
এম এ মাসুদ
জন্মলগ্ন থেকেই নানা প্রতিকূলতা
অতিক্রম করে মানবসন্তানকে তার অভীষ্ঠলক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। মানবজীবনে সুখ-দুঃখ যেন অলঙ্ঘনীয়
এক নিয়তি। চিরজীবন ধারাবাহিকভাবে যেমন কেউ দুঃখ পায় না, ঠিক একইভাবে সুখের মুখও কেউ
দেখে না।
জগতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া
মুশকিল যার মনে কোনো দুঃখ ও কষ্ট নেই। অবস্থাভেদে হয়তো দুঃখ, কষ্টের মধ্যে ভিন্নতা
রয়েছে, তবে একেবারে নেই বোধকরি এমনটি বলা যায় না।
আমরা যা কিছুই করি না কেন,
তার পিছনে রয়েছে আশা বা অভাববোধ এবং এটি জীবনব্যাপী একটি প্রক্রিয়া। সব আশা বা অভাব
একই সাথে পূরণ হয় না। কিছু কিছু আশা অপূর্ণও থেকে যায়। কিন্তু তারপরও থামছে না আত্মহননের
মতো ঘটনা। প্রখ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তার ‘The Suicide’ গ্রন্থে আত্নহত্যার
৪টি কারণ তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো- আত্মকেন্দ্রিকতা, নৈরাজ্য, পরার্থ ও হতাশা।
পত্রিকায় প্রকাশিত আত্নহত্যার
খবরগুলো পড়ে এর পিছনে যে কারণগুলোও প্রতীয়মান হয় তা হলো- কোনো কিছু অর্জন করার আশা
করে তা অর্জন করতে না পারার ব্যর্থতা, বাবা-মাসহ আপনজনের অকাল মৃত্যুজনিত বেদনা বা
শোক, ভালোবেসে সেই ভালবাসার মানুষটিকে কাছে না পাওয়ার মনঃকষ্ট, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা,
উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও কর্মসংস্হান না হওয়ায় বেকারত্বজনিত হতাশা, ঋণের বোঝা বৃদ্ধি,
পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট, মেয়েদের প্রতি
বখাটেদের উৎপাত, মাদকাসক্তি, মা-বাবার সামান্য বকুনি, নারী নির্যাতন, যৌতুক, ধর্ষণ
ও ব্লাকমেইল কিংবা অভিমানে আত্নহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। আত্নহত্যার এ প্রবণতা একদিকে
যেমন আমাদের সামাজিক সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে, অন্যদিকে তেমনি উদ্বিগ্ন করে তুলছে
পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে।
গত ২০ জুলাই আনন্দ বাজার পত্রিকায়
প্রকাশিত খবর- ঋণে জর্জরিত! গাড়িতে স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন ব্যবসায়ী-
আগুনে ঝলসে যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তার নাম রামরাজ ভাট। বয়স ৫৮। যে মহিলা এবং যুবককে
ঝলসানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে, তারা ওই ব্যক্তির স্ত্রী নন্দিতা এবং ছেলে নন্দন।
দু’জনের
অবস্থা আশঙ্কাজনক। ৫৮ বছর বয়সী রামরাজের বাড়ি থেকে একটি সুইসাইড নোটও উদ্ধার করেছে
পুলিশ।
২১ জুলাই সাম্প্রতিক দেশকালের
শিরোনাম:
'রাতে ফাঁস নিলেন এডিসি লাবণী,
ভোরে মিলল সাবেক দেহরক্ষীর লাশ- মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায় একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারের
(এডিসি) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার নাম খন্দকার লাবণী। গতকাল বুধবার রাত ১২টার দিকে
উপজেলার সারঙ্গদিয়া গ্রামে তার নানাবাড়ি থেকে সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত
অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। পরিবারের লোকজন তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত
ঘোষণা করেন।
এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে মাগুরা
পুলিশ লাইনস থেকে এক কনস্টেবলের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে
পুলিশ লাইনসের ব্যারাকের ছাদ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। মাহমুদুল হাসান (২৩) নামের
ওই কনস্টেবলের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পিপলুবাড়িয়া গ্রামে। দেড় মাস আগে তিনি
মাগুরায় বদলি হয়ে আসেন। পুলিশের ধারণা, নিজ নামে ইস্যু করা অস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন
তিনি।
মাগুরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ
জহিরুল ইসলাম আজ বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) দুপুরে বলেন, কনস্টেবল মাহমুদুল হাসান দেড়
মাস আগে মাগুরায় বদলি হন। এর আগে তিনি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি খন্দকার লাবণীর
দেহরক্ষী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুটি ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা সেটি এখনো নিশ্চিত
হওয়া যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত, দুজনেই আত্মহত্যা করেছেন। দুইজনের আত্মহত্যার কারণ
জানতে পুলিশ তদন্ত করছে। 'জামালপুরের সরিষাবাড়িতে মোটরসাইকেলের জন্য ফেসবুক লাইভে শিক্ষার্থীর
আত্মহত্যা;
গত ২ জুলাই স্বামীর সাথে ফোনে
কথা শেষে কিশোরীর আত্মহত্যা-র মতো ঘটনাগুলো যে কারণেই ঘটুক না কেন সমাজের জন্য তা অশনিসংকেত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য
অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আত্নহত্যা করেন ৮ লাখ মানুষ। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬
জন।
গত বছর ১৩ মার্চ এক ওয়েবিনিয়ারে
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশেনের জরিপ টিমের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ মার্চ
থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল
ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরিকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখিত সময়ে সারা দেশে আত্মহত্যা
করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন।
আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর
তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সারাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। ২০১৯ সালের তুলনায়
২০২০ সালে আত্মহত্যা বেড়েছে ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬টি আত্নহত্যার
ঘটনার মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজার ২২৮টি এবং পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা
ঘটেছে ৬ হাজার ২০৮টি, যা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। ২০২১ সালের প্রথম ১০ মাসে দেশে
মোট মৃত্যুর কিছু কারণ খুঁজে বের করে বিবিএস। ১০ মাসে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫
হাজার ২০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তখন আত্নহত্যা করেছেন১১ হাজারের বেশি মানুষ।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার
উদ্দিন চৌধুরীর মতে, আত্মহত্যা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। ব্যক্তিবিশেষে
ক্ষেত্রগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগা, চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির ব্যবধান,
অসহায়ত্ব, কর্মহীনতা, নৈতিক মূল্যবোধ একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া, অর্থসংকট ও চারপাশের পরিবেশের
সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারাসহ বেশ কয়েকটি কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
একটি সম্ভাবনাময় জীবনের অকাল
মৃত্যু মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্নীয়-স্বজনদের জন্য যে কতটা বেদনাদায়ক তা গতকাল ২৪ জুলাই
প্রতিদিনের সংবাদে প্রকাশিত 'মাদারীপুরের কালকিনিতে কুকুরের কামড়ে বড় ছেলে নয়ন পালের
মৃত্যু, সইতে না পেরে মা মেঘনা পালের বিষপানে আত্মহত্যা'র খবরটি থেকে বুঝা যায়।
ইসলামে আত্মহত্যা করা শুধু
মহাপাপই নয়, একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। আত্মহত্যা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা
ঘোষিত হয়েছে, ‘তোমরা নিজের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৫)
আত্মহত্যার পরিণাম সম্পর্কে
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের এক ব্যক্তি আহত হয়ে সে ব্যথা
সহ্য করতে পারেনি। সে একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে
মারা যায়। এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে
বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অর্থাৎ আত্নহত্যার প্রতিফল
চিরস্থায়ী জাহান্নাম।
সুতরাং, আত্নহত্যার মতো ভয়ঙ্কর
এ সামাজিক ব্যধি থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। সেজন্য পরিবারে বাড়াতে হবে ধর্মীয়
ও নৈতিকতার চর্চা, মাকে খেয়াল রাখতে হবে সন্তান বাসা থেকে কখন বের হয়, কখন ফিরে, রুমে
কী করে, কোথায় যায়, কার সাথে মিশে সব। শাসনের পাশাপাশি সন্তানের সাথে সম্পর্ক তৈরি
করতে হবে বন্ধুত্বের মতো। সরকারি-বেসরকারিভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে যুবদের।
আমাদের মনে রাখতে হবে- আত্নহননই একমাত্র সমাধান নয়। অভাব বা অপ্রাপ্তি থাকবে, এটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আকস্মিক দুর্যোগ বা বিপদে ভেঙে না পড়ে সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে দৃঢ়চিত্তে। চাওয়া-পাওয়াকে পূরণ করতে দৃঢ়ভাবে অবিরাম প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দুঃখ, কষ্ট, বিপদ দেখে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্ধকারই কেবল মানুষের জীবনে অনিবার্য সত্য নয়, আঁধারের মাঝেই আবার উদিত হবে স্নিগ্ধ চাঁদ। দূরীভূত হবে জীবনের সকল অন্ধকার। সর্বোপরি মহান স্রষ্টার প্রতি রাখতে হবে আমাদের অগাধ বিশ্বাস। তবেই কমবে আত্নহত্যার প্রবণতা। শান্তিময় হয়ে উঠবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
এম এ মাসুদ, সংবাদকর্মী