চা বাগান শ্রমিক ও আমাদের স্বাধীন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

রইসউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:২৪

রইসউদ্দিন আরিফ
দুনিয়ার অন্যান্য দেশের কথায় না গিয়ে, বাংলাদেশের মতো স্বাধীন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে অনেক দিন ধরেই আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে আছি। সেই বিভ্রান্তি দূর হলো, যখন কদিন আগে জানতে পারলাম স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর (২০২২ সালেও) বাংলাদেশের চা বাগান শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি পান ১২০ টাকা।
যেসব শ্রমিক চা বাগানে কাজ করেন, তারা নিশ্চয়ই যার যার পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ধরুন তাদের একেক জনের পরিবার ন্যূনতম সংখ্যায় চার সদস্যের। ওই চার সদস্যের পরিবার নিয়ে একজন চা বাগান শ্রমিক ১২০ টাকায় কীভাবে চলেন, তার হিসাব কষতে বসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অঙ্ক করলেও কোনোভাবেই যোগফল বের করতে পারবেন না আপনি। পাবেন শুধুই বিয়োগ ফল। আর সেটি কোনো খাতা-কলমের বিয়োগ ফল নয়, রক্ত-মাংসের মানুষের জীবনের বিয়োগ ফল। তাহলে বাংলাদেশের চা বাগান শ্রমিকরা তাদের জীবনের জন্য কোনো দিন যোগফল দেখতে পান না, দেখেন শুধুই বিয়োগ ফল। জীবনের বিয়োগ ফল মানে জীবনবিহীন জীবন।
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশটিতেও এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। এমনকি আজকের দিনে একজন শ্রমিকের দৈনিক ৩০০ বা ৫০০ টকার মজুরি পাওয়ারও কোনো নজির পাওয়া যাবে না কোথাও। আমাদের চা বাগান শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা যদি বলা যায়, তাহলে বাংলাদেশের মতো এমন অমানবিক আয়-বৈষম্যে ভরা পৃথিবীর কোথাও নেই। দেশের চা বাগান শ্রমিকদের উপর যুগ যুগ ধরে যে নিষ্ঠুর বৈষম্য ও বঞ্চনা চালানো হয়েছে তা নিঃসন্দেহেই বর্বরোচিত।
এখন প্রশ্ন হলো, দেশের হাজার হাজার চা বাগান শ্রমিকের কমপক্ষে চার-পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে, এমনকি আধ-পেটা খেয়ে-পরে জীবিত থাকার জন্যও মাসে কত টাকা মজুরি পাওয়া জরুরিভাবে দরকার? দশ হাজার টাকা? আট হাজার টাকা? পাঁচ হাজার টাকা? বিশ্বাস করুন, আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যের বাজারে পাঁচ হাজার টাকার নিচের কোনো অঙ্ক লেখার সাহস হলো না আমার। দেশের প্রায় ত্রিশ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক দেড় দশক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে এখন যে আট হাজার টাকা মজুরি পান, তা দিয়েও তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। তাদের বেঁচে থাকতে হয় জীবনযাপনের হিসাবের অঙ্কে মাইনাস নিয়েই। তাহলে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পাওয়া চা বাগান শ্রমিকদের অবস্থাটা একবার কল্পনা করুন।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, দেশের চা বাগান শ্রমিকরা এখন (২০২২ সালে) তাদের মজুরি বৃদ্ধির যে আন্দোলন করছেন, সেই আন্দোলনে অবিশ্বাস্যভাবে তারা দাবি করছেন দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির। মাসে পনেরো হাজার টাকা মজুরির দাবি তুললেও তা হয়তো হাস্যকর মনে হতো না। সে ক্ষেত্রে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি শুধু হাস্যকর নয়, এটি ধর্মতত্ত্বের হাবিয়া দোজখ থেকে যৎকিঞ্চিৎ কম আজাবের কোনো দোজখে ঠাঁই পাওয়ার দাবি। এ থেকেই বোঝা যায়, যুগ যুগ ধরে চরম বঞ্চনা ও নিগ্রহের স্টিমরোলার চালিয়ে চিড়েচ্যাপটা বানিয়ে চা বাগান শ্রমিকদেরকে এতটাই শোধ-বোধহীন ‘প্রাণীতে’ রূপান্তর করা হয়েছে যে, মানবেতর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যও তাদের কত টাকা মজুরি পাওয়া বিলক্ষণ জরুরি তার হিসাব-নিকাশ করার বোধশক্তিও তারা হারিয়ে ফেলেছে। আর এ সবকিছু ঘটেছে স্বাধীন-সার্বভৌম-গণতান্ত্রিক বলে দাবিকৃত একটি রাষ্ট্রের পঞ্চাশ বছরের সরকারের শাসনাধীনে। এমনকি তা ঘটেছে ‘মধ্যম আয়ের’ দেশের মাটিতে।
চা বাগান শ্রমিকদের নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবেই গণ্য করা হয়। তাদের ভোট দেওয়ারও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নিশ্চয়। রাষ্ট্রের সংবিধানে তাদের নাগরিক অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে বটে। কিন্তু তারপরও আজ বড় আকারের যে প্রশ্নটি ওঠে সেটি হলো, যে দেশে মনুষ্যসন্তান হয়েও এবং রাষ্ট্রের বিধিবদ্ধ নাগরিক হয়েও হাজার হাজার চা বাগান শ্রমিককে মানুষ নয়, প্রাণীসুলভ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, সেই দেশ স্বাধীন-গণতান্ত্রিক দেশ হয় কীভাবে?
রইসউদ্দিন আরিফ
লেখক ও গবেষক