Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

টেস্ট থেকে টি-২০, কাগজ থেকে অনলাইন, জীবনানন্দ থেকে মারজুক রাসেল ...

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৭

টেস্ট থেকে টি-২০, কাগজ থেকে অনলাইন, জীবনানন্দ থেকে মারজুক রাসেল ...

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

আমি ক্রিকেটপাগল, যা-ই করি না কেন ক্রিকেটের খবর রাখি। এমনকি আমার স্মৃতি পর্যন্ত ক্রিকেট নির্মিত। সেদিন এক অনুষ্ঠানে বললাম, ‘আমি সোহাগপুর- এক বিকট গণহত্যার স্থান- গিয়েছিলাম, যখন শ্রীলঙ্কা প্রথম ওয়ার্ল্ডকাপ যেতে।’ আমার হাল খারাপ।

৫ বছর বয়স থেকে ক্রিকেট দেখছি ঢাকা স্টেডিয়ামে, আজ আমার ৭০+ বয়স। কোথাও যাই না খেলা দেখতে। টিভিতে অনলাইন সাইটে ক্রিকেট দেখি বা রেজাল্ট ফলো করি। আমার জন্য এটাই পারফেক্ট। 

২. ১৯৭৩ সাল থেকে সাংবাদিকতায় জড়িত, তখন ছাত্র। ইউনিভার্সিটিতে নির্বাচন কভার করতে গিয়ে ধাওয়া খাই পিস্তল হাতে পাবলিকের। তখন ছিল অক্ষর বসিয়ে বসিয়ে হ্যান্ড কম্পোসের যুগ। চোখের সামনেই তার বিলুপ্তি দেখলাম, কত মানুষ বেকার হয়ে ঢাকা ছাড়লো, আর আজ ক্লিক করে লেখা হয়, কম্পিউটারে পেজ মেকআপ। আমি নিউজ সাইটে ভিজিট করে নিউজ পড়ি, নিউজ শেয়ার করি, ভালো লাগা, খারাপ লাগা জানাই।

৩. জীবনের প্রথম সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ লিখি জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে ১৯৬৯ সালে। তখন আমরা ঢাকা কলেজের ছাত্র, লিটল ম্যাগাজিন করি। ২০০০ সালে নেপালে চাকরি সূত্রে যাই, সাথে নিয়ে যাই শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান. জীবনানন্দ দাস; কিন্তু ফিরে এসে বরিশালের কবির কবিতা আর পড়িনি, টানেনি। তার ভাষা অসাধারণ; কিন্তু সেটা আমার নয় মনে হয়। সবাই তার ভক্ত, আমিও তাকে মহান কবি মনে করি; কিন্তু ওই গদ্য আমার দুনিয়ার বাসিন্দা নয়। অত প্রেম, জ্বালা-বেদনা, আকুতি দিয়ে কী করবো বুঝতে পারি না। তাই পড়ি না।

৪. বরং গান শুনি। আর এতো কিসিমের গান চারিদিকে। আমার কবিতার চাহিদা দেশের বা অন্য সংস্কৃতির গান মেটায়। আমি পাল্টেছি, সময় পাল্টেছে, দুনিয়া পাল্টেছে। সনাতনের সাথে সাথে আমি সন্ধান করি তৎক্ষণাতের, সাম্প্রতিকতার। আমি আর আগের মতো নেই, কোনো দিন হবো না।

৫. ক্রিকেট টেস্ট হতো আগে টাইম-লিমিট ছাড়া, যতদিন না রেজাল্ট হয়, অথবা জাহাজ ছেড়ে চলে যায়। কেউ দেখতো কিনা জানা নেই। দিনের পর দিন খেলা দেখা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তখন বা আজ। প্লেয়ারদের রুটিরুজি খেলার ওপর নির্ভর করতো না। তাই একে বলতো ‘জেন্টেলম্যানস গেম’। তৎকালীন পরিভাষায় ‘জেন্টেলম্যান’ মানে যার কাজকর্ম করার দরকার নেই । ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই... ’

৬. মানুষ কি টেস্ট ম্যাচ পছন্দ করে এক ধরনের হারিয়ে যাওয়া বনেদিয়ানার প্রতি নস্টালজিয়া থেকে? এই অঞ্চলের ক্রিকেট প্লেয়ারের পরিচয় ছিল ওপরতলা, ইংরেজের সঙ্গে সম্পর্ক। এর প্রথম পরিবর্তন আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজে যেখানে ক্রিকেট হয়ে ওঠে ইংরেজ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি জধলহড়রঃরশ অস্ত্র। খেলা এক কিন্তু উদ্দেশ্য অন্য। টি-২০ কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতেই তৈরি। এখন তারা পিছিয়ে পড়েছে নানা কারণে; কিন্তু এটাই এখন, এটাই বাস্তবতা, এটাই বাংলাদেশ। আজ আমাদের বড় সমর্থক বিদেশের অভিবাসী শ্রমিক ভাই-বোনেরা। তারা বড়লোক, বনেদি নয়। জীবন, দুনিয়া দুটোই পাল্টেছে। 

৭ . টি-২০ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিষয় দর্শক, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী খেলা হয়। কেউ গোটা দিন, পাঁচ দিন তো বাদই দিলাম, মাঠে কাটাতে পারবে না। তাকে কাজ, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা, নানা বিষয় সামলাতে হয়, তাই সন্ধ্যা তার পছন্দ। দ্রুত সময় কাটিয়ে আনন্দে সে ঘরে ফিরতে চায়, বাকি খেলার রেজাল্ট জেনে নেবে স্মার্ট ফোনে। আজকের বেশির ভাগ দর্শক এর পক্ষে। টেস্টের কাল শেষ, এমনকি ঙউও বিগত। আজকের দুনিয়াতে থাকতে চাইলে থাকবে কিন্তু জায়গা পাবে না। 

৮. জীবনানন্দ আর মারজুক রাসেলকে এক সেন্টেনসে নাম নেওয়ার জন্য কত যে গালি হচ্ছে কে জানে। আমি তো সবই পড়ি, সবই শুনি; কিন্তু সবাই সবটা পড়ে না। প্রত্যেকের পছন্দ আছে আলাদা আলাদা। আগে প্রায় কেউই কিছু পড়তো না। লেখা পড়ে জানতো না মানুষ; কিন্তু আজ প্রসার হচ্ছে, গান-কবিতা হাজারো বেশি গুণে কারণ নানাভাবে বিশেষ করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সব কিছু। এখন অনেকের হাতে অনেক রকম চয়েস আছে, যে যার পছন্দ মতো বেছে নেয়। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ কে বলবে?

৯. এককালে সংস্কৃতির পাহারাদারী গ্রহণযোগ্য ছিল, এখন সে কাল অতীত। তাই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের পাশে আছে মারজুক রাসেল ও অন্যরা। এরাও আমাদের, যদি ওরা আমাদের হয়। অথবা তুমি তোমার, আমি আমার ওর।

১০. আমি গানে কবিতা পড়ি বেশি আজকাল। গানের কথায় যে কবিতা আসে সেটাই বেশি উপভোগ করি। যেমন- নজরুলের সুর অপূর্ব; কিন্তু ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেব না ভুলিতে’ এসব ভাবনার সাথে নিজেকে মেলাবো কীভাবে? 

১১. মারজুক রাসেল একজন অপূর্ব বেয়াদপ। তার হাফ প্যান্ট পরা ছবি, অনেককে বিরক্ত করে। তার কথাবার্তায় কোনো সুশীলতা নেই। তিনি কবিতার ভীষণ পক্ষের লোক; কিন্তু করেন অভিনয়, বিশেষ করে মাস্তান টাইপের চরিত্রে দারুণ মানায়। আমাদের মিডিল ক্লাস সুশীলতা যা ‘ভদ্র’ বলে সেটার দিকেই সে আঙুল দেখায়। ফেসবুকে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ৬ লাখ। এতে বোঝা যায় তার পরিসর কত ব্যাপক। তাকে পছন্দ না করলেও চলবে। সে তার নিজ জগতে অনেক সবল। 

১২. আমরা মাপি সুশীল সুতা দিয়ে; কিন্তু গোটা দেয়ালে যারা চিকা মারে তারা আমাদের মতো না। একালের আর এক নায়িকা লালন ব্যান্ডের সুমি যখন গায়- ‘এই রাত এলোমেলো কথা বলে ... অলি গলি চলি চলি, বাজি ধরে রাত খেলে জুয়াড়ি...’ তখন আমার মতো বৃদ্ধ নিশাচরও নিজের কথাটা শুনতে পায়। 

সবাই থাকুন, সবাইকে থাকতে দিন। সংস্কৃতিতে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ চাঁড়াল নয়; সবাই পাবলিক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫