Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

মহাশূন্যের জ্ঞান নৈতিকতা শেখায়

Icon

আলমগীর খান

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২২, ১৪:৫৩

মহাশূন্যের জ্ঞান নৈতিকতা শেখায়

আলমগীর খান। ফাইল ছবি

আমাদের দেশে অভিভাবকরা মেধাবী ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান পড়াতে যারপরনাই উৎসাহী। মেধাবী অর্থ বলতে যারা প্রচলিত পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পায়। আর এদেশে বিজ্ঞান পড়া বলতে সাধারণত ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বোঝায়।

এমন নয় যে, চিকিৎসা ও প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি তাদের ভালবাসা, বিজ্ঞান নিয়ে কৌতূহল, অজানা বিষয় জানার আনন্দ, মানবকল্যাণের আদর্শ- এসব কিছুই নয়। বরং এই দুটি পেশা সন্তানের জীবনে যে আর্থিক উন্নতির নিশ্চয়তা দেয় সেটাই তাদের মূল লক্ষ্য। 

এ দেশের স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের নিরেট বিষয় ও তথ্য দুটিই মুখস্থ করে। বিজ্ঞান তাদের মাথায় ঢুকলেও হৃদয় ছোঁয় না, ফলে ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাদের আত্মিক বিকাশ কমই ঘটে। এই ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন বিশেষায়িত বিজ্ঞান বিষয়ে পাস করে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করে। কোনো কোনো পেশায় তারা চরম আর্থিক সমৃদ্ধিও লাভ করে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বৈজ্ঞানিক মনমানসিকতা গড়ে ওঠা ছাড়াই তারা বিজ্ঞানের তকমা লাগিয়ে অর্থোপার্জনে নেমে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কতক বিশেষায়িত বিজ্ঞানশিক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায় বিজ্ঞানচেতনা তৈরিতে, যদিও পেশা হিসেবে সেগুলো সফল। 

বিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে- মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন। মহাশূন্যের জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী, কৌতূহলী, বৃহৎহৃদয়, জ্ঞানপিপাসু ও নৈতিক করে তোলে। তাই বিজ্ঞান কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হলেই চলে না, এটি হতে হবে সর্বসাধারণের বিষয়। বিজ্ঞানের আবিষ্কারসমূহ ব্যবহারে উন্নয়নশীল দেশের মানুষরা বেশ এগিয়ে, আবার পশ্চাৎপদ মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে আরও অগ্রসর; কিন্তু কেবল দক্ষতার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সুফল ভোগ করাই যথেষ্ট নয়, প্রত্যেকের ন্যূনতম বৈজ্ঞানিক ধারণা লাভও জরুরি। মহাশূন্যের জ্ঞান এক্ষেত্রে সবচেয়ে দৃষ্টি উন্মোচনকারী। প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে মানবদেহ সম্পর্কে একটা ন্যূনতম বৈজ্ঞানিক ধারণা থাকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মহাশূন্যের ধারণা লাভ। সমাজ, সংস্কৃতি ও আত্মিক বিকাশের জন্য সর্বসাধারণ পর্যায়ে এ জ্ঞান অপরিহার্য। 

উদাহরণ হিসেবে একবার ভাবুন এই বিশ্বটা কত বড়। আর কতটা আশ্চর্যের যে, এই কল্পনাতীত বিরাট বিশ্বের এক কোণার পৃথিবীতে বসে আমরা মানুষ এই মহাবিশ্বটাকে মেপে ফেলেছি। এই মহাবিশ্বের জন্ম ১৩৮০ কোটি বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণের (বিগ ব্যাং) ফলে। এর ব্যাস ৯৩০০ কোটি আলোকবর্ষ, যার অর্থ- সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল গতিসম্পন্ন আলো মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছতে ৯৩০০ কোটি বছর লাগবে। আর এই বিরাট মহাবিশ্ব কিন্তু প্রতিমুহূর্তে প্রসার হচ্ছে।

আমাদের বাস মহাবিশ্বের এক ছোট্ট সৌর পরিবারের সদস্য হিসেবে পৃথিবী নামের গ্রহটিতে। আমাদের নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূরে, যেখানে আলো আসতে সময় নেয় ৮ মিনিট। সৌর পরিবারের বাইরে আমাদের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই, যার দূরত্ব ৪.২৪ আলোকবর্ষ অর্থাৎ ওই নক্ষত্র থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো পৌঁছতে সময় লাগে সোয়া চার বছর। আমরা আছি আকাশগঙ্গা ছায়াপথে (মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি)। মহাবিশ্বে আমাদের মতো ছায়াপথ আছে ১০,০০০ কোটি। একেকটি ছায়াপথে আবার আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্র আছে ১০ হাজার কোটি থেকে ৪০ হাজার কোটি। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ব্যাস ১ লাখ আলোকবর্ষ অর্থাৎ- আলো এর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছতে সময় লাগবে ১ লাখ বছর। (The Little Book of Big History, Michael O’Mara Books Ltd, লন্ডন, ২০১৬) 

দেখা যাচ্ছে- মহাবিশ্বের দুটি স্থানের দূরত্ব মাপা হয় আলোর গতি দিয়ে। ফলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আমরা মহাবিশ্বে যা কিছু দেখি তা সব অতীতের, কোনোটাই বর্তমানের নয়। যে সূর্যকে প্রতিদিন দেখছি তা ৮ মিনিট আগের যেহেতু সেখান থেকে আমাদের চোখে আলো আসতেই সময় লাগে ৮ মিনিট। এর অর্থ হলো এই মুহূর্তে যদি কোনো কারণে এই সূর্যটি আকাশ থেকে উধাও হয়ে যায়, পৃথিবী থেকে ৮ মিনিট পর্যন্ত আমরা কেউ তা বুঝব না। সূর্যটি উধাও হয়ে যাওয়ার পরও ৮ মিনিট পর্যন্ত সবাই তা দেখব। কেবল ৮ মিনিট পর আমরা আসল ঘটনা বুঝতে পারব। আর নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই এই মুহূর্তে উধাও হলেও আমরা আরও সোয়া চার বছর পর্যন্ত তা দেখতেই থাকব। এর মানে হলো- আমরা যে প্রক্সিমা সেন্টরাই এখন দেখছি তা মোটেই এখনকার নয়, সোয়া চার বছর আগের। অতএব এই মহাবিশ্ব কল্পনাতীত রকমের বড় ও আশ্চর্য রহস্যময়। 

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান তাঁর Pale Blue Dot (Ballantine Books, নিউ ইয়র্ক, ১৯৯৪) বইতে লিখেছেন, মহাকাশযাত্রা একজন মহাকাশচারিকে কীরকম বৈশ্বিক অনুভূতিতে সমৃদ্ধ করে। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মানুষের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় ঘৃণাকে কতটা অর্থহীন মনে হয়। সাগান লিখেছেন- ‘কক্ষপথ থেকে পৃথিবীর কথা কিছুক্ষণ ভাবলে আপনার কাছে সবচেয়ে কঠিন জাতীয়তাবাদও শূন্যে মিলিয়ে যাবে। এসব মনে হবে ফলের গায়ে লেগে থাকা পোকার ঝগড়াঝাঁটি।’ 

এই মহাবিশ্বের বয়সের প্রেক্ষিতে আমাদের জীবনের কথা ভাবলে তা কত ক্ষুদ্র আঁচ করা যায়, মহাবিশ্বের এক পলকেরও অনেক অনেক কম সময়। অথচ এই এক পলকেরও অনেক অনেক কম সময়ের জীবনে আমরা কত না অন্যায় কাজকর্মে ডুবে থাকি- হত্যা, আঘাত, প্রতারণা, নির্যাতন, শোষণ, বিনষ্টিকরণ থেকে হেন অপরাধ নেই, যা মানুষ করে না। কেন? সবই এই এক পলকেরও কম সময়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবনকে যাপনের জন্য। আমরা কত প্রাণীকে আঘাত করি, কত মানুষকে কাঁদাই, কতজনকে অসহায় করে তুলে আনন্দ পাই, কত পরিবেশ ধ্বংস করি- সবই ব্যক্তিজীবনের হাস্যকর সার্থকতার জন্য।

হ্যাঁ, আমরা ভালোও বাসি, সহানুভূতিশীল হই, আত্মত্যাগ করি, অন্য জীবন বাঁচাই এবং আরও অনেক ভালো ভালো কাজ করি। এই ক্ষুদ্র জীবনের ভেতরেই। তবু আমাদের জানা ইতিহাসের প্রধান ছবিটা হলো- অন্যের সুখ হরণের, সুখ বিস্তারের নয়। আমাদের জানা ইতিহাসের প্রধান অংশ হলো- মানুষ কর্তৃক মানুষকে বঞ্চনার, হারানোর, শোষণের, বৈষম্য বিস্তারের, দরিদ্রায়ণের, পিছে টেনে ধরার ও নির্মম যুদ্ধের। জীবনের বিরুদ্ধে জীবনের। 

মহাশূন্যের প্রাথমিক ধারণা আমাদের এই বিরাট নির্বুদ্ধিতা ও সংকীর্ণতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। একবারের জন্যও কল্পনার চোখে মহাকাশ থেকে দেখলে আমাদের এই হিংসা-বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতা, নীচতা ও নোংরামিকে কত অর্থহীন ও হাস্যকর মনে হয়। আর অন্যদিকে পরস্পরকে ভালোবাসা, সহযোগিতা ও কল্যাণের চেষ্টা যে কতটা অর্থময় ও মূল্যবান তা স্পষ্ট হয়। বিবর্তনের দিক থেকে মানুষের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে এই নীচতা অতিক্রম করে মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে নিজেকে যথাসাধ্য উন্নত করে তোলা, নিজেকে পৃথিবীর যোগ্য করা, যে পৃথিবী মহাশূন্যের বিপুল কৃষ্ণসাগরে সাগানের ভাষায় ভাসমান একটি ‘মলিন নীল বিন্দু’ মাত্র। 

মহাশূন্যের জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী, নিরহঙ্কার, প্রেমপূর্ণ, শান্তিবাদী, কল্যণকামী ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী করে তোলে। আমরা বুঝতে পারি যুদ্ধ করে নয়, ধ্বংস করে নয়, ঘৃণা করে নয়, ভালোবেসে একে অপরের হাত ধরে অপরকে সুখী করেই কেবল আমরা এই শূনতাকে ভরাট ও এই জীবনকে অর্থময় করে তুলতে পারি। সেজন্য মহাশূন্যের মৌলিক জ্ঞান আমাদের সর্বস্তরে বিস্তার করা ও দৈনন্দিন জীবনের অংশ করা প্রয়োজন। সবচেয়ে ভালো স্কুল থেকে শুরু করা। তাতে কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হোক বা না হোক- আমাদের শিশু-কিশোররা বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি-বিশ্বাস-সম্পদভিত্তিক বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে উঠবে সুন্দর, নৈতিক, সহমর্মী ও সমাজবাদী হয়ে। তারা গড়ে তুলবে আগামী দিনের নতুন সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী; যাকে মহাশূন্য থেকে কেবলই অর্থহীন ও হাস্যকর ক্ষুদ্র মনে হবে না- মনে হবে ভালোবাসায় টইটম্বুর সুন্দরতম এক ব্লু ডট।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫