরেই হাঁটছেন কী? গত কদিনের নানা প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, আমার সে ধারণাটাই সত্যি হতে যাচ্ছে। সত্যি না হলেই খুশি হবো।

লেখক: শিক্ষক, সমাজ-গবেষক, নাট্যকার

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫