Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

রবিউল আউয়ালের বার্তা

Icon

মাওলানা লিয়াকত আলী

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৫০

রবিউল আউয়ালের বার্তা

মাওলানা লিয়াকত আলী। ছবি: সংগৃহীত

হিজরি সালের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। এখন থেকে চান্দ্র হিসেবে ১৪৯৭ বছর আগে এই মাসে তাশরীফ এনেছিলেন আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ হাবীব মুহাম্মাদ (সা.)। মানবজাতিকে ইহ ও পরকালীন জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও সাফল্যের চূড়ান্ত নির্দেশিকা দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন মহান রব্বুল আলামিন।

মহানবীর (সা.) মাধ্যমে নবুওয়াতের ধারায় পরিসমাপ্তি হয়েছে। এর পরে আর কোনো নবী রাসূল আগমনের অবকাশই নেই। মানব জাতির প্রতি আল্লাহ তাআলার হিদায়াতের নিয়ামত পরিপূর্ণ হয়েছে মহানবীর (সা.) প্রেরণ ও তাঁর প্রতি কুরআন মজীদ নাযিলের মাধ্যমে। মহানবীর (সা.) বিদায় হজের সময় আরাফার দিনে সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতটি নাযিল হয়। তাতেও এই ঘোষণা দেওয়া হয়। আল্লাহপাক বলেন, আজ আমি তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতের পূর্ণতা সাধন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসাবে মনোনীত করলাম।’

মহানবী (সা.) যখন দুনিয়াতে আগমন করেন, তখন আরবসহ গোটা পৃথিবী ডুবে ছিল অসভ্যতা ও অনৈতিকতার ঘোর অমানিশায়। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়েও তারা মাথাকে অবনমিত করত জড় পদার্থের সামনে। যে মহান স্রষ্টা মানুষসহ পৃথিবীর সব কিছুর মালিক, দিশেহারা মানব সমাজ তাঁর কথা ভুলে আশ্রয় প্রার্থনা করত নশ্বর বস্তুর কাছে। মানবাধিকার বলতে কিছুই ছিল না। জোর যার, মুল্লুক তার এই ছিল সাধারণ রীতি। বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার রাজ্যে বাস করছিল মানুষেরা। আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.) যে দীন নিয়ে এসেছিলেন, তারই আওলাদ কুরাইশ বংশ গ্রহণ করেছিল পৌত্তলিক ধর্মের রীতিনীতি। মহানবী (সা.) দুনিয়াতে এলেন মানব জাতিকে সকল প্রকার পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করার জন্য।

৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) ওহীপ্রাপ্ত হয়ে সত্য ধর্ম প্রচার শুরু করেন। আরবের পৌত্তলিক কাফেররা মহানবীর (সা.) আহ্বানে সাড়া তো দিলই না, বরং তাঁর ওপর নির্যাতন শুরু করে দিল। অবশেষে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজ দেশ ত্যাগ করে মদীনায় চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু তাই বলে তিনি কুরাইশদের ওপর প্রতিশোধ নেননি। মদীনায় গিয়েও যখন তিনি বারবার কাফেরদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিলেন, তখন তিনি কেবল প্রতিরোধই করে যাচ্ছিলেন। তিনি সকল প্রকার সংকীর্ণতা দূরীভূত করে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্ব মৈত্রী ও বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন। এই ভ্রাতৃত্ব দেশ, কাল, বর্ণ, বংশ, ভাষা ও গোত্রীয় সংকীর্ণতার অনেক ঊর্ধ্বে।

মহানবী (সা.) যে মাসে দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছিলেন সেই রবিউল আউয়াল মাসে আমাদের করণীয় হবে নবী করীমের (সা.) জীবনাদর্শ সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং সে মোতাবেক জীবন গঠন ও পরিচালনার অঙ্গীকার করা। মহানবী (সা.) বলেন, আমি যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির নিকট তার পিতা, সন্তান ও সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হব, ততক্ষণ পর্যন্ত সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না। সাহাবায়ে কেরাম মহানবীর (সা.) প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁরা নবী করীমের (সা.) জন্য জীবন উৎসর্গ করতে কখনো কুণ্ঠিত ছিলেন না। মহানবী (সা.) তাঁর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার অর্থ নিজেই বলে দিয়েছেন। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালোবাসল, সে আমাকেই ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসল সে জান্নাতে আমার সাথে থাকবে। (তিরমিযী শরীফ)

সুতরাং নবী করীমের (সা.) সুন্নাত অনুসরণই হবে তার প্রতি অনুরাগের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যে নবী সারা জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ আগমন করেছেন, ধ্বংসের পাদপ্রান্তে উপনীত মানব জাতির মুক্তির পথনির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন, আমরা যদি সেই শ্রেষ্ঠ নবীর শাফায়াতে ধন্য হওয়ার লক্ষ্যে তাঁর জীবনাদর্শ কঠোরভাবে মেনে চলতে পারি, তাহলেই দোজাহানের অশেষ কল্যাণ ও অনাবিল শান্তি আমাদের জন্য অবধারিত। শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হয়ে আমরা যে সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছি, মাহে রবিউল আউয়ালে সে সৌভাগ্য অক্ষুণ্ন রাখার প্রতিজ্ঞা করা সমীচীন।

রাসূলের প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রথম ও প্রধান দাবি তার আনুগত্য ও অনুসরণ । এ ছাড়া আরও যেসব কর্তব্য বর্তায়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথমত তাকে নিজের জীবন, মাতাপিতা, সন্তান, পরিজনসহ সব মানুষ এবং সম্পদ ও সামগ্রীর চেয়ে ভালোবাসা। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার মাতাপিতা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হবো। (বুখারি ও মুসলিম শরীফ)

তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা তার প্রতি ভালোবাসা পোষণ করার অনিবার্য অনুষঙ্গ। ইরশাদ হয়েছে- তারা (মুনাফিকরা) তোমাদের কাছে আল্লাহর নামে শপথ করে তোমাদের সন্তুষ্ট করতে। অথচ তারা ঈমানদার হলে আল্লাহ ও তার রাসূলকেই সন্তুষ্ট করা তাদের জন্য বেশি উপযুক্ত ছিল। (সূরা তওবা, আয়াত ৬২)

দ্বিতীয়ত তার জীবদ্দশায় ও ইন্তেকালের পরে তাকে সম্মান করা ও মর্যাদা দেওয়া। ইরশাদ হয়েছে- রাসূলের সম্বোধনকে তোমাদের পরস্পরের সম্বোধনের মতো কোরো না। (সূরা নূর, আয়াত ৬৩) কেননা রাসূল একজন সাধারণ মানুষ নন। তিনি আল্লাহর রাসূল। এ জন্য মানুষের উচিত তাকে সম্মান করা ও মর্যাদা দেওয়া। এ জন্য তাকে নাম ধরে নয়, বরং ‘হে আল্লাহর রাসূল’ বা ‘হে আল্লাহর নবী’ বলে সম্বোধন করতে হবে।

তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি দিক হলো তার আগে কথা না বলা এবং তার সামনে কথা বলার সময়ে স্বর উঁচু না করা। ইরশাদ হয়েছে- হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহ ও রসূলের সামনে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন। হে মুমিনরা! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের ওপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু কোরো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বোলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা টেরও পাবে না। যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্যে শোধিত করেছেন। তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (সূরা হুজুরাত, আয়াত ১-৩)

তৃতীয়ত মহানবীকে (সা.) কোনোভাবেই ও কোনোমতেই কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম এবং তা একজন মুসলিমকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ইরশাদ হয়েছে- তোমাদের জন্য এ অধিকার নেই যে, তোমরা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেবে। (সূরা আহজাব, আয়াত ৫৩)

আর যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা তওবা, আয়াত ৬১)

আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়ার নিষিদ্ধতার আওতায় পড়বে তার পুণ্যবতী স্ত্রীগণকে নিয়ে কটাক্ষ করা, তাদের ব্যাপারে অশালীন উক্তি করা ও তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। 

চতুর্থত মহানবীর (সা.) ওপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা। ইরশাদ হয়েছে- নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনরা! তোমরা নবীর জন্য রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর। (সূরা আহজাব, আয়াত ৫৬)

তেমনি মহানবী (সা.)ইরশাদ করেছেন, সেই ব্যক্তি প্রকৃত কৃপণ, যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হয় অথচ সে আমার ওপর দরুদ পাঠ করে না। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে, তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন আল্লাহ।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা বৃদ্ধির একটি কার্যকর উপায় তাঁর জীবনী অধ্যয়ন। শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার প্রসারের সাথে সাথে আল্লাহর নবীর জীবনী ও জীবনাদর্শ বিষয়ক গ্রন্থ ও রচনা সহজলভ্য হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজিতে এখন মানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য সীরাতগ্রন্থের অভাব নেই। এসব গ্রন্থ অধ্যয়ন ও চর্চায় মনোযোগী হওয়া রবিউল আউয়ালের অন্যতম দাবি।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫