Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন

Icon

রাইসুল সৌরভ

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২২, ১২:১৬

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন

রাইসুল সৌরভ। ফাইল ছবি

ফেসবুকে ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা সরাসরি সম্প্রচারের পরপরই দুনিয়াজুড়ে অনলাইনে প্রদর্শনযোগ্য বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে আইন তৈরিতে জনমত তীব্র রাজনৈতিক গতি পায়। এর আগে বৈশ্বিক সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো সাধারণত তাদের নিজস্ব নীতিমালার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় অবৈধ ও ক্ষতিকর আধেয় অপসারণ করত এবং এ কাজে সাধারণত তারা ‘এআই’ প্রযুক্তি ও ব্যবহারকারীদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নিত। তবে ক্রাইস্টচার্চ হামলা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে স্বেচ্ছায় গৃহীত ব্যবস্থা থেকে বাধ্যতামূলক আইনি হস্তক্ষেপে যেতে বাধ্য করেছে।

গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী ৪০টিরও বেশি নতুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আধেয় নিয়ন্ত্রণ আইন গৃহীত হয়েছে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে এই মুহূর্তে আরও অন্তত ৩০টি আইন প্রণয়ন সক্রিয়ভাবে বিবেচনাধীন রয়েছে। এই আইনগুলোর মূল লক্ষ্য হলো অনলাইন সেবাপ্রদানকারীদের তাদের প্ল্যাটফর্মের বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ আইনগত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা এবং অনলাইনে চরমপন্থা প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার রোধ করা। এই আইনসমূহ অবৈধ এবং ক্ষতিকারক কিন্তু সরাসরি অবৈধ নয় এমন উভয় ধরনের আধেয় নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

অবৈধ আধেয় বলতে ঘৃণাত্মক বক্তৃতা, সহিংসতার প্ররোচনা, শিশু নির্যাতন, প্রতিশোধমূলক পর্নো প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করে। অপরদিকে ক্ষতিকারক আধেয় বলতে এমন সব তথ্যকে বোঝায় যা সরাসরি বা কঠোরভাবে আইনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না; কিন্তু সমাজে এটির যথেষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে; যেমন: অনলাইনে আত্ম-ক্ষতি চিত্রিত করা, আত্মহত্যার চেষ্টা তুলে ধরা, সাইবার বুলিং, ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন ইত্যাদি।

ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পরপরই অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট ২০১৯ সালের মার্চ মাসেই তাদের The Criminal Code Amendment (Sharing of Abhorrent Violent Material) Act প্রণয়ন করেছিল। উক্ত আইনটি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে দ্রুত অবৈধ এবং ক্ষতিকারক আধেয় অপসারণ করতে বাধ্যকরী আইনি দায় আরোপ করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সাধারণত ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা) আধেয় সরাতে ব্যর্থ হলে কোম্পানির বার্ষিক লাভের ১০% পর্যন্ত জরিমানা ও কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রেখেছে। পুনরায় ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়া তার ব্যবহারকারীদের জন্য অনলাইন জগৎ আরও নিরাপদ করতে নতুন আরও একটি স্বকীয় অনলাইন নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে; যা বিশ্বে প্রথম শিশুদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও সাইবার অপব্যবহার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

অনুরূপভাবে; জার্মানি, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), তুর্কিয়ে, ব্রাজিল, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়বস্তু (আধেয়) নিয়ন্ত্রণে অনুরূপ আইন পাস করেছে, না হয় আইন পাসের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে এ সকল আইনের অধীনে বিশ্বব্যাপী একটি চলমান বিতর্ক রয়েছে যে বিচার বিভাগ নাকি তৃতীয় পক্ষ বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানি কোন বিষয়বস্তু বৈধ নাকি অবৈধ তা নির্ধারণ করবে? কারণ দুনিয়াজুড়ে অনলাইন নিরাপত্তা আইনের সাম্প্রতিক প্রবণতা হলো বিচার বিভাগকে এড়িয়ে বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর বিষয়বস্তুর বৈধতা মূল্যায়ন করার ভার অর্পণ করা। তথাপি এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আলোচ্য আইনসমূহ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং তাদের অবৈধ ও ক্ষতিকারক আধেয়ের বিরুদ্ধে নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে স্বচ্ছ বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি এবং ব্যবহারকারীদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিপূর্ণ আইনি কাঠামো প্রদান করেছে। যার ফলে এখন আর স্বেচ্ছাচারীভাবে কারও মত বা প্রকাশভঙ্গি পছন্দ না হলে তা মুছে ফেলা যাবে না বরং আইন অনুমোদন করলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।

অপরদিকে আইনি কাঠামো থাকার ফলে সন্ত্রাসবাদ উসকে দেয় এমন বা ক্ষতিকর আধেয় সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তবে একথাও সত্য যে, এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলোর বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করার এবং সেন্সরশিপ আরোপের মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। কারণ প্রতিটি আইনেই সত্যিকারের ভয় রয়েছে যে অনেক হোস্টিং সেবাপ্রদানকারী কোম্পানি ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম শাস্তি ও আইনি দায়বদ্ধতা এড়াতে বিষয়বস্তুর ক্ষতিকর দিক প্রকৃতভাবে মূল্যায়ন না করেই সরকারি সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই বিষয়বস্তু সরিয়ে ফেলতে পারে। উপরন্তু এ দায়িত্বে স্বাধীন বিচার বিভাগকে পাশ কাটিয়ে বেসরকারি প্রযুক্তি সংস্থার অন্তর্ভুক্তকরণ সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিন্নমত সীমাবদ্ধ করার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

এদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বাড়লেও অদ্যাবধি বেআইনি ও ক্ষতিকর আধেয় নিয়ন্ত্রণে কোনো নির্দিষ্ট আইন করা হয়নি। যদিও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে কিছু বিতর্কিত আইন; যেমন: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, আইসিটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে; তথাপি সে সকল আইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেআইনি ও ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটেও উপযোগী ও যথেষ্ট নয়।

এখন বাংলাদেশ মূলত নির্দেশ এবং নিয়ন্ত্রণ (কমান্ড ও কন্ট্রোল) পদ্ধতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার অবৈধ ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করছে। যেখানে সরকার এবং আদালত উভয়ই টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থাকে যে কোনো বিতর্কিত (যার কোনো আইনি মানদণ্ড নেই) বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অপসারণ করতে বা বাংলাদেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট লিঙ্কে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়ার নির্দেশনা জারি করে। সুতরাং এ ভূখণ্ডে বেআইনি এবং ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু নির্ধারণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার মানদণ্ডের অভাবে সংবিধান কর্তৃক রক্ষিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মতের বহুত্ব এবং ভিন্নমতকে সীমিত করার প্রকৃত ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আধেয় নিয়ন্ত্রণের জন্য২০২১সালে একটি খসড়া প্রবিধান প্রকাশ করে। তবে বিটিআরসি কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রবিধানের সঙ্গে ভারতের তীব্র সমালোচিত Indian Information Technology (Intermediary Guidelines and Digital Media Ethics Code) Rules, 2021-এর প্রভূত মিল রয়েছে, যা ইতোমধ্যে ভারতে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া।

খসড়া প্রবিধান প্রকাশের পরপরই এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা পরিপন্থী মর্মে অধিকারকর্মী ও বাংলাদেশের সুশীল সমাজ কর্তৃক ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। উক্ত খসড়া প্রবিধানে এমন অনেক অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট শব্দমালা রয়েছে যেগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রবিধানে দেওয়া নেই; যেমন: দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা বা নিরাপত্তা, শালীনতা বা নৈতিকতা, বিদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বা মানহানি। সঠিক ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞার অভাব এবং অপরাধ গঠনের উপাদানগুলোর অজ্ঞতা মতামত প্রকাশের জন্য একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করবে। কারণ এর আগে এদেশে জনগণকে জেলে পাঠানোর জন্য এই শব্দমালার অযৌক্তিক ব্যবহারের বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে।

আবার খসড়ায় বার্তা পরিষেবা প্রদানকারীর মতো মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে (যেমন: মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ প্রভৃতি) ব্যবহারকারীদের বার্তার গোপনীয়তা উন্মুক্ত করতে এবং বার্তার প্রথম প্রেরককে খুঁজে বের করে তার সম্পর্কে তথ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে, যা নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে নাগরিকের যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

সুতরাং এই খসড়া প্রবিধানের মাধ্যমে বিটিআরসিকে এই ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে তার যথেচ্ছ ব্যবহারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উল্লিখিত প্রবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে আরও বেশ কিছু সুযোগ রয়েছে, যা সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করতে পারে। 

তাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড, প্রতিষ্ঠিত সর্বোত্তম চর্চা নিশ্চিতকরণ এবং কারও অধিকার লঙ্ঘন না করে দেশবাসীর জন্য নিরাপদ অনলাইন পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সরকারের উচিত নতুনভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ আইন তৈরি করা। যাতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও রক্ষা পায় আবার অন্যদিকে অনলাইনে অবৈধ ও ক্ষতিকর আধেয় যৌক্তিক ও আইনগতভাবে অপসারণ করা যায়।

সহকারী অধ্যাপক ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫