
আমীন আল রশীদ
রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে এমন সব বিষয় সামনে এসেছে, যা অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এই কলেজের আবাসিক হলে থাকতে গিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের কী ধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়; কী ধরনের সিট বাণিজ্য হয়; ছাত্রলীগের পদ পেতে এবং নেতৃত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে বিষোদ্গার ও কাদা ছোড়াছুড়ি হয় এবং সর্বোপরি এসব বিষয়ে কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা কী- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে সবকিছু মিলিয়ে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, ছাত্ররাজনীতি কারা করে, কেন করে এবং কার জন্য করে? ছাত্ররাজনীতির নামে এই সময়ে যা চলছে, সেটি শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখছে কি না? যদি না রাখে তাহলে এই ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ কী- এমন প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে সেইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক সবশেষ কেন ইডেন মহিলা কলেজ টক অব দ্য কান্ট্রি হলো?
সম্প্রতি ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন কমিটির সহ- সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসী।
এরপর রিভা ও রাজিয়ার উপস্থিতিতে জান্নাতুলকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৫ সেপ্টেম্বর ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের ২৫ নেত্রী ক্যাম্পাসে রিভা ও রাজিয়াকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এদিন বিকেলে রিভা তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের সময় একটি গ্রুপ তাকে লাঞ্ছিত করেন। এ সময় দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বেশ কয়েকজন আহত হন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৫ তারিখ দিনগত রাতে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। একই সঙ্গে এই কমিটির ১৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও বহিষ্কারের তালিকায় মূল অভিযুক্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম নেই।
অনেক দিন ধরেই সভাপতিকে নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম খবর আসছিল। আবাসিক হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেওয়া, প্রতিবাদ করলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিনা কারণে ছাত্রীদের মারধর ও গালমন্দ করা, হল থেকে বের করে দেওয়া, ব্যক্তিগত কাজে সাধারণ ছাত্রীদের ব্যবহার, সিট বাণিজ্য, ইডেন কলেজের পাশে ফুটপাতে বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে সরকারি কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট বাণিজ্য; সিট পাওয়ার জন্য দলীয় কর্মসূচিতে যেতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা; গণরুমে নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ আছে। কিন্তু ইডেন কলেজে এইসব অভিযোগ ছাপিয়ে গেছে সাধারণ ছাত্রীদেরকে অনৈতিক কাজে বাধ্য করানো। খোদ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বৈধ রুমের মেয়েরা উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর করার সময় সভাপতির অনুসারীরা তাদের ছবি তুলে রাখেন।
সেখান থেকে সুন্দরীদের বাছাই করেন। পরে বাছাইকৃত মেয়েদের রুমে নিয়ে হুমকি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কু- প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ তারা ওই মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করাতে চান।’ এই অভিযোগ যদি আংশিকভাবেও সত্য হয়, তারপরও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কারণ এটি শুধু রাজনীতি নয়, বরং নারী অধিকার এবং সামগ্রিকভাবে মানবাধিকারেরও পরিপন্থী।
কতজন ছাত্রী এই ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন, সেই সংখ্যাটি কোনোদিনও হয়তো জানা যাবে না। কিন্তু সেটি যদি খুব সামান্যও হয়, তারপরও এটি পুরো ইডেন কলেজ এবং এই কলেজের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জন্য অবমাননাকর। অভিভাবকদের জন্য তো বটেই। বিশেষ করে যাদের সন্তানরা এই কলেজের আবাসিক হলে থেকে পড়াশোনা করেন, তাদের মনে নতুন করে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা তৈরি হলো। ভবিষ্যতে ইডেন কলেজের হলে রেখে সন্তানকে পড়ালেখা করানোর আগে অভিভাবকরা হয়তো ১০ বার ভাববেন। অর্থাৎ এই একটি অভিযোগ ইডেন কলেজের সব ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল অতীত ম্লান করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
প্রশ্ন হলো কাদের কারণে দেশে নারী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই কলেজটি সারা দেশের মানুষের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হলো? সহজ উত্তর, যাদের কারণে ইডেন কলেজ এবং এর সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক অভিভাবক অসম্মানিত হলেন, তারা কথিত ছাত্রনেতা। এখন প্রশ্ন হলো, তারা কী রাজনীতি করেন, কার রাজনীতি করেন এবং কেন করেন?
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। সেটি ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত। কিন্তু সেই ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ মূলধারার দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে ঢুকে এখন শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকারের চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার দলীয় রাজনীতিই মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
অর্থাৎ শিক্ষাঙ্গনে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো মূলত মূল দলের ক্যাম্পাস শাখা হিসেবে সেখানে আধিপত্য বিস্তার; প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনকে ঠেঙানো এবং নানা ধরনের চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহৃত হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, গণতান্ত্রিক উপায়ে নেতৃত্বের বিকাশ এবং সর্বোপরি দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। বরং এখানে আনুগত্য কেবল মূল দলের নেতাদের প্রতি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্ররাজনীতি পরিণত হয়েছে ‘ভাই’য়ের রাজনীতিতে। সংগঠনের মধ্য একাধিক গ্রুপ। একেকটি গ্রুপ একেকজন বড় ভাইয়ের আশীর্বাদপুষ্ট। আগে যেমন সবার কেবলা ছিলেন একজন। এখন সেখানে কেবলা বহুধাবিভক্ত। যে কারণে দেখা যায় নিজেদের মধ্যেই কোন্দল। উপরন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের ওই অর্থে কোনো আধিপত্য বা প্রভাব না থাকায় এখন তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
যে ছাত্ররাজনীতিকে বলা হয় ভবিষ্যৎ নেতা তৈরির প্রশিক্ষণকেন্দ্র, সেখানে এখন চাঁদাবাজি, সংগঠনের পদ ও হলের সিট বাণিজ্যসহ নানাবিধ অনৈতিক পন্থায় কোটিপতি হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। অর্থাৎ নেতা হতে পারলেই যেহেতু কোটি কোটি টাকা, অতএব সেই নেতা হওয়ার জন্যও এখন ‘ইনভেস্ট’ করতে হয়। ফলে যার যা আছে, তিনি সেটিই ইনভেস্ট করেন।
ছাত্ররাজনীতি এখন একটি ব্যবসা- অধিকারভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যার দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে এই রাজনীতির কাছ থেকে মানুষ ও দেশ কী প্রত্যাশা করবে? এই নেতারা দেশকে কী দেবেন? দেশ বড় কোনো সংকটে পড়লে একসময় যেমন ছাত্রদেরকে সংগঠিত করে নেতারা আন্দোলন গড়ে তুলতেন, এখন তারা দেশের সংকটে কী করবেন? তারা হয় ওই সংকটে গা ঢাকা দেবেন, কিংবা সংকটের অংশ হয়ে যাবেন। এভাবে কথিত ছাত্ররাজনীতির নামে যে পুরো একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া খুব সহজ নয়।
বড় দলগুলোর বাইরে অপেক্ষাকৃত ছোট, বিশেষ করে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় এবং দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সোচ্চার থাকলেও তাদের কণ্ঠস্বর এতই ক্ষীণ যে, সেটি বড় দলগুলোর বিতর্কিত ও পচে যাওয়া নেতাকর্মীদের উচ্চস্বরের নিচে চাপা পড়ে যায়। ফলে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে একটা সময়ে দেশের মানুষ যে গর্ব করত, সেই গর্বের বিষয়টি ফিকে হতে হতে এখন এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, ছাত্ররাজনীতি শব্দটা এখন একটি নেতিবাচক শব্দে পরিণত হয়েছে-যা দেশের জন্য বিরাট অশনি সংকেত।
রাজনীতি করার অধিকার যে কোনো নাগরিকেরই রয়েছে। সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের তো বটেই। কিন্তু রাজনীতির নামে ক্যাম্পাসগুলোতে যে দুর্বৃত্তায়ন ফুলেফেঁপে উঠেছে, তা থেকে নিশ্চয়ই সাধারণ শিক্ষার্থীরাও মুক্তি চান। মনে রাখা দরকার, রাজনীতি সচেতনতা আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আলাদা জিনিস।
যদি রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদেরকে প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ না করে, যদি ছাত্রদের মধ্যে ভোগবাদিতা প্রবল হতে থাকে, যদি মেধাবীদের রাজনীতিতে আসার মতো পরিবেশ তৈরি না হয়, তাহলে একটা সময়ে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি এমনকি ছাত্ররাজনীতি বন্ধেরও দাবি উঠবে- যা দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেবে। অতএব যারা দেশ পরিচালনা করেন, যারা নীতিনির্ধারণ করেন, সেই রাজনীতিবিদদেরকেই আগে ঠিক করতে হবে, তারা ছাত্ররাজনীতিকে কেমন দেখতে চান?
ছাত্রলীগ এখন যেভাবে বিতর্কিত হচ্ছে, সেগুলো কি আওয়ামী লীগকে বিব্রত করছে না? বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও এই ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। তিনিও ছাত্রলীগ করতেন। ১৯৬৬- ৬৭ সালে ছাত্রলীগ থেকে ইডেন কলেজ ছাত্রসংসদের সহ- সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আজকে তার সেই স্মৃতিবিজড়িত কলেজটি যে ছাত্রলীগের কিছু নেতার কর্মকাণ্ডের কারণে সারা দেশের মানুষের কাছে বিতর্কিত ও অসম্মানিত হলো, এই ঘটনা তাকেও কি বিব্রত করছে না? তিনিও কি কষ্ট পাচ্ছেন না?