
সমাজ সৃষ্টির
ঊষালগ্ন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ছিল। আর সমাজ আছে বলেই সামাজিক সমস্যাও রয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় এ সমস্যাগুলোর পরিবর্তন হয়েছে শুধু রূপ বা ধরণ। আর বিভিন্ন সমস্যার
মধ্যে বর্তমান সময়ে অন্যতম একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইভটিজিং নামক সামাজিক
ব্যাধি। যা পত্রিকায় চোখ রাখলই বুঝা যায়।
সাধারণত যে
কাজগুলো করলে নারীরা উত্ত্যক্ত হয় তাকে ইভটিজিং বলা যেতে পারে। ইভটিজিং এর ধরণগুলো
হতে পারে এমন- নারীদের পিছু নেওয়া, পথরোধ করা, প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব লিখে চিরকুট
দেওয়া বা বলা, সাড়া না পেলে হুমকি দেওয়া, শিস দেওয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, অশোভন কথা
লিখে ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো, অশ্লীল ছবি বা ভিডিও পাঠানো, ফু দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া
দেওয়ার মতো বিষয়।
অতীতে এমন বিষয়গুলোকে
আমাদের সমাজে অতি সাধারণ বিষয় মনে বলে মনে
করা হতো। সমাধানও হতো পারিবারিক বা সামাজিকভাবে। সমাজে দেখতাম কারও সন্তানের ত্রুটি
চোখে পড়লে তার বাবা-মাকে জানালে তিনি তা ইতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করতেন, করতেন শাসন।
এমনকি সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা জ্যেষ্ঠরাও করতে পারতেন শাসন। এ নিয়ে প্রতিত্তোর
করতে দেখা যেত না অভিভাবকদের। বরং সন্তানকে শাসন করায় খুশিই হতেন তারা। ভয়ও কাজ করতো
কিশোর ও যুবকদের ভিতরে।
কিন্তু বর্তমান
সময়ে বাবা-মাকে জানালে তিনি তা দেখেন নেতিবাচক দৃষ্টিতে, তার সন্তান অমন কাজ করতে পারেনা,
বলেও দেন এমন কথা। বাবা-মার সমর্থন পেয়ে কিশোর, যুবকরা ইভটিজিং এর মতো কাজ করতে উৎসাহিত
হচ্ছে, আর অভিযোগ দিয়ে ফল না পাওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন সমাজের মানুষ। সুস্থ সামাজিকীকরণের
ঘাটতি থাকায় ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে পড়ছে কিশোর ও যুবকদের ওপর পরিবার ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ।
পরিণামে ইভটিজিং বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে।
আবার, অপসংস্কৃতিও ইভটিজিং বাড়ার ক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। পরিশীলিত, মার্জিত, উন্নত ও সুন্দর জীবনাচরণের সাধনাই হলো সংস্কৃতি। এর বিকৃত পথই হলো অপসংস্কৃতি। সুস্থ বিনোদনের অভাব আর আকাশ সংস্কৃতির সহজলভ্যতার কারণে কিশোর ও যুবকরা অসুস্থ বিনোদনকেই বেছে নিচ্ছে। প্রেম বিষয়টিকে তারা সস্তা ও একতরফা ভেবে নিয়ে অশালীনভাবে প্রস্তাব দিয়ে মেয়েদের করছে উত্ত্যক্ত বা ইভটিজিং।
এছাড়া, উঠতি
বয়সের কিশোররা যখন দেখে যে তাদের বয়সে বড় যাকে তারা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে তারাই যদি
পথে-ঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে কিংবা পরিবারেও তাদের চাচাতো, মামাতো, খালাতো এমনকি
ফুপাতো ভাইবোনদের প্রতি অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে তখন তারাও বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু
করে এবং এধরণের নিন্দনীয় কাজ করতে উৎসাহিত হয়। সুস্থ সামাজিকীকরণের অভাব যে ইভটিজিং
বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ তা বলা যেতে পারে।
যা পত্রিকায়
পাতায় চোখ রাখলেই বুঝা যায়। গত ১২ জুন বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত শিরোনাম ছিল,' কক্সবাজারে
খুরুশকুলে ইভটিজিংয়ে বাধা দেয়া তরুণীর ভাইকে মারধর; গত ১৩ জুন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে
ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় চার শিক্ষিকার শরীরে গোবর ও কাদা মিশ্রিত ময়লা
পানি ছুঁড়লো বখাটেরা' প্রকাশিত খবরগুলো কারো অজানা নয়। এমন শিরোনাম প্রায়শই দেখা যায়।
এক ধরণের অজানা আশঙ্কা শঙ্কিত করে তুলছে নারীদের।
যাই হোক, ইভটিজিং
নামক এ নিন্দনীয় ব্যাধি সমাজ থেকে দূর করতে হলে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে শিশু, কিশোরদের
সামাজিকীকরণের দিকে। কারণ শিশু, কিশোরদের জীবনের ভালো ও খারাপ অভ্যাস পরিবারের সামাজিকীকরণের
ফল। শিশু, কিশোরদের সবচেয়ে কাছের মানুষ হলেন মা-বাবা। আবার বাবার চেয়েও অধিকতর কাছের
মানুষ হলেন মা। আর তাদের সামাজিকীকরণের প্রথম সূত্রপাত ঘটে মায়ের কাছ থেকেই। ভাষা শিক্ষার
প্রথম মাধ্যম মা। খাদ্যাভাস, আচার-আচরণ শিক্ষা দেন মা। তাছাড়া বর্ণ, শব্দ, ছড়া 'মা'ই
প্রথম শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এ সবই শিশুর মনে প্রভাব ফেলে যা তার আচার-আচরণের মধ্যে প্রকাশ
পায়। বাবা পরিবারের জন্য উপার্জন করেন। আবার কোনো কোনো পরিবারে মাও। সংসার পরিচালনা
করতে তাদেরকে অনেক নিয়ম শৃঙ্খলা প্রয়োগ করতে হয়। এই মূল্যবোধ শিশু, কিশোরদের সামাজিকীকরণে
প্রভাব বিস্তার করে। এ ছাড়া পরিবারের বড় ভাই-বোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি
ও নিকট আত্নীয় স্বজনের কাছ থেকে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, স্নেহ-ভালোবাসা, শৃঙ্খলাবোধ,
নিয়ম-নীতির শিক্ষা পেয়ে থাকে যা তাদের ধারণাকে সমৃদ্ধ ও নিজ সম্পর্কে সুদৃঢ় করে। বিপরীত
অবস্থায় শিশু, কিশোরদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ বিঘ্নিত হয়। অনেক সময় মায়ের অধিক স্নেহে
সন্তান ভুল পথে পা বাড়ায়। যেহেতু বাবাকে পরিবারের জন্য উপার্জন করতে সব সময় ব্যস্ত
থাকতে হয়, সেহেতু মা'কে খোঁজ রাখতে হবে- সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কাদের সাথে মিশে,
বন্ধু-বান্ধবরা কেমন, নেশা করছে কিনা, কখন বের হয়, কখন বাড়িতে ফিরে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে
আড্ডা দিচ্ছে কিনা, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, মোবাইলে খারাপ কিছু করছে
কি-না ইত্যাদি সম্পর্কে। ব্যতিক্রম কিছু দেখলে তা গোপন না রেখে জানাতে হবে বাবাকে।
এছাড়া পরিবারে ব্যবস্থা করতে হবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার। শিশু, কিশোররা গড়ে উঠবে আত্মসচেতন
ও ব্যক্তিত্ববান হিসেবে।
তবেই বিপথগামী
হওয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে এবং কমবে ইভটিজিং এর মতো নিন্দনীয় সামাজিক ব্যধি।
সেই প্রত্যাশা সবার।
লেখক : এম এ মাসুদ, কান্দি গার্লস আলিম মাদ্রাসা, পীরগাছা, রংপুর