Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সংখ্যালঘু সমস্যা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

Icon

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২২, ১২:৩২

সংখ্যালঘু সমস্যা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

শেখর দত্ত। ফাইল ছবি

কলামটা যখন শুরু করছি, তখন সিত্রাং-এর কারণে আকাশ মেঘলা, যদিও বৃষ্টি নেই। পায়রাগুলো রোজকার মতো ঘুরছে। অনেকের মতো আমারও ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মানুষের কতটুকু কষ্ট হচ্ছে ভেবে, রাতে বার বার ঘুম ভেঙে গেছে। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই নিউজ শুনলাম, পড়লামও। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে ঘূর্ণিঝড় ব্যাপক ক্ষতিসহ ৩৫ জনের প্রাণ নিয়ে গেছে।

দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ ফিরতে শুরু করেছে, যাতায়াত স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বিপদসংকেত কমেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ও কষ্টে পড়া মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে ঘূর্ণিঝড় শান্ত হওয়ার খবরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয়ে এলো।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে। সক্ষমতা মূলত দুই দিক থেকেই হয়েছে। একদিকে সচেতনতা- সতর্কতা বেড়েছে, অন্যদিকে মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বাড়ায় বাড়িঘরের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। দেশ- বিদেশের সহায়তায় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা যে সক্ষমতা অর্জন করেছি, তা বিশ্বেও উদাহরণস্থানীয়। স্বাধীনতা আমাদের এই সুযোগ করে দিয়েছে, আমরা সাধ্যমতো সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি।

সব সুযোগের কি সদ্ব্যবহার করতে পেরেছি? সিত্রাং-এর রুদ্ররূপী আকাশের পর আজকের মেঘলা- বৃষ্টিস্নাত- শান্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে দুর্ভাগ্যপীড়িত চিত্তে ভাবলাম, স্বাধীনতা যে সুযোগ এনে দিয়েছিল, সব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে আমরা তা ব্যবহার করতে পারিনি। 

‘সাম্প্রতিক দেশকাল’ সাপ্তাহিকের সম্পাদকীয় বিভাগের নাসরিন আখতার মাসে দুইবার টেলিফোন করে মনে করিয়ে দেন, লেখা দিতে হবে। এবার তিনি যখন টেলিফোন করছিলেন, ঠিক তখনই ফেসবুকে দেখছিলাম, হিন্দু- বৌদ্ধ- খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে ধর্মীয়- জাতিগত সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার একটি প্রেস রিলিজ। সঙ্গে ওই সংগঠনের একটি পোস্টার।

বিগত নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন হয়নি। সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য ২২ অক্টোবর ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা সারাদেশে গণঅনশন কর্মসূচি পালন করা হবে। 

এর আগে ১৭ অক্টোবর ঈদে মিলাদুন্নবী পালন উপলক্ষে ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং একটি মানবিক বিশ্ব’ আলোচনা অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর বক্তৃতা পড়ে কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাই টেলিফোন পেয়েই ভাবলাম, এই সপ্তাহের কলামে সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি আর প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু লিখবো। আরো একটি কারণ এখানে লিখতেই হয়। উল্লেখিত দিনগুলোতে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস’ (প্রকাশিতব্য) বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের রাষ্ট্রপতি সাত্তারের আমলের অংশটি প্রুফরিডারকে দেওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার পড়ে সংশোধন করছিলাম।  

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ১৯ জুলাই ১৯৮১ স্বাধীনতার পরও থেকে যাওয়া অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আমিনুল হকসহ (প্রয়াত) নেতৃবৃন্দ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। নেতৃবৃন্দ বলেন, এই ‘আইন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে ১৯৭৭ সালের মে মাসে জারিকৃত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনামা।’

এই আইন “জাতীয় মর্যাদা ও মানবিক রীতিনীতির পরিপন্থী এবং এই আইনের বলে ‘স্বার্থান্বেষী আমলা ও তহশীলদারদের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের ফলে’ সংখ্যালঘুরা আজ নিজ দেশে পরবাসী।” তাঁরা বলেন যে, ‘এতদিন আমরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুখ চেয়েছিলাম, এখন সরসারি আমরাই আন্দোলনে নেমেছি।’ আজ এতদিন পর ভাবি ইতিহাস দেখিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট ও বিকৃত হয়ে নাগরিকদের একাংশের জন্য আইন নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।....

ইতিহাসের দিকে আরো একটু ফিরে তাকাই। ওই নির্বাচনের আগে সরকারের সহযোগিতায় আদিবাসী কল্যাণ ফেডারেশনের উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মতো ৩০টি সম্প্রদায়ের প্রায় আড়াই হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আদিবাসী উপজাতীয়দের সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতারা দুঃখ- দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে অভিযোগের সুরে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় একদিকে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ গ্রহণ না করে নিপীড়ন ও সামরিক সমাধানের পথ গ্রহণ করে আর অন্যদিকে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় জোরপূর্বক বসতি স্থাপন করে পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে।

এর ফলেই অশান্ত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।’ সম্মেলনের প্রধান অতিথির ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার বলেন, ‘এ দেশে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। ... জাতির আশা- আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আপনারাও অগ্রগতির মূল স্রোতধারায় মিশে যান। এভাবেই সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।’ ‘মূল স্রোতধারাতে মিশে যান’ আর ‘অধিকার’ প্রভৃতি শব্দগুলো ৪০ বছর পরও যেন কর্ণকুহরে বেখাপ্পা বাজে!

অতীত কীভাবে বর্তমানে এসেছে, তা বিবেচনায় নিয়ে মন বেদনার্ত হয়ে ওঠে। মনে প্রশ্ন জাগে- কেন নির্বাচনের আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনের আগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছে না। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন কিংবা অর্পিত সম্পত্তি আইন যথাযথ বাস্তবায়ন প্রভৃতি প্রতিশ্রুতি কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না? সমস্যা কোথায়? 

উল্লেখিত প্রেসবিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, প্রতিশ্রুত এসব দাবি নিয়ে এ বছরের ২৪ মার্চ আড়াই লাখ মানুষের গণস্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীকে প্রদানের জন্য শাহবাগ চত্বর থেকে পদযাত্রা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে অগ্রসর হয়। পরে মিছিল আটকে ৭ জন প্রতিনিধিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তা গ্রহণ করে।

প্রেসবিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সরকারি কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। প্রশ্নটা হলো- লড়াই- সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধিরাও হিন্দু- বৌদ্ধ- খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। তাঁরা কী বলেন? নীরবতার বিষয়টা কেবল সংখ্যালঘুদের নয়, সচেতন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নাগরিকদের উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত না করে পারে না।

উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত হয়েই তাই প্রধান বিচারপতির বক্তব্য বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘সংবিধানে বলা আছে- এ দেশের মানুষ হিন্দু- মুসলিম সবাই মিলে বাঙালি। দেশ স্বাধীন করেছে, প্রত্যেকটা নাগরিকের সমান অধিকার থাকে। কেন হিন্দুরা ভাববে আমরা মাইনোরিটি কমিউনিটি। আমার মনে হয়, এটা তাদের ভেতর ইনফিওরিটি কম্পপ্লেকসিটি (হীনমন্যতা)। সবাই এ দেশের নাগরিক।’ মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে বলি- কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো নয়, আওয়মী লীগও ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’, ‘জাতীয় সংখ্যালঘু’ কথাগুলো লেখে। দলটির বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে ৩.২৯ অনুচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে- ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়।’ এটা হীনমন্যতা নয়, কঠিন ও কঠোর বাস্তবতা; যে বাস্তবতার ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা ও জাতীয় চার মূলনীতির চেতনাবিরোধী।

তবে মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কৃতজ্ঞ থাকবে এজন্য যে, তিনি বলেছেন, ‘মদিনা সনদ পৃথিবীর লিখিত প্রথম সংবিধান, যেখানে স্ব স্ব ধর্ম সম্প্রদায়ের লোক মিলে এক জাতি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে মাহানবী (সা.) বিদায় হজে বলে গেছেন। তার পরও আমরা একসঙ্গে...।

আজকেও কয়েকটা মোকদ্দমা হয়েছে, সেখানে জামিন চেয়েছে প্রতিমা ভাঙার জন্য। এটা কেন হবে?’ ‘আমরা যখন মানবতার কথা বলি তখন রাসুলকে ভুলে যাই।’ আসলে দেশের নাগরিকদের একাংশ অন্ধত্ব- গোঁড়ামী- সংকীর্ণতা- শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত মোহে কেবল বাঙালিত্ব নয়, ধর্মের পবিত্র বাণীও ভুলে গেছে।

সবশেষে ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা বলি- দ্বিজাতিতত্ত্বের সুতিকাগার ভারতের আলিগড়ে প্রবাসী ভ্রাতষ্পুত্রের বিয়ে উপলক্ষে যাওয়ার সুযোগ হলো। সেখানকার বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষের সঙ্গে কথাও হলো। তারা কমবেশি সকলেই বললেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সম্প্রদায়িকতা বিবেচনায় নিয়ে এখানে আমরা এখন ভোট দিচ্ছি। 

প্রকৃত বিচারে কোন দেশে কী হচ্ছে, তা জেনে খারাপ হলে আমরা ঘৃণা ও প্রতিবাদ অবশ্যই জানাবো; কিন্তু সুযোগ সত্ত্বেও আমাদের দেশটা বঙ্গবন্ধুসহ শত লক্ষ শহীদের স্বপ্নমতো ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রাদায়িকতার আদর্শে গড়ে তুলবো না কেন? বর্তমান সরকার নির্বাচনের আগে ‘অসাম্প্রাদায়িক প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে’ তোলার লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার জন্য ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়কে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল’, তা বাস্তবায়ন করুক- এটাই আজকের একান্ত কামনা।

কলাম লেখক

রাজনীতিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫