Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

আকবর আলি খান : জনমানুষের কণ্ঠস্বর

Icon

নাসরিন আখতার

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪:২৩

আকবর আলি খান : জনমানুষের কণ্ঠস্বর

নাসরিন আখতার

এককথায় তাঁর পরিচয় দেওয়া আসলে কঠিন। আমলা ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, অর্থনীতির নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কাজ করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, গবেষণা করেছেন, সর্বোপরি ছিলেন বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক। নানা দল আর মতে বিভক্ত এই দেশে সবসময় জনস্বার্থমুখী কাজ করে যাওয়া এই লেখক, অধ্যাপক ও গবেষক হলেন ড. আকবর আলি খান।

গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে অনন্তের পথে যাত্রা করেন তিনি। কোভিড ও কোভিড-পরবর্তীকালে আমাদের দেশের বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের চলে যাওয়ার দীর্ঘ মিছিলে শামিল হলেন তিনিও।

গ্রামের এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে পড়াশোনা, অধ্যবসায় ও সততার বিরল উদাহরণ তৈরি করেন আকবর আলি খান। সকল পরিস্থিতিতে সত্য বলার যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন, আমাদের সময়ে তা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই কেবল নয়- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলে দেখা যায়, তিনি কী গভীর প্রভাব রেখে গেছেন এই প্রজন্মের মধ্যে। শুধু সততা ও সত্য বলার সাহসই নয়, অর্থনীতির মতো একটি নীরস বিষয়কে সরস ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এই প্রজন্মের কাছে তাকে করে তুলেছেন আকর্ষণীয়। 

আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে। ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, পিএইচডি করেছেন অর্থনীতিতে। আমলা হিসেবে পেশাজীবন শুরু করলেও পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন। অবসর নিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে। এরপর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিবন্ধকতার মুখে পদত্যাগও করেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ ওই সময়ের উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ছিল, যদিও এখন তা অনালোচিতই থেকে যায়।

তিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন। সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। তবে আজ লেখক আকবর আলি খানকে নিয়েই মূলত আলোচনা করব। মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসরের পরই তাঁর আবির্ভাব ঘটে পূর্ণকালীন লেখক হিসেবে। তখন তাঁর ৫২ বছর বয়স। তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন লেখক হতে চাননি, পাঠকই থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু বিচিত্র বিষয়ে পড়তে পড়তে কিছু বিষয় নিয়ে নিজের যেসব বক্তব্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, পাঠকদের সেসব জানানো; আর ভালো লাগা বইগুলোর ভাবনা নিজের মতো করে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা থেকেই তিনি লেখক হয়ে উঠেছিলেন। 

আকবর আলি খানের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৮। তিনি গল্প, উপন্যাস বা কবিতা লেখেননি; যা লিখেছেন সবই প্রবন্ধ। সুনির্দিষ্ট করে বললে গবেষণা প্রবন্ধ। তাঁর  প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ডিসকভারি অব বাংলাদেশ, দারিদ্র্যের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, পরার্থপরতার অর্থনীতি, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি, অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন, দুর্ভাবনা ও ভাবনা : রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এবং বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি। তাঁর লেখা গবেষণা প্রবন্ধের প্রতিটি বই বিপুলভাবে পাঠকপ্রিয়। দীর্ঘ সময়ে গবেষণা ছাড়া কোনো বইই তিনি লেখেননি। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বই ‘পুরানো সেই দিনের কথা’র পাঠকপ্রিয়তার প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি নিজেও অবাক হয়ে গেছি, কারণ, আমার ধারণা ছিল যে এই বইয়ের পাঠক পাওয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেছেন, তবে আমার মনে হয়, পাঠক সত্য কথা খোঁজে। তাদের কাছে হয়তো মনে হয়েছে যে আমি কোনো কিছু বানিয়ে লিখিনি। কোথাও মুনাফেকি করিনি।

কিশোর বয়সে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা দারুণ আগ্রহভরে পড়েছেন আকবর আলী খান। যার প্রভাব তাঁর লেখার মধ্যেও পড়েছে। তাঁর অনেক গবেষণাগ্রন্থও তাই লেখা হয়েছে রম্যরচনার ঢঙে। এই ঢঙটিই তাঁর লেখাকে সাধারণ পাঠকের কাছে নিয়ে গেছে। যেমন তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইটিতে প্রতিটি জটিলতত্ত্বের সহজ ও রসালো উপস্থাপন পাঠককে মুগ্ধ না করে পারে না। বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো অর্থনীতির মতো জটিল বিষয়কে অত্যন্ত সহজবোধ্যভাবে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে উপস্থাপন করা। 

আমলা থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর লেখা প্রথম বইটি ছিল ইংরেজি ভাষায় লেখা, ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হামটি ডামটি ডিসঅর্ডার, অ্যান্ড আদার এসেজ: রিফ্লেকশনস অন ইকোনমি অ্যান্ড গভর্নেন্স ইন বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রকাশ করেছিল ইউপিএল। পরের বছর প্রকাশিত হয় অন্ধকারের উৎস হতে : সাহিত্য, সমাজ, পরিবেশ ও অর্থনীতি সম্পর্কে আলোর সন্ধান নামের বইটি। পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত এ বইটির নির্দিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য- নানা প্রসঙ্গ ছিল এতে।

এরপর তিনি নির্দিষ্ট বিষয়কে থিম করে আরও ৯টি বই প্রকাশ করেছেন। সেসবের একটি ছিল ইংরেজিতে, বাকি আটটি বাংলায়। তিনি বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন। বনলতা সেনকে নিয়ে চিন্তার ফসল নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা প্রশ্ন আর নানা চিন্তা শুরু করেছিলেন সেই ১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে। যার পরিণতি দুর্ভাবনা ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। 

১৯৭৭ সালে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার সময় পুরনো যেসব আদমশুমারির প্রতিবেদন পড়েছিলেন, তারই সূত্র ধরে ইতিহাস নিয়ে তাঁর আরেকটি উল্লেযোগ্য বই বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। আরও বেশকিছু বই লেখার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। যদিও শেষের দিকে প্রায়শই আশঙ্কা প্রকাশ করতেন, এসব লিখে উঠতে পারবেন কি না। শেষ পর্যন্ত তাঁর আশঙ্কাই সত্য হলো। তাঁর মৃত্যুতে পাঠকেরা বঞ্চিত হলেন নানা বিষয় নিয়ে লেখা নতুন নতুন বই পাঠ থেকে। যখন দেশে সত্য বলার মানুষের বড় অভাব, তখন তিনি সাহস করে সত্য বলতেন। কে কী ভাবলেন, পরোয়া করতেন না। এমন একটি সময়ে তাঁর প্রস্থান জনমানুষের এক কন্ঠস্বরই যেন নিরব হয়ে যাওয়া। 

তাঁর একেকটি বই লেখার কাজ এগিয়েছে অত্যন্ত কঠিন একটি প্রক্রিয়ায়। একজন তাঁর কথাগুলো রেকর্ড করে শ্রুতি লিখন করতেন। এরপর তিনি সেটা দেখে দিতেন। শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও তিনি এভাবে লেখালেখির কাজ এগিয়ে নিয়েছেন, কেবল দৃঢ় মনোবল ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির জন্য। তিনি ছিলেন জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য- যে কোনো বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলে সহজ ভাষায় সেসব বুঝিয়ে দিতেন।

ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় রাজনীতির সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে থেকে একজন সরকারি কর্মকর্তার অতিগুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কী করে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হয়, তিনি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সারাজীবন সহজ সরল ও সৎভাবে জীবন যাপন করে গেছেন এবং সাধারণ মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাই সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় তিনি উচ্চারিত হবেন বারবার। 

তাঁর প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।


লেখক: সহকারী সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫