Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

কোথায় যাচ্ছে জাতীয় পার্টি

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:১৩

কোথায় যাচ্ছে জাতীয় পার্টি

আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি

নাশতার টেবিলে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পরে দেবর-ভাবির সম্পর্কের বরফ গলেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয় গত ২৯ নভেম্বর। বলা হয়, ভুল বোঝাবুঝির ‘অবসানে’ লম্বা সময় বৈঠক করেছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এবং চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

বৈঠক শেষে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু সাংবাদিকদের বলেন, অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৯ নভেম্বর ২০২২)।

চিকিৎসার জন্য পাঁচ মাস দেশের বাইরে ছিলেন রওশন এরশাদ। ২৭ নভেম্বর দেশে ফেরেন। এর দুদিন পরেই রাজধানীর একটি হোটেলে সকালের নাশতায় বসেন দলের ‘চেয়ারম্যান’ এবং তার দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে- যিনি এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। যদিও তা এখন প্রশ্নের মুখে।

রওশন-কাদেরের বৈঠকের দিনেই জানা যায়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে রুলও জারি করা হয়েছে। তার মানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনে আর কোনো বাধা নেই। (যুগান্তর, ২৯ নভেম্বর ২০২২)। কিন্তু এর পরদিনই গণেশ উল্টে যায়। কেননা হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছিলেন, তা স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। 

ফলে আবারও আটকে যায় জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি। 

মূলত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আদালতপাড়ায় ঘুরছে জাপার নেতৃত্ব। এতে থমকে যায় দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম। উপরন্তু দেশে ফেরার পরে রওশন এরশাদ তার দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের পরে দলের দ্বন্দ্ব কেটে গেছে বলে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন নেতারা- সেটিও থমকে গেছে।

গুঞ্জন আছে, রওশন-কাদেরের মধ্যে বিরোধ মিটে যাক; অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে জাতীয় পার্টি একটি শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হোক- সেটি দলের ভেতরে এবং বাইরে অনেকেই চান না। জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হলে যাদের অসুবিধা, তারাও হয়তো এই অভ্যন্তরীণ সংকট প্রলম্বিত হওয়ার পেছনে ইন্ধন জোগান। কারণ খণ্ডিত ও দুর্বল জাতীয় পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা যত সহজ, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতীয় পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা ততই কঠিন। 

আবার রওশনের অনুসারী নেতারা হয়তো ভাবছেন, তার পক্ষে থাকলে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া এবং সরকারের আনুক‚ল্য পাওয়া সহজ হবে; যদি আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। অন্যদিকে জিএম কাদের যেহেতু ইদানীং অনেকটা বিএনপির টোনে কথা বলছেন; সরকারের নানা কাজের কড়া সমালোচনা করছেন, ফলে তাকে বেকায়দায় ফেলার জন্যও দলের ভেতরে ও বাইরে থেকে নানারকম খেলা চলছে। 

এসব খেলার মধ্য দিয়ে তাকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়াই হয়তো লক্ষ্য। 

রওশন এরশাদের যেহেতু বয়স হয়েছে; শারীরিকভাবেও অসুস্থ; চিকিৎসার পেছনেই অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয়, সুতরাং জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান না থাকলে এই পদে অন্য কোনো নেতার আসীন হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। যদিও বাংলাদেশের প্রধান তিনটি দলই যেরকম পরিবারতন্ত্রকে লালন-পালন করে এবং জনসাধারণের বিরাট অংশ পরিবারতন্ত্রের সমর্থক, ফলে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের অনুপস্থিতিতে হয়তো দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা, পুত্র এরিক কিংবা সাদের নাম সামনে চলে আসবে। 

অর্থাৎ পরিবারের বাইরে যে কেউ এই দলের চেয়ারম্যান হবেন বা হতে পারবেন, সেটি বেশ কঠিন। তখন হয়তো জাতীয় পার্টি পঞ্চমবারের মতো ভেঙে আরেকটি দল হবে। 

এরশাদের জীবদ্দশাতেই জাতীয় পার্টি চার খণ্ড হয়। এরশাদের নেতৃত্বে দলের মূল অংশ থাকলেও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি-বিজেপি (বাইসাইকেল); নাজিউর রহমান মঞ্জুরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (গরুর গাড়ি) এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল) গঠিত হয়। এরশাদের মৃত্যৃর পরে বিদিশার নেতৃত্বে নতুন জাতীয় পার্টি গঠিত হচ্ছে, এমন গুঞ্জনও ছিল। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ২৯ নভেম্বর রওশন-কাদেরের বৈঠকে বহিষ্কৃত, দলত্যাগীদের ফিরিয়ে নেওয়া, ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন, প্রধান পৃষ্ঠপোষকসহ সবার পরামর্শে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম পরিচালনা, রংপুর সিটি নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এবং দলীয় রাজনীতির সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

দলের সিনিয়র নেতাদের বরাতে গণমাধ্যমের খবর বলছে, বৈঠকে রওশন এরশাদ বলেছেন, কোনো ধরনের বিভেদ-বিভক্তি নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করে আগামীতে ক্ষমতায় যেতে হবে। (বাংলাদেশ জার্নাল, ২৯ নভেম্বর ২০২২)। কিন্তু সত্যিই কি দলের সংকট কেটেছে? কারণ জাতীয় পার্টির কার্যক্রমই এমন যে, সারা বছরই দলটির বিবাদ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে থাকে। 

অথচ এই দলটির মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য বজায় থাকলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৈরিতার বাইরে গিয়ে মানুষ তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ভাবতে পারত। কিন্তু সেটি হয়নি। বরং দলটির কার্যক্রমে মানুষ অনেক সময় রসিকতা করে জাতীয় পার্টিকে ‘বাংলাদেশ সার্কাস পার্টি’ বলেও মন্তব্য করে। অথচ আওয়ামী লীগ-বিএনপির কট্টর সমর্থকের বাইরে যে বিপুল ভোটার আছেন, তাদেরকে সহজেই কাছে টেনে নিয়ে বৃহৎ একটি রাজনৈতিক শক্তি হওয়ার সম্ভাবনা তাদের ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কাজে না লাগিয়ে জাতীয় পার্টি কখনো সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারবিরোধী দল আবার কখনো মন্ত্রিসভায় এবং একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার অদ্ভুত সব নজির স্থাপন করেছে- যা পৃথিবীর যে কোনো দেশের সংসদীয় রাজনীতিতেই বিরল।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ছোট ভাই জিএম কাদের দুজনই নিজেকে দলটির চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দেন। এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন জিএম কাদের। উপরন্তু এই সময়ে তারা দুজনই সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হতে চেয়ে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন। তখন রওশন ও কাদেরের মধ্যে একটা সমঝোতা হয় যে, রওশন হবেন বিরোধীদলীয় নেতা আর জিএম কাদের হবেন বিরোধীদলীয় উপনেতা ও দলের চেয়ারম্যান। ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কাউন্সিলে ৩ বছরের জন্য দলের চেয়ারম্যান হন জিএম কাদের।

কিন্তু সম্প্রতি জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা বানানোর জন্য দলের সংসদীয় বোর্ড স্পিকারকে চিঠি দেয়। শুধু তাই নয়, তাকে বিরোধীদলীয় নেতা না বানালে জাতীয় পার্টির এমপিরা সংসদে যাবেন না বলেও হুমকি দেন। তবে ৩১ অক্টোবর জানা যায়, স্পিকারের আশ্বাসে তারা সংসদে যাচ্ছেন। 

মজার ব্যাপার হলো, এরশাদ জীবিত থাকার সময় থেকেই জাতীয় পার্টি মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘বিরোধী উইং’ হিসেবে কাজ করছে এবং এই দলের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ মেটাতে অনেক সময় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা ভূমিকা রেখেছেন বলেও জানা যায়। 

আসলে জাতীয় পার্টির ভেতরে যে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব, সেখানে কোনো আদর্শিক ব্যাপার নেই। তারা সরকারের সঙ্গে আছে কি বিরোধী দলে; আগামী নির্বাচন তারা এককভাবে করবে নাকি জোটবদ্ধ হয়ে- সেসব কোনো বড় বিষয় বলে মনে হয় না। বরং অতীতেও দেখা গেছে, জাতীয় পার্টির বিরোধের নেপথ্যে মূল কারণ ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব। জিএম কাদের হয়তো ভাবছেন, বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে পারলে বড় কোনো মন্ত্রিত্ব পাবেন। 

আবার রওশন এরশাদ হয়তো আওয়ামী লীগের বলয়ের বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছেন। দলের অন্য সিনিয়র নেতারাও কে কখন রওশনের সঙ্গে আর কে কাদেরের সঙ্গে থাকবেন বা থাকবেন না- সেখানেও দলের বৃহত্তর লক্ষ্য উদ্দেশ্যের চেয়ে যে তাদের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের সমীকরণই মুখ্য, সেটিই বাস্তবতা। 

এখন যে প্রশ্নটি জাতীয় পার্টিকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি আবর্তিত হচ্ছে তা হলো, দেবর-ভাবির টানাপড়েনে শেষমেশ দলটির চেহারা কী দাঁড়াবে এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা, সেখানে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে? তারা কি এককভাবে তিনশ আসনে প্রার্থী দেবে নাকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই জোটবদ্ধ থাকবে? নাকি বিএনপির বলয়ে যাবে? 

জাতীয় পার্টি যদি এটি আন্দাজ করতে পারে যে নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে এবং বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে, তখন তারা হয়তো সরকারের অংশীদার হতে বিএনপির সঙ্গেই জোট করবে। আর যদি সেই সম্ভাবনা তৈরি না হয়, তাহলে তারা হয়তো আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবে এবং সরকারের অংশ হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নিতে চাইবে।

কারণ জাতীয় পার্টি খুব ভালো করেই জানে যে, এককভাবে নির্বাচন করে তারা উত্তরবঙ্গের কিছু নির্ধারিত আসনের বাইরে সারা দেশে খুব ভালো ফলাফল করতে পারবে না। কারণ তারা নিজেদের শক্তিতে বিকশিত হতে চায়নি। চায়নি বলেই বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরেও জাতীয় পার্টি এখনো মূলত একটি আঞ্চলিক দল হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। 

তারপরও জাতীয় পার্টির সম্ভাবনা আছে আপন শক্তিতে বিকশিত হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় কোনো শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার। কিন্তু দলের ভেতরে যে পরিমাণ পারিবারিক বিরোধ, সেটি কাটিয়ে উঠে   তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা বেশ কঠিন। কারণ বাহির সামলাতে গেলে আগে ঘর সামলাতে হয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫