
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
যে কোনো আলাপে কথাটা উঠে আসে- ‘এটা কি সঠিক ইতিহাস?’ এই বিতর্ক বহুদিনের, কিন্তু এই ‘সঠিক’ বলতে কোনটা বোঝায় সেটা রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায়।
এটা প্রধানত রাজনৈতিক দলের অবস্থানকে কেন্দ্র করে আলোচিত হয়, সঠিক তথ্য নিয়ে নয়। তাহলে সঠিক মানে কী?
কম বেশি চারদিকে যে ভাবনা সেটা হলো, যে তথ্য ‘আমাদের রাজনৈতিক দলের পরিচিতির কাছে গ্রহণযোগ্য, সেটাই সঠিক।’ যে ইতিহাস নিজ দল বা গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক বক্তব্যকে সুবিধা দেয়, অপরকে অসুবিধায় ফেলে সেটাই ‘সঠিক’।
দুই.
সোজা-সাপ্টা করে বললেই হয়, দেশে দুইটা ‘সঠিক’ ইতিহাস আছে। একটা আওয়ামী লীগের সঠিক ইতিহাস, অন্যটা বিএনপির সঠিক ইতিহাস। তৃতীয় একটা ধারা আছে, যেটা এত প্রবল না কিন্তু আছে, সেটা বাম ধারার ‘সঠিক’ ইতিহাস। এই ত্রিধারার মধ্যে আমাদের বসবাস। এটা থেকে সহসা মুক্তি পাবার সম্ভাবনা কম। ইতিহাসের রাজনীতিকরণে কার ক্ষতি হয়েছে বলা যায় না। তবে এই ‘সঠিক’ ইতিহাস চর্চার ফলে, মানুষের আগ্রহ অনেক কমেছে ১৯৭১ সালের ইতিহাস জানার ব্যাপারে। কে ওই দলীয় ঝগড়ায় যাবে তথাকথিত ‘সঠিকের’ সন্ধানে?
তিন.
কিন্তু এটাই একমাত্র বিভাজনের প্রকাশ নয়, মূল সূত্র। প্রকাশ হচ্ছে ‘জাতীয়তাবাদী’ ধারণাভিত্তিক ইতিহাস। যার মানে কেবল একটি মাত্র বা ‘একক’ বা সেই ‘সঠিক’ ইতিহাস আছে। সঠিক ইতিহাস মানে কেবল বাঙালির ইতিহাস বা জাতিভিত্তিক ইতিহাস। অন্য ইতিহাস আসলে জাতীয় ইতিহাস খণ্ডিত হবে। আর এই ধারা নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী। সুশীলরা। তাদের চোখে যেটা বাঙালিভিত্তিক নয় সেটা ইতিহাস নয়। অর্থাৎ ‘জাতি’ পরিচয়ভিত্তিক ইতিহাস চর্চা একমাত্র সহি চর্চা। এই সঠিকতার হিসাবে ১৯৭১ সালে যত মানুষ ছিল সবার একই অভিজ্ঞতা ছিল বা হয়। এতে আর কোনো ‘পরিচিত’ বা পার্থক্য থাকতে পারে না। অতএব নারীর আলাদা অভিজ্ঞতার ইতিহাস বা হিন্দু জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা বলে কিছু নেই। ওটা প্রায় কুফরী ইতিহাস হয়ে যায়।
চার.
হিন্দুদের মারা হয়েছে ১৯৭১ সালে স্রেফ হিন্দু হওয়ার জন্য। কোনো মুসলমানের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। অতএব এদের জীবন মৃত্যুর বিষয়, বিপদের সূচক, অভিজ্ঞতা, আলাদা হতে বাধ্য। ৯৫ শতাংশ শরণার্থী যখন হিন্দু হয়, তখন সেটা আলাদা ইতিহাস হওয়ার দাবি রাখে তথ্যের ভিত্তিতে। কেন এটা হলো সেটা জিজ্ঞাসা করতেই হবে। সবাইকে এক ইতিহাসের অংশ বানিয়ে তার ইতিহাস বিলুপ্ত করার শামিল হয়। পাকিস্তানিদের চোখে হিন্দু আর মুসলমান জনগোষ্ঠী এক ‘বাঙালি’ ছিল না, আমরা যতই চিল্লাই। এটা সাম্প্রদায়িকতা নয়, বাস্তবতা। নাৎসিদের হাতে প্রাণ যাওয়া জার্মানির ইহুদিরা, আর তাদের হত্যাকারী নাৎসিরা ছিল একই জাতির, দুজনই জার্মান। তাদের দুজনার ইতিহাস এক, কেউ বলবে না।
পাঁচ.
কিন্তু আমাদের দেশের অনেক ইতিহাসবিদই এই বাস্তবতা স্বীকার করেন না। তারা বলেন, আমরা ‘এক’, আমাদের সমাজপতিরা এক, শত্রু এক অতএব এই ইতিহাস এক। আমরা নিজেরা ভেবে নেই। যাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, নির্যাতন, প্রতিরোধ, তাকে জিজ্ঞাসা করি না সে কী ভাবে। ফলে আমাদের বেশির ভাগ চর্চা রাজনীতিবিদ আর সৈন্যদের নিয়ে অর্থাৎ ক্ষমতাবানদের ইতিহাস হয়ে গেছে। এই ‘এক’ ইতিহাস প্রক্রিয়ার ফলে আমরা অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে এককথায় বাদ দিয়েছি। অর্থাৎ নারীকে।
ছয়.
নারীকে দেখি কেবল একজন অবলা অসহায় মানুষ হিসেবে, যার ইতিহাসে স্থান হয় কেবল ধর্ষিতা হিসেবে, ইতিহাসের অংশীদার হিসেবে নয়। অর্থাৎ আমরা আগেই ঠিক করে ফেলেছি, কার ভূমিকা ইতিহাসে কী বা কতটা ছিল। তথ্য বা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করি না। এটা জাতীয়বাদী ইতিহাসের প্রধান সমস্যা। তারাই ক্ষমতায় থাকে অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী এলিটগণ। এই ইতিহাসের ধারা এলিটদের ইতিহাস ধারা, সেটা রচনায় হোক অথবা তার বিবরণে। এটাই আমাদের প্রধান ধারা বনে আছে।
সাত.
নারীর ইতিহাস জানাটা কেন প্রয়োজন? ১৯৭১ জানতে? কারণ মুক্তিযুদ্ধটা কেবল টোটা-বন্দুকের যুদ্ধ ছিল না, গোটা সমাজের প্রতিরোধের যুদ্ধ ছিল। কিন্তু ইতিহাস চর্চায় সামাজিক অবস্থা নিয়ে কাজ কম হয়েছে। সমাজের বদলে আমরা ব্যক্তি বা ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর ভ‚মিকার কথা বলি। নেতারা কী করেছে সেটা আমরা জানি, সৈন্য কী করেছে সেটা জানি কিন্তু সাধারণ মানুষ কী করেছে সেটা অনেক কম জানি। অর্থাৎ কয়েকজন বাদ দিলে গোটা দেশের মানুষের ইতিহাস নাই হয়ে যায়। এর মধ্যে নারী পড়ে। আর নারীকে বাদ দিলে আমরা অর্ধেক মানুষের ভূমিকা বাদ দিয়ে ফেলি। এটা করতে আমাদের ইচ্ছাও লাগে না, আপনিতে হয়। কারণ বাদ না দিয়ে যদি বলি, সবার ভূমিকা ছিল তাহলে তো সবার সঙ্গে সুবিধা ভাগ করে খেতে হবে। সেটা আমরা চাই না। তাই নারীর ইতিহাস বাদ দেয়া বা ধর্ষণের মধ্যে সীমিত রাখা আমাদের এস্টাব্লিশমেন্টের প্রয়োজন নিজ স্বার্থে ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে। এটা ভেবে চিন্তা করা নয়, বরং এটা জাতীয়তাবাদী এলিটভিত্তিক একক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়ার অংশ।
আট.
ইতিহাসের বিবিধতা সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এমনকি নারীর ইতিহাসের ক্ষেত্রেও। যেমন আমরা সুশীল সমাজের নারীর কথা অনেক বেশি জানি, কিন্তু গ্রামের বিধবার কথা জানি না। দেশের ৯৫ শতাংশ নারীর বসবাস গ্রামে কিন্তু আমরা তাদের কথাটাই জানি কম। আমাদের সাহিত্যে, কবিতায় সেই মধ্যবিত্ত সুশীলরাই থাকে, সিনেমা নাটকে তো বটেই। এর কারণ শিল্পীরা নিজের জগৎ নিয়ে লিখবেন এটাই স্বাভাবিক। আর গ্রামের কথা লিখতে গেলে হয়ে ওঠে অবাস্তব। কাল্পনিক, কারণ গ্রাম তারা চেনেন না। ফলে আমরা জানি ছোট্ট একটি অংশের ইতিহাস, কিন্তু সেটাকেই বলি নারীর একাত্তরের ইতিহাস। কারণ সাধারণ নারী কেবল বলতে পারে তার নিজের ইতিহাসের কথা। কিন্তু তার বলার সুযোগ কম, শোনার লোক আরও কম।
নয়.
বাংলাদেশ জিতেছে, সাধারণ মানুষ জিতেছে বলেই। এরা প্রায় সবাই গ্রামের মানুষ যার অর্ধেক নারী। কিন্তু অন্য মানুষও আছে ইতিহাসে এবং তাদের কথা থাকা উচিত। এই না হারার গল্প, টিকে থাকার গল্প, সকল দায়িত্ব পালনের গল্প, যুদ্ধে অংশগ্রহণের গল্প মিলেই হচ্ছে নারীর একাত্তর। ওই ইতিহাস না জানা থাকলে বাংলাদেশ ১৯৭১ জানা যাবে না।