Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

প্রবারণা পূর্ণিমার তাৎপর্য

Icon

ভদন্ত করুণানন্দ থের

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৪৮

প্রবারণা পূর্ণিমার তাৎপর্য

ভদন্ত করুণানন্দ থের। ফাইল ছবি

প্রবারণার পালি শব্দ ‘পবারণ’। থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বে আশ্বিনী পূর্ণিমাকে ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ বলা হয়। এ প্রবারণা পূর্ণিমা থেরবাদী বৌদ্ধদের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ইতিহাসে এ পূর্ণিমার তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। 

বিশ্বের অপরাপর থেরবাদী বৌদ্ধদের মতো বাংলাদেশের সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী মহাসাড়ম্বরে মহামহিমান্বিত পূতপবিত্র এ আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমাকে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনসম্মত নানাবিধ বহু বর্ণিল অনুষ্ঠান সাঁজিয়ে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডায় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উদযাপন করেন। 

উল্লেখ্য, করুণাগণ ভগবান বুদ্ধ বিশ্ব পরিবেশ সুসংরক্ষণ ও জনকল্যাণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে আষাঢ়ী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে তাঁর শিষ্য ও শিষ্যা হিসেবে দীক্ষালব্ধ তাঁর অহিংস ধর্ম-দর্শনকে সার্বিক সুস্থিতিদানের লক্ষ্যে ও তাবৎ মানবজাতির মধ্যে মৈত্রী ও অহিংসার বাতাবরণে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুভাবিত চিত্ত ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘকে তিন মাস বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানপূর্বক নিজ নিজ বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডায় অবস্থান করার বিধান প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন। 

আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা হয়ে মধু পূর্ণিমা বা ভাদ্র পূর্ণিমা অতঃপর আজকের এ আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা হলো বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল। বুদ্ধের নির্দেশ হলো এই তিন মাস ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘ নিরবচ্ছিন্নভাবে ধ্যান-ভাবনায় নিরত থাকবে। Insight meditiation-এর মধ্য দিয়ে নিজ নিজ চিত্তের উৎকর্ষ বিধান করবে, যা চার স্মৃতি প্রস্থান: কায়ানুদর্শন, বেদানুদর্শন, চিত্তানুদর্শন ও ধর্মানুদর্শন। 

১) চার সম্যক প্রধান বা প্রচেষ্টা : চিত্তে উৎপন্ন পাপ বিনাশের প্রচেষ্টা, চিত্তে অনুৎপন্ন পাপ অনুৎপত্তির প্রচেষ্টা, চিত্তে অনুৎপন্ন পুণ্য উৎপত্তির প্রচেষ্টা এবং উৎপন্ন পুণ্য সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির প্রচেষ্টা।
২) চার ঋদ্ধিপাদ : ছন্দ, বীর্য, চিত্ত ও মীমাংসা।
৩) পঞ্চ ইন্দ্রিয় : শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা ইন্দিয়।
৪) পঞ্চ বল : শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা বল।
৫) সপ্ত বোধ্যঙ্গ : স্মৃতি, ধর্মবিনয়, বীর্য, প্রীতি, প্রশ্রদ্ধি, সমাধি ও উপেক্ষা।
৬) আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ : সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।  

মেত্তা, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা পরিপূর্ণ চর্চার মাধ্যমে নিজেকে প্রজ্ঞার পথে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ
1. Metta, loving kindness: goodwill and amity, the wish to help all people attain benefit and happiness.
2. Karuna, compassion: the desire to help other people escape from their sufferings; the determination to free all beings, both human and animal, of their hardships and miseries.
3. Mudita, appreciative gladness: when seeing others happy, one feels glad; when seeing others do good actions or attain success and advancement, one responds with gladness and is ready to help and support them.
4. Upekkha, equanimity: seeing things as they are with a mind that is even, steady, firm and fair like a pair of scales; understanding that all beings experience good and evil in accordance with the causes they have created; ready to judge, position oneself and act in accordance with principles, reason and equity. 

প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সীমায় একত্রিত হয়ে অসাবধানতাবশত যদি কোনো ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র দোষত্রুটি জীবন চলার পথে সংঘটিত হয়ে থাকে, তা পারস্পরিক ‘আপত্তি দেশনা’র মাধ্যমে পরিশুদ্ধ থাকার অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। তাঁরা ভিক্ষুসীমায় বসে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ পাঠ বা দেশনা করবে। ভিক্ষুগণ বর্ষায় তিন মাস বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন গবেষণা করবে। প্রত্যেক অমাবস্যা পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে সমাগত অষ্টশীল অধিষ্ঠিত উপোসথ ব্রতধারী পুণ্যপ্রত্যাশী ও দুঃখান্ত সাধনে বদ্ধপরিকর উপাসক-উপাসিকাদের  উদ্দেশ্য বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ওপর আকর্ষণীয় ভাষণের মাধ্যমে সদাসর্বদা তাঁদেরকে আত্মকল্যাণ, আত্মশুদ্ধিসহ পরকল্যাণব্রতে আত্মনিবেদিত থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করবেন। বস্তুত প্রতিনিয়ত ধর্মশ্রবণ, সশ্রদ্ধচিত্তে ধর্মকে তথা সত্য ধর্মকে অন্তরের অন্তস্তলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রাখার মধ্য দিয়ে প্রতিটি নরনারী ও ভিক্ষু-ভিক্ষুণীর যাপিত জীবনের পরতে পরতে নিয়মনিষ্ঠভাবে সত্য ধর্মকে প্রতিপালনের একটি জীবনচক্র বির্নিমাণের লক্ষ্যেই করুণাগণ তথাগত বুদ্ধের বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বিধানের একটি অনন্য সাধারণ মাঙ্গলিক প্রয়াস। কারণ তাঁর ধর্ম ‘শ্রবণ, ধারণ ও অনুশীলন’-এ তিনটি অপরিহার্য।

ভিক্ষুগণ ভক্তপ্রাণ বৌদ্ধদেরকে মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখা, ভাল কাজে উৎসাহিত করা, ভাল কর্মে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা, যেসব ভাল বা জ্ঞানের আগে বলা হয়নি, তা প্রকাশ করা এবং পরিশেষে স্বর্গ এবং নিবার্ণ, যাকে চিরস্থায়ী সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন - 

1. Enjoining them from evil actions.
2. Encouraging them in goodness.
3. Assisting them with kind intentions.
4. Making known to them tings not heard before.
5. Explaining and clarifying those things they have already heard.
6. Pointing out the way to heaven, teaching them the way to happiness and prosperity.

এক অবিচ্ছেদ্য Component বা পারস্পরিক সহায়তাকারী গঠনশৈলীর ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল ও বিন্যস্ত। 

এ পর্যায়ে এখানে প্রবারণা পূর্ণিমার তাৎপর্য ও ‘প্রবারণা’ শব্দটির অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য আলোচনার অবকাশ রাখে। এ প্রবারণা পূর্ণিমাতে থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বের ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংঘ বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করেন। অতঃপর এ পূর্ণিমা তিথিতেই করুণাগণ ভগবান বুদ্ধ তাবৎ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘকে গ্রামে-গঞ্জে, নগর থেকে নগরান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়ে পুণ্যপ্রত্যাশী জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তির প্রত্যাশী নর-নারীর মাঝে তাঁর সত্যাশ্রয়ী, মৈত্রী ও অহিংসার মহামন্ত্রের আলোকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চিরন্তন রূপরেখায় আকীর্ণ ধর্ম-দর্শন প্রচার করার বিধান দেন। ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও গৃহী নির্বিশেষে সকলকে তা মেনে চলার নির্দেশ দেন। 

করুণাগণ বুদ্ধ সারানাথের মৃগদাবে ‘ধর্মচক্র প্রবর্ত্তনের’ পর পঞ্চশিষ্য তাঁর নবাবিষ্কৃত ধর্ম-দর্শন পরিপূর্ণরূপে হৃদয়মঙ্গল করার মাধ্যমে দুঃখের মূলীভূত কারণ উপলব্দ হলে যশও তাঁর বন্ধুসহ বর্ষান্তে সর্বমোট ৬০ (ষাট) জন ধর্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত ভিক্ষুকে ধর্মপ্রচারে নিয়োজিত করেন। তিনি এভাবে নির্দেশ দেন ‘চরথ ভিকখবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’-ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, লোকের প্রতি পরম অনুকম্পা পরবশ হয়ে দিকে দিকে এই কল্যাণ ধর্ম প্রচার কর। দুজন একদিকে যেও না। তাঁর নির্দেশে ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায়’ শব্দবন্ধসমূহকে বুকে ধারণ করে সমগ্র জীবজগতের  কল্যাণার্থে আদি-মধ্য ও অন্তে কল্যাণযুক্ত ধর্ম বিতরণ করার জন্যে ভিক্ষুরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তারই ধারাবাহিতায় আজকের এ ২৫৫৯ বুদ্ধাব্দের আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমার পর থেরবাদী বৌদ্ধ বিশ্বের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ প্রবারণার মধ্য দিয়ে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পরপরই ধর্ম প্রচারে বের হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। বস্তুত বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পরদিন থেকেই প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডায় দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। যেসব বৌদ্ধ বিহারে ভিক্ষুসংঘ সাফল্যজনকভাবে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করার পরাকাষ্টা প্রদর্শনের প্রয়াস পাবেন, সেসব বৌদ্ধ বিহারে দায়ক-দায়িকাদের দ্বারা ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্য দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে সশ্রদ্ধচিত্তে ত্রিচীবর দান অত্যাবশ্যক। দায়ক-দায়িকাদের জন্য এ রূপ মহতী দানানুষ্ঠান সুসম্পাদন বিপুল পুণ্যদ্যোতক ও বটে। দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান চলবে আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস। একটি বিহার ও প্যাগোডায় বছরে একবার মাত্র এ পবিত্র দানানুষ্ঠান সুসম্পন্ন বা আয়োজন করা যায়। এটি ও বুদ্ধের বিনয়ের একটি সুবিবেচনাপ্রসূত প্রজ্ঞাপ্ত বিধান। 

এ পর্যায়ে এখানে প্রবারণা পূর্ণিমার ‘প্রবারণা’ হিসেবে বিধৃত শব্দটির তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে। পরম শ্রদ্ধেয় ‘শান্তরক্ষিত মহাথেরো’ মহোদয় কর্তৃক সংকলিত পালি বাংলা অভিধানে ‘পবারণা’ বা ‘প্রবারণা’ শব্দটির অর্থ উল্লেখিত রয়েছে যথাক্রমে নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি প্রভৃতি। তাই ‘প্রবারণ’ শব্দের অর্থ আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ, শিক্ষার সমাপ্তি অথবা ধ্যান শিক্ষার পরিসমাপ্তি বোঝায়। এখানে ‘প্রবারণা’ থেকে ‘প্রবারণ’ শব্দটি এসেছে। এখানে প্রবারণা হলো প্রকৃষ্টরূপে বারণ করা বিধায় ‘প্রবারণ’। অতএব, ‘প্রবারণা’ শব্দের আরো তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ হলো পরিতোষ, তৃপ্তি, সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত ও ঋণ পরিশোধ। অতএব, ‘প্রবারণা’ শব্দটি বারণ করা, নিষেধ করা, পরিত্যাগ করা, সমাপ্ত করা, অর্থে সমধিক প্রয়োগসিদ্ধ শব্দ হিসেবে বিবেচিত ও পরিগৃহীত। 

লেখক: অধ্যক্ষ, অতীশ দীপংকর মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স, বজ্রযোগিনী, মুন্সিগঞ্জ। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫