Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সামাজিক নিরাপত্তা ও আমাদের সন্তান

Icon

বেগম জুবাইদা কাজী

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:২৭

সামাজিক নিরাপত্তা ও আমাদের সন্তান

বেগম জুবাইদা কাজী

আজকাল শহর বা গ্রামে সব জায়গায় শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে আত্মহননের মানসিকতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কখনো পরিবারের চাপে, কখনো শিক্ষকের অপরিমিত বোধের কারণে, কখনো বা সহপাঠীদের দুরাচারের কারণে।

বিষয়টি আমাদের মতো অভিভাবকদের জন্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তার। কয়েক বছর আগে ভিকারুননিসা স্কুলের এক ছাত্রী নিজের মা-বাবাকে শিক্ষকের সামনে অপমানিত হতে দেখে নিজের জীবন দিয়ে, এর প্রতিকার করতে চায়। আজীবনের জন্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়, অসহায় বাবা-মা। আবার চলমান সময়ে হলিক্রস কলেজের মেধাবী ছাত্রী শুধু একটা বিষয়ে ফেল করার কারণে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে।

এই মিলেনিয়াম যুগেও সেকেলে মানসিকতার কারণে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে পরিস্থিতি, স্বাভাবিক চিন্তা থেকে তা মেনে নেওয়া কঠিন। একজন অভিভাবক এবং মূলত একজন শিক্ষক হিসেবে আমরাও এর দায়বদ্ধতা এড়াতে পারি না। আমরা আমাদের সন্তানকে পারি না সামাজিক নিরাপত্তা দিতে, পারি না শিক্ষা শেষে সুন্দর ভবিষ্যতের আশ্বাস দিতে। ক্রমান্বয়ে হতাশাগ্রস্ত হই সামাজিক প্রেক্ষাপটের আঙিনায়, আর সেই হতাশাই ছড়িয়ে দেই আমাদের শিশুদের মধ্যে। আমাদের নিরাশার ক্ষেত্র তৈরি করে সমাজব্যবস্থা, আর আমরা তাকে পোক্ত করে দেই নিজের সন্তান আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এক পর্যায়ে তারাও ভাবতে বাধ্য হয়, শৈশব কৈশোরের সকল আনন্দ বিসর্জনের মধ্য দিয়েও সাফল্যের সুখ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

দোষটা কিছুটা আমাদেরও। কারণটা ব্যাখ্যার জন্য আমি ১৫-১৬ বছর আগের একটি কষ্টকে শেয়ার করছি।

মেয়েটির নাম পারভিন আক্তার, রোল ৩৬। আমার কলেজের একজন অতি সরল-সাদা মনের ছাত্রী। লজিক বোঝার জন্য সবসময় সামনের সারিতে বসতো। প্রতিদিন পড়া ধরি এবং প্রতিদিনই দাঁড়িয়ে থাকত। এতে ওর কোনো দুঃখ ছিল না। ও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকত এবং পিছনে ঘুরে দেখত আর কে কে ওর মতো পড়া বলতে না পেরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে দেখতাম ডায়াসের উপর এসে বসে আছে, জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘ম্যাডাম, সামনে এসে বসলে পড়া বুঝব, ভালো করে মুখ দেখতে না পেলে পড়া বুঝি না।’ ওকে লজিক বোঝাতে আমাকে সত্যিই হিমশিম খেতে হয়েছিল। ইংরেজিতে ও ছিল খুব কাঁচা। টেস্টে যা করে হোক ইংরেজি ছাড়া আর সব বিষয়েই পাস করে যায়। তাই তার অভিভাবককে ডেকে বলেছিলাম ইংরেজির অবস্থা খুব খারাপ, বোর্ডে ফেল করলে ইংরেজির জন্যই করবে। মেয়েটির বাবা ছিল না। বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। আর ছিল বড় ভাই, যে বাবার ভূমিকা পালন করত। সেই তাকে ভয় দেখায় ইংরেজিতে ফেল করলে পড়াশোনা বন্ধ করে দিবে। ফেয়ারওয়েলের দিন মঞ্চে উঠে মেয়েটি সব শিক্ষকের কথা বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। লজিকের টিচারকে এই দুবছর ক্লাসে পড়া না শিখে যে যন্ত্রণা করেছে তার জন্য ক্ষমা চায়। মঞ্চে ওর কান্নায় ভেঙে পড়া বক্তব্য শুনে আমাদের অনেকেরই চোখ ভিজে যায়, সেই শেষ আর দেখা হয়নি।

বোর্ডে পরীক্ষা শুরু হয়। সেদিন ছিল ইংরেজি পরীক্ষা। যে ইংলিশ ছিল মেয়েটির কাছে সাক্ষাৎ যমদূতের মতো।  পরীক্ষার আগের দিন সিলেবাস কমপ্লিট হয়নি, তাই পাস করতে পারবে না, এই ভেবে পরীক্ষা না দেওয়ার ফন্দি বের করে। ওর  ছোট্ট মাথা থেকে হয়তো এর চেয়ে ভালো কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। তাই ঘরে রাখা ইঁদুরের বিষ থেকে খানিকটা খেয়ে নেয়। ভেবেছিল আপাতত আসন্ন পরীক্ষা থেকে তো বাঁচি। কিন্তু যখন ভিতরের কষ্টটাকে আর নিতে পারছিল না, তখন ভাইকে জানায়, ‘ভাইয়া আমি মরতে চাই না, শুধু পরীক্ষার ভয়ে একটু খেয়ে ফেলেছি। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও, ভাই আমি বাঁচতে চাই, আমি মরে যাবার জন্য বিষ খাইনি।’

অসহায়, দিশেহারা বড় ভাই ছোট বোনকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটে আর চিৎকার করে কাদে, ‘তোর পাস করতে হবে না বোন, তুই শুধু বেচে থাক।’ কিন্তু মেয়েটি কি জানত, বেঁচে থাকার জন্য কতটা বিষ হজম করতে হয়?

নিজের কষ্টকে পরিমাপ করতে পারলেও, বিষের ক্ষমতা পরিমাপের জ্ঞান ওর ছিল না। তাই হয়তো ভাইয়ের আর্তনাদ আর মায়ের বুক ফাটা কান্নাও আর মেয়েটিকে ফেরাল না।

সকালে যখন কলেজে এই ছাত্রীর আত্মহত্যার খবর সহপাঠীদের মধ্যে চাউর হয়ে যায়, তখন আমার শুধু একটাই কথা মনে হয়, আমাদের ভুল কতটা? আমরা ওকে শুধু পাসের মূল্য বোঝাতে পেরেছি, জীবনের মূল্য বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। ধিক্কার কি দিব না আমাদের এই মূল্যবোধহীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে, আমাদের অসুস্থ মানসিকতাকে?

আমরা কি আমাদের সন্তানকে বোঝাই মানুষের মূল্য কতখানি? মানুষ কী, মানুষ- মানুষ হয় কী দিয়ে? আগে নিজেকে বোঝাই, আমরা কী বলতে চাই, কী বোঝাতে চাই আর নিজেই বা কী বুঝি? যাদের ঘিরে আমাদের সব স্বপ্ন, প্রকারান্তরে তাদের সেই স্বপ্নকেই হত্যা করছি না তো?


লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫