
এম আর খায়রুল উমাম। ফাইল ছবি
সরকার প্রতিটা বিভাগে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। হঠাৎ করে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ সাধারণ জনগণ এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। ইতিপূর্বে স্থান ও ব্যক্তি বিবেচনা করে, একটা বিশেষ বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে দেশে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা বিষয়ে কথা বলার পরই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত দেখা গেল।
এতে সাধারণ মানুষ ধারণা করছে- সরকার তার নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ওপর ভরসা রাখছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- দেশের সাধারণ জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মারফত নিশ্চিত করা হবে কি? সরকার স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে।
যদিও বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর বর্তমান যা অবস্থা, তা থেকে প্রমাণ হয় জনসেবা নয়, নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণই এখানে মূল লক্ষ্য। ফলে প্রতিটি বিভাগে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে যদি সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়, তা হলে তা হবে মন্দের ভালো।
বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বিজ্ঞজনেরা যা বলে থাকেন তা এই ধরনের বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যায় না। ফলে দেশের বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাগ্রহণকারীদের মন ও মননে শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকাই দৃশ্যমান হয়, যেখানে মানবিক গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ ঘটতে দেখা যায় না। দেশের সব বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিষয়ের কলেজগুলোর দায়িত্ব পর্যন্ত নেয় না।
সাধারণ জনগণের কাছে বিষয়টি খুব বিচিত্র মনে হয় যে, বিশেষায়িত কলেজগুলোর ভর্তি থেকে সনদ প্রদান পর্যন্ত সব দায়িত্বই এলাকার সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বহন করে থাকে। এজন্য অনেকে মনে করেন বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলেজগুলোর শিক্ষাকে মানসম্মত মনে করে না বা অগ্রাহ্য করে থাকে। বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব শুধু বিশেষজ্ঞ তৈরি করা। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন- এ উদাহরণ দেশে প্রচুর। তা হলে কলেজগুলোর শিক্ষার দায়িত্ব নিলে সমস্যা কোথায়?
এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনবলের সংকটের কথা সাধারণ জনগণ জানে। দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলো যেখানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংকটে জর্জরিত সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে? যদিও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো প্রতিষ্ঠানেই পদ বিবেচনায় শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা মহাবিদ্যালয়- শিক্ষার কোনো স্তরই শিক্ষক সংকটের বাইরে নেই।
তাই অন্যসব স্তরের মতো মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষক পাওয়া না গেলেও শিক্ষা বন্ধ থাকবে না। বরং এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কত ব্যক্তি পদ-পদবির ভারে সরকারের কাছে ন্যূব্জ হয়ে থাকবেন, সমাজে মূল্যবান ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন, কতজনের আয়বৃদ্ধি পাবে সে হিসাব করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে জনবল সংকট নিরসনে উপাচার্য থেকে বিভাগীয় প্রধান পর্যন্ত পদে প্রশাসন থেকে জনবল সরবরাহ করা যাবে, কারণ বাংলাদেশের একমাত্র প্রশাসনিক ক্যাডারেই অন্তত জনবল সংকট নেই। এর পাশাপাশি বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানি করে সংকট দূর করাও যাবে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনায় এই বিদেশি শিক্ষকরাও বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন। সবকিছু মিলিয়ে দেশ লাভবানই হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষকে আজ সেবার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। দেশের এই মেধাবী চিকিৎসক সন্তানদের প্রতি ণ্যূনতম আস্থা নেই বিত্তবানদের। সামান্য সর্দি-জ্বরেও তারা বিদেশে ছুটছেন। আর অনেকে সম্পদ বিনিময় করে ভারতে বা বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিচ্ছেন। বাকিরা সরকারি সেবাগ্রহণ ছাড়া উপায়হীন। ভারতগামীরা যদিও প্রথমে দেশে অল্পবিস্তর চেষ্টা করে থাকেন।
সরকারি নীতিকৌশল বিশেষজ্ঞদের দ্বারা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সবচেয়ে মজার পর্ব হচ্ছে- সরকারি আইন উপেক্ষা করে সরকারি হাসপাতালকে ঘিরে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনের অনুমতি দেয়া। এগুলো করাই হয়েছে এই জন্য যে, নীতিনির্ধারকেরা সরকারি দায়িত্ব পালন শেষে বা জরুরি প্রয়োজনে এক লাফে সেখানে হাজির হতে পারেন।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি রোগী নিয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দৌড়ে থাকা সাধারণ চিকিৎসকরা যেখানে প্রাণপাত করছেন, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জনসেবায় নিবেদিত। এই বিশেষজ্ঞদের একবার দর্শন করতে গেলে আবার সরকার প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর এক মাসের অর্থে হয় না।
আর শুধুতো দর্শনীতেও হয় না প্রথম দর্শনের সাথে সাথেই ৮/১০ হাজার টাকার টেস্ট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। তবে আমাদের বিশেষজ্ঞদের প্রতিভাকে স্বীকার করতেই হবে কারণ এতসব টেস্ট রিপোর্ট দেখতে তাদের এক মিনিটের বেশি সময় প্রয়োজন পড়ে না। আর প্রেসক্রিপশন! আদালত তো বলেই দিয়েছেন- ওষুধ কোম্পানির অর্থ নিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করার প্রেক্রিপশন করে থাকেন চিকিৎসকরা।
আমাদের সরকারগুলো শুধু চিকিৎসকদেরই কিন্তু বিশেষজ্ঞ করার মধ্যে সীমিত নেই। প্রকৌশল, কৃষি, বস্ত্র পেশাজীবীদের বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্যও সরকার বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছে। এসব দেখে আবার অনেক পেশাজীবীগোষ্ঠী উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। তারা শিল্প, আইন, চর্ম ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তুলেছে। আগামীতে আরও অনেকে এমন দাবি তুলবে তা স্পষ্ট।
সরকারের পক্ষ থেকে ২-১ জন পেশাজীবীর দাবি বাস্তবায়নের নির্দেশনাও রয়েছে। সরকার সাধারণভাবে যেহেতু এসব শ্রেণি- পেশার মানুষকে অসন্তুষ্ট করতে চায় না, তাই দেশের মানুষ নতুন নতুন বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় আগামীতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সাধারণ জনগণের ভয় একটাই- ‘সব পেশাজীবীর চরিত্র একই রকম’। এবিষয়ে দেশের বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন-
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার বাইরের এই বিষয়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমাজবিজ্ঞান খুবই কম পড়ানো হয়। তাতে দেশের পেশাজীবীদের মধ্যে মানবিক গুণাবলীর যথাযথ প্রকাশ দেখা যায় না।
দেশের সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ নয়। এই ঐক্যবদ্ধ না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বুদ্ধি ও বাহুবলে শক্তিশালী মানুষ আনুগত্যভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলেছে। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ এ সমাজ ভাঙতে পারেনি বরং দিন দিন তা আরও শক্তিশালী হয়েছে। এখন এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, বঞ্চিত মানুষগুলো বিশ্বের জ্ঞান- বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেও নিজের অধিকার, নিজের দাবি প্রকাশ করতে পারছে না।
নীতিনির্ধারকরা মসনদ লক্ষ্যাভিমুখী হয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করে। স্বাস্থ্য বিভাগও তার ব্যতিক্রম নয়। হাসপাতাল হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হচ্ছে; কিন্তু এখনো চিকিৎসার জন্য বহু হাসপাতালে অপরিহার্য যন্ত্র নেই, নার্স নেই, সহকারী নেই। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল জনবল নিয়ে চলমান স্বাস্থ্যসেবায় যে যন্ত্র আছে তা ব্যবহার করার জন্য যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, সে বিষয়গুলোতে পড়ার ব্যবস্থাও দেশে নেই। শুধু বিশেষজ্ঞ দিয়ে যে স্বাস্থ্যসেবা চলতে পারে না তা পরিষ্কার হওয়ার পরও নীতিনির্ধারকরা উদাসীন থেকে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে নিবেদিত। সরকারের এমন নীতি- কৌশলের কারণেই আজ বিত্তবানরা বিদেশে ছুটছে আর বিত্তহীনরা অকালে প্রাণ দিচ্ছে।
সাধারণ জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টিম বিবেচনা করে স্বাস্থ্য খাতে জনবল তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ দরকার। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রয়োজন আরও মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন ধরনের সহকারী তৈরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রয়োজন স্বাস্থ্যসেবার যন্ত্রপাতি এবং তা ব্যবহার ও মেরামত করে চালু রাখার জন্য দক্ষ জনবল। পাশাপাশি জরুরিভাবে প্রয়োজন মেধাপাচার বন্ধ করা, পেশাজীবীদের শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বড় অংশজুড়ে সমাজবিজ্ঞান পড়ানোর ব্যবস্থা করা। প্রতিটা বিভাগে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অর্থে এসব ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পথ খুলে যেতে পারে।