
প্রতীকী ছবি।
আমরা হয়তো ভুলেই গিয়েছি মাত্র কয়েক দশক আগেই এ দেশে কেউ বেশি অসুস্থ হলে কিংবা সহজে রোগমুক্তি না হলে চিকিৎসকরা রোগীকে বায়ু পরিবর্তনের বিধান দিতেন। এ ধরনের সমস্যায় সমুদ্র, নদী, পাহাড় কিংবা অন্য কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় রোগীকে পাঠানো হতো এবং ভালো ফল পাওয়া যেতো। এতেই বোঝা যায় নির্মল বায়ু কিংবা স্বাস্থ্যকর বাতাস মানুষের জন্য কতটা প্রয়োজন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ডের কথা বলেছে, বাংলাদেশে এর মাত্রা ১৫ গুণ বেশি। ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশ বায়ুদূষণে এক নম্বর স্থানে ছিল। গত বিশ বছরে বায়দূষণে মৃত্যুহার বেড়েছে ৯ শতাংশ। আর প্রতিবছর এতে মারা যায় দুই লাখ মানুষ। প্রত্যেক বছর একজন লোকের বায়ুদূষণজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যয় ৮ হাজার ৩৩৪ টাকা। দেশের এক কোটি মানুষ বায়ুদূষণজনিত সমস্যার শিকার। সম্প্রতি ‘সবুজ শহর উদ্যোগ’ শীষর্ক সেমিনারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এসব তথ্য তুলে ধরে।
বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণসামগ্রীর যত্রতত্র ব্যবহার, সব সময় রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি, কোনো নিয়ম না মেনে পুরনো ভবন ভাঙা, ইটভাটা, বস্তিতে প্রায় চল্লিশ লাখ চুলার আবর্জনা, কাঠ-কয়লা ও কেরোসিন দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধূলি ও ধোঁয়া এবং প্লাস্টিক পণ্যের ব্যাপক ব্যবহারকেও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
‘ম্যাগাজিন ফর এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজার’ নামে একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী বলছে, ভারতের ইন্দো-গাঙ্গেয় অববাহিকা এলাকায় ফসল কাটার পর খড়গুলো পুড়িয়ে ফেললে। সে ধোঁয়া হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশেও প্রবেশ করছে। ভারত, নেপাল, মঙ্গোলিয়া ও পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে শীতকালে মানুষ বাড়িতে যে কাঠ, তুষ ও খড় পোড়ায়; এমনকি রান্নাসহ অন্যান্য কাজেও গ্রামের মানুষ যে জৈব জ্বালানি ব্যবহার করে, তা থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া এবং দূষিত বায়ুর প্রবাহ নভেম্বরে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং এটা বাংলাদেশের বায়ুকে আরো দূষিত করে তোলে।
দেশে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮৩ শতাংশ। নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, ইটভাটা এবং রাস্তা খোঁড়াখুড়ির পরিমাণও বেড়েছে বহুগুণ। এ সব বিষয় সাধারণত শহর এলাকায় ঘটছে। এজন্য বলা হচ্ছে- বায়ূদূষণে শহরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
বায়ুদূষণ বন্ধে অবশ্যই ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ কমাতে অফিসবাস, স্কুলবাস চালু করতে হবে। ট্রাম কারেন্টের মাধ্যমে চলে। তাই ট্রাম, মেট্রোরেল এবং ইলেকট্রিক কার ব্যবহার প্রয়োজন। সিঙ্গাপুরে যানজট কমানো এবং বায়ুদূষণ রোধের জন্য চাইলেই গাড়ি চালানোর অনুমোদন পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে। আমরা সেখান থেকে ধারণা নিয়ে এ ধরনের নিয়ম করতে পারি। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপও এক ধরনের বায়ুদূষণ ঘটায়।
এ বিষয়েও ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। যেখানে সেখানে নির্মাণসামগ্রী রাখা, পুরনো বিল্ডিং ভাঙা এবং বিল্ডিং করার সময় প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন না মানলে শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বস্তিতে কাঠকয়লার বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণ বন্ধ করতে হবে। নইলে এই অঞ্চলের কোনো দেশের বায়ু দূষণমুক্ত হবে না। এ জন্য দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার এবং বর্জ্যরে বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ এবং জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।